ছাত্রলীগ আমার অহংকার
উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্মদিন আজ। আমার যৌবনের প্রথম প্রেম, প্রেরণার উচ্ছাস, গৌরবের সংগঠনের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমানের সব নেতাকর্মীদের। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি ৭৫’-এ ঘাতকদের হাতে নিহত শহীদদের। শ্রদ্ধা জানাই ছাত্রলীগের সব প্রয়াত নেতাকর্মীকে। বাংলা, বাঙালির স্বাধীনতা ও স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যেই মূল দল আওয়ামী লীগের জন্মের এক বছর আগেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল গৌরব ও ঐতিহ্যের এ ছাত্র সংগঠন।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা হওয়া এই ছাত্রলীগের বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের উন্মেষকাল মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন "মহান ভাষা আন্দোলন"-এ নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে রক্তাক্ত ও সংগ্রামী যাত্রা পথের সূচনা হয়। এরপর থেকে সংগঠিত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগ তার এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সফল হয়। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে ছাত্রলীগের গৌরবদীপ্ত ও অবিস্মরণীয় ভূমিকা আজ সর্বজনস্বীকৃত ইতিহাসের অংশ৷
১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অবদান ছাত্রলীগের ইতিহাসকে দান করেছে অনন্য বৈশিষ্ট৷ জাতির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্রলীগ একটি সংগঠিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত করতে অত্যন্ত সফলভাবে সমর্থ হয়। একটি সংগঠন হিসাবে দুর্জয়ী কাফেলায় পরিণত হয়েছে। এজন্য হারাতে হয়েছে অসংখ্য নেতা-কর্মী। সংগঠনের অসংখ্য শহীদ, অগণিত নেতা-কর্মীর জেল-জুলুম-কারাবরণ, নির্যাতন-নিপীড়ন ভোগ, আর নেতা-কর্মীদের এক নদী রক্তের বিনিময়ে রচিত হয়েছে এক সফল রক্তাক্ত ইতিহাস ও স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে প্রথমে খুনি মোশতাক সরকার এবং পরে জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলেও জেল- জুলুম-হুলিয়ার শিকার হয়ে অগণিত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে কারাবরণ, দেশত্যাগ, অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে।
তারুণ্যের উচ্ছল প্রাণ বন্যায় ভরপুর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা দেশের ইতিহাসকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, লড়াই করেছেন প্রতিটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। ঠিক এই কারনেই বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালি জাতির ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস।’
বাংলা ও বাঙালির প্রায় সাত দশকের সংগ্রাম, গৌরব ও সাহসের সারথী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গর্বিত অংশীদার এই ছাত্র সংগঠনটি। জাতির ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়েই রয়েছে ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এ দেশের মানুষকে লাল সবুজের একটি পতাকা, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’- জাতীয় সঙ্গীত, ও স্বাধীন ভূখণ্ডের বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৮ হাজার নেতাকর্মী শহীদ হয়।
মেধাবী ও আধুনিক মনা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেশে আবারও প্রজ্জ্বলিত হবে ছাত্রলীগের গৌরব কথা, ছাত্রলীগের ঐতিহ্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা। ছাত্রলীগ মানেই গভীর দেশপ্রেম, আদর্শবোধ ও ত্যাগের মহিমায় পড়াশোনার পাশাপাশি জাতি গঠনে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখে যাওয়া একটি সাহসী ছাত্র সংগঠন। যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। ছাত্রলীগের যে ত্যাগ, যে অর্জন তা অন্য কারো নেই। ছাত্রলীগের ইতিহাস ছাত্রলীগই। ছাত্র সমাজের নেতৃত্বদানকারী এই ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাতালগ্ম থেকেই ছিল গৌরবদীপ্ত ও মহিমানিত্ব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর ১৯৮১ সালে ১৭ মে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মায়ের মমতায় ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করেন, আরো গতিশীলতা দিয়েছেন, করেছেন শক্তিশালী। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ছাত্রদের হাতেই তুলে দিয়েছেন। অবিবাহিত নিয়মিত ছাত্ররাই এবং বয়সসীমা ২৯ বছরের নিচে যাদের তারাই নেতৃত্বে আসবেন।
ছাত্রলীগ শুধু বিরোধী দলেই নয়, মূল দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও ছাত্রলীগ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এবং মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র সমাজের ন্যায্য দাবি আদায়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। হলের সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। যখনই অশুভ শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে তখনই রাজপথে সক্রিয় ছিল ছাত্রলীগ।
এই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের বন্যায় বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশে এক কোটি মানুষ মারা যাবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিবিসির প্রতিবেদন মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। সে সময়ে আমি ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম। জননেত্রী শেখ হাসিনার নিদের্শ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন, সারা দেশে ছাত্রলীগের অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের হলগুলো রুটি-স্যালাইন বানানোর কারখানায় রুপান্তর হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রুটি-স্যালাইন বানিয়ে বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করেছিল লাখ লাখ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। অতীতের ধারাবাহিকতায় সেই স্বাক্ষর ছাত্রলীগ ধরে রেখেছে অনেকবার।
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যখন ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে ছাত্র রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছিলেন, তখন আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রদের হাতে বই-খাতা-কলম তুলে দিয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালের মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ১২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বিশাল ছাত্র সমাবেশ আমার হাতে (সে সময় আমি ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম) বই-খাতা তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বই-খাতা-কলম হচ্ছে ছাত্রদের প্রকৃত হাতিয়ার। তিনি আরো বলেছিলেন, শুধু ভালো কর্মী হলেই চলবে না, ভালো ছাত্রও হতে হবে। নির্দেশ দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মনযোগ দিয়ে পড়ালেখা করতে হবে। মেধাবীরাই ছাত্রলীগ করবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ইতিহাসের সেরা সাহসী সন্তানেরাই ছাত্রলীগ করে। তিনি বলেছিলেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। আর ছাত্রলীগ হচ্ছে সোনার মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ না করলে আমি আজকের অবস্থানে আসতে পারতাম না। আমাকে কেউ চিনত না-জানত না। আমার রাজনীতির জন্ম হয়েছে ছাত্রলীগ থেকে। ছাত্রলীগ আমার শৈশবের ভালোবাসা, কৈশরের উচ্ছ্বাস এবং প্রথম যৌবনের প্রেম। ছাত্রলীগ আমার অহংকার, আমার গৌরব, গর্ব এবং অলংকার। আমার রাজনীতির ঐতিহ্য, ছাত্রলীগ আমার অস্তিত্বে মিছে আছে। আজকে অতীতের কথা মনে পড়লেই মন আনন্দের শিহরণ জাগে যে, স্কুল জীবনে এই সংগঠনের প্রেমে পড়েছিলাম। ‘আমরা সবাই মুজিব হব, মুজিব হত্যার বদলা নিব, এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নিবে’-স্লোগান দিয়ে স্কুল ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু করেছিলাম। এরপর কলেজ শাখার নেতৃত্ব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক ও সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি, পরবর্তী সময়ে জাকসু নির্বাচিত ভিপি হয়েছিলাম। সেই ধারাবাহিকতায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম। ১৯৮৯ সালে যখন জাকসু ভিপি ছিলাম, তখন এখনকার মতো এত টেলিভিশন, এত পত্রিকা ছিল না। বিবিসির সাংবাদিক মার্ক টালি আমাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, `Sheikh Hasina is more popular Then Ershad or Khalada zia in University campuses’। কারণ, সেসময় ডাকসু, জাকসু, বাকসু, ইকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ বিজয়ী ছিল।
ছাত্রলীগ মেধাবী ছাত্রদের সংগঠন। সমাজের সব স্তরেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর বিচরণ রয়েছে। সাবেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের নিজস্ব মেধা ও কর্মের মাধ্যমে আজকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত। আজকে ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দৃঢ়তা, সততা নিষ্ঠা এবং সাহসিকতার সঙ্গে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রশংসা করছেন বিশ্ব নেতারা। সবাই জানতে চাইছেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মিরাকলটা কী? কী চমক আছে জননেত্রীর নেতৃত্বে? শেখ হাসিনা ভালো থাকলেই বাংলাদেশ ভালো থাকবে। ভালো থাকবে ১৬ কোটি মানুষ-এই বিশ্বাস সমগ্র দেশবাসীর।
৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের কাছে আমার আহ্বান যার যার অবস্থান থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করুন। তাঁর হাতকে শক্তিশালী করুন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ শেখ হাসিনার হাতেই নিরাপদ, আর কারো হাতেই নয়।
ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী হিসেবে বর্তমান নেতাদের আহ্বান জানাই, ছাত্রলীগের কাজের দ্বারা যেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়। ছাত্রলীগকে সবাই ভালোবাসবে। সবাই পছন্দ করবে। ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলবে ছাত্রলীগ। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, মাদকবিরোধী কার্যক্রমে বেশি সক্রিয় হবে ছাত্রলীগ। বিপদে আপদে ছাত্রদের পাশে দাঁড়াবে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের প্রতি মানুষের ভালোবাসা-শ্রদ্ধা ও আস্থা থাকবে। সে কাজটির দায়িত্বভার বর্তমান ছাত্রলীগকেই নিতে হবে। কারণ ইতিহাস, ঐতিহ্য, গৌরব, অহংকার, স্বর্ণালী অতীতের ধারক বাহক হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ। আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সফল ও স্বার্থক হোক-এই কামনা করছি-জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও সাবেক জাকসু ভিপি।