ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ করে প্রাণ নিয়ে টানাটানি

রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় এক বোতল কোমল পানীয়র দাম পাঁচ টাকা বেশি রাখা হয়েছিল। এ নিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেছিলেন এক ভোক্তা। খবর পেয়ে হোটেল মালিক তাঁকে হুমকি দেওয়া শুরু করেন। বাসার সামনে মাস্তান দিয়ে বসান পাহারা।
এই ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ওই ভোক্তা। এরপর ওই জিডির তদন্ত কর্মকর্তা তাঁকে হুমকি দেওয়া শুরু করেন। চাপ দেন অভিযোগ প্রত্যাহার করে হোটেল মালিকের সঙ্গে আপস করতে। এই ঘটনার পর আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ওই ভোক্তা। এমনকি যে স্বজনের বাসায় থাকেন তাঁরাও দ্রুত বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন।
ভুক্তভোগী ওই ভোক্তার নাম রিয়াদুস সালেহীন। তিনি গুলশান এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রাজধানীর আগারগাঁও তালতলা এলাকার সরকারি কলোনিতে এক চাচার সঙ্গে স্ত্রী নিয়ে থাকেন।
রিয়াদুস সালেহীন আজ মঙ্গলবার বিকেলে এনটিভি অনলাইনকে জানান, গত ২৩ এপ্রিল তিনি আগারগাঁও তালতলা বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত হোটেল আমানত শাহ অ্যান্ড কাবাব রেস্টুরেন্টে খেতে যান। খাবার শেষে তিনি কোমল পানীয় এনে দিতে বলেন। তখন তাঁকে কোকাকোলার ৬০০ মিলিলিটারের একটি বোতল দেওয়া হয়। খাবার শেষে যখন তিনি রসিদ চান, তখন দেখতে পান কোমল পানীয়র মূল্য ধরা হয়েছে ৪০ টাকা। কিন্তু বোতলের গায়ে মূল্য লেখা ছিল ৩৫ টাকা। তখন তিনি হোটেল কর্তৃপক্ষের পাঁচ টাকা বেশি রাখার কারণ জানতে চান। তাঁকে বলা হয়, ‘আমাদের এখানে এমনই।’
তখন রিয়াদুস সালেহীন কথা না বাড়িয়ে টাকা পরিশোধ করে রসিদ নিয়ে হোটেল থেকে চলে আসেন। এরপর তিনি বাসায় গিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে একটি অভিযোগ করেন।
গত ২৫ মে বৃহস্পতিবার রিয়াদুস সালেহীনকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে জানানো হয় যে তাঁর অভিযোগের বিষয়ে ২৯ মে (সোমবার) বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। সে কারণে তাঁকে কারওয়ান বাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সভাকক্ষে উপস্থিত হতে হবে।
এর পরদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় রিয়াদুস সালেহীন সরকারি কলোনির বাসার নিচে ছিলেন। তখন চার-পাঁচজন ব্যক্তি নিজেদের আমানত শাহ হোটেলের লোক বলে পরিচয় দিয়ে তাঁর কাছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করার কারণ জানতে চান। এ সময় তাঁরা রিয়াদুস সালেহীনকে ব্যাপক গালমন্দ করে নানা রকম হুমকি দেন।
রিয়াদুস সালেহীন বলেন, ওই ঘটনার পর আমানত শাহ হোটেলের মালিক মো. সেলিম ভূঁইয়া বিভিন্নভাবে তাঁকে হুমকি দিয়ে ভোক্তা অধিকারের শুনানিতে যেতে নিষেধ করেন। এমনকি তাঁদের বাসায় মাস্তান পাঠিয়ে তাঁর চাচা-চাচিকে হুমকি-ধমকি দেন। তিনি শুনানিতে অংশ নিলে চাচা-চাচিসহ তাঁদের এলাকা ছাড়া করা হবে এবং হাত-পা পর্যন্ত ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেন সেলিম।
রিয়াদুস সালেহীন আরো বলেন, হোটেল মালিক ও তাঁর লোকজনের একাধিক হুমকি পাওয়ার পর তিনি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে নোটিশ পাঠানো কর্মকর্তাকে ফোন করে বিস্তারিত জানান। এরপর তিনি শেরেবাংলা নগর থানায় একটি জিডি করেন। জিডি তদন্তের পান থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. মোখলেছুর রহমান।
গতকাল সোমবার ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে রিয়াদুস সালেহীনের করা অভিযোগের শুনানি হয়। অনেক হুমকি উপেক্ষা করে রিয়াদুস সালেহীন ওই শুনানিতে উপস্থিত হন। শুনানিতে হোটেল আমানত শাহ অ্যান্ড কাবাব রেস্টুরেন্টকে ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রিনা বেগম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমানত শাহ হোটেলটির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটি ছোটখাটো অভিযোগ। তাই ২০০ টাকা জরিমানা করেছি।’
২০০ টাকা জরিমানার পর মাস্তানদের আনাগোনা
এদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রায় দেওয়ার পর রিয়াদুস সালেহীন বিকেলে অফিস শেষ করে চাচার বাসায় যেতে পারছেন না। তিনি অভিযোগ করেন, হোটেল মালিক সেলিম ও তাঁর ভাড়া করা মাস্তানরা তাঁর বাসার সামনে ঘোরাঘুরি করছেন। এমনকি তাঁরা যে সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন সেখানে কলোনির সেক্রেটারির কাছে বিচার দেওয়া হয়েছে, কেন একই এলাকায় বসবাস করে তাঁদের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ দেওয়া হলো।
রিয়াদুস সালেহীন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, গতকাল সন্ধ্যায় শেরেবাংলা নগর থানায় করা জিডির তদন্ত কর্মকর্তা এএসআই মো. মোখলেছুর রহমানকে তিনি ফোন করে জানান যে সন্ত্রাসীরা তাঁর বাসার সামনে অপেক্ষা করছে। এ কারণে তিনি বাসায় ফিরতে ভয় পাচ্ছেন। সব কিছু শুনে এএসআই মোখলেছুর রহমান তাঁকে বলেন, রাত ৯টার সময় তাঁর দায়িত্ব শুরু হবে, তখন ফোন করেন।
এরপর রিয়াদুস সালেহীন সন্ধ্যা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রাণের ভয়ে বাসায় না ফিরে থানা এলাকার আশপাশে ঘুরতে থাকেন। রাত ৯টার পর এএসআই মোখলেছুর তাঁকে ফোন করে দেখা করতে বলেন। দেখা হওয়ার পর এএসআই তাঁকে বলেন, হোটেলের মালিক সেলিম ভাই। তিনি এমন কাজ করেছেন, বিশ্বাসই হচ্ছে না। এরপর তিনি রিয়াদুস সালেহীনকে মোটরসাইকেলে করে তাঁর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসেন।
আপসের জন্য পুলিশের চাপ
রিয়াদুস সালেহীন বলেন, বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাওয়ার পর থেকে এএসআই মোখলেছুর রহমান তাঁকে অনেকবার ফোন করেন। তিনি হোটেল মালিকের সঙ্গে আপস করতে বলেন। কারণ হোটেলের মালিকের সঙ্গে তাঁর (এএসআই মোখলেছুর) কথা হয়েছে। হোটেল মালিক বলেছেন যে, তিনি তাঁদের (রিয়াদুস সালেহীন) বাসায় হুমকি দিতে যাননি। তিনি গিয়েছিলেন সামান্য বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করার কারণ জানতে।
এএসআই মোখলেছুর রহমান ও ভুক্তভোগী রিয়াদুস সালেহীনের মধ্যে মুঠোফোনে কী কী কথা হয়েছে-তার রেকর্ড এনটিভি অনলাইনের কাছে আছে। সেটি এনটিভির ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করে এই নিউজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
এই বিষয়ে এএসআই মোখলেছুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘হোটেলের মালিক সেলিম ওই ব্যক্তির চাচার কাছে গিয়ে একটি অভিযোগ দিয়ে এসেছেন। হোটেলে তিনি কোক বিক্রি করেন না। সেদিন (২৩ এপ্রিল) কোক বাইরে থেকে এনে দিয়েছিলেন। এ জন্য বিলে পাঁচ টাকা বেশি লেখা হয়েছে। এরপর ওই ছেলে (রিয়াদুস সালেহীন) ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেছে এবং হোটেলের মালিককে ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’
এএসআই বলেন, ‘হোটেল মালিককে (সেলিম) আমরা (পুলিশ) চিনি। তাঁর হোটেলে মাঝে মধ্যে চা-পানি খাই। তিনি নিরীহ একটা ছেলে (হোটেল মালিক)। রিয়াদুস সালেহীনের চাচার কাছে হোটেল মালিক কয়েকবার গিয়েছিলেন, কিন্তু হুমকি দেওয়ার জন্য নয়, তাঁকে শুধু বলার জন্য। এরপর রিয়াদুস সালেহীন ২৭ মে থানায় একটি জিডি করেছে। আর গতকাল (সোমবার) সন্ধ্যায় আমাকে ফোন করে বলে যে, আমি বাসায় ঢুকতে পারছি না, কয়েকজন ছেলে আমার বাসার সামনে রয়েছে। এই বিষয় নিয়ে একটি জিডি করেছিলাম। তখন আমি বলি, জিডির কপি তো আমি এখন হাতে পাই নাই। যা হোক আপনি কই আছেন, আমার সাথে দেখা করেন। এরপর রাত ৯টার দিকে তাঁর (রিয়াদুস সালেহীন) সাথে দেখা হওয়ার পর বলেছি, চলেন আপনার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি, দেখি কত বড় মাস্তান। এরপর আমি তাকে তাঁর বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছি। বাসার আশপাশে এবং দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাঁরা বলেছে, এমন কিছুই কেউ জানে না। তবে হোটেলের মালিক এসেছিল কলোনির সভাপতির কাছে বলার জন্য যে এই ঘটনাটা কেন হলো।’
হোটেল মালিক সেলিমের হত্যার হুমকি দেওয়া এবং এ নিয়ে জিডি প্রসঙ্গে এএসআই বলেন, ‘আমি তো ভাই বুঝতেছি না। সেলিম নিরীহ একটা ছেলে। আপনি এলাকায় এসে খোঁজ নিতে পারেন। তাঁর পরেও আমি অভিযোগকারীকে বলেছি আপনি যদি চান, এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে আমি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
অভিযোগকারীকে বারবার সমঝোতা করতে বলার কথা অস্বীকার করে মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘আমি অভিযোগকারীকে সমঝোতা করার কথা বলি নাই।
হোটেল মালিক সেলিম কি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত এমন প্রশ্নের জবাবে এএসআই বলেন, ‘আমার জানামতে, সেলিম কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নয়। সে দোকান করে খায় এটাই জানি।’
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে হোটেল মালিক মো. সেলিম ভূঁইয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি যেহেতু ক্যাশ মেমো লিখেছি ৪০ টাকা, তাই গতকাল আমাকে দোষী করে ২০০ টাকা জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর।’
সেলিম বলেন, ‘প্রথম যখন উনি (রিয়াদুস সালেহীন) আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা করেন, তখন ভোক্তা অধিকার থেকে আমার কাছে একটা চিঠি আসে। ওই চিঠির মাধ্যমে আমি জানি, ওই ব্যক্তি থাকেন তালতলা এলাকায়। এরপর তাদের এলাকার পরিবেশ কমিটির সভাপতি ও সম্পাদকের কাছে বিষয়টি জানাই। এরপর ওই ব্যক্তির (সালেহীন) চাচার কাছেও বিষয়টি বলি।’
অভিযোগকারীকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে হোটেল মালিক দাবি করেন, ‘তাঁকে (রিয়াদুস সালেহীন) কোনো ধরনের হুমকি দেওয়া হয়নি। আমি শুধু ওই কমিটির কাছে গিয়ে অভিযোগ দিয়েছি, এখানে আমার অপরাধটা কী? তখন কমিটির লোকরা তাঁকে ডেকে এনে বলেন, তুমি (রিয়াদুস সালেহীন) তো কাজটা ঠিক করো নাই, যেভাবে হোক তুমি মীমাংসা করে ফেল। এরপর বিষয়টি শোনার পর তাঁর চাচাও মীমাংসা করার কথা বলেন।’
সেলিম ভূঁইয়া বলেন, ‘এত কিছুর পরেও আমার বিরুদ্ধে শেরেবাংলা থানায় একটি জিডি করা হয়।’