কলারোয়ার দুঃখ কপোতাক্ষ

‘চাল আছে, চুলো নেই। ঘরে কাঠও নেই। একমুঠ চাল যে ফুটিয়ে ছেলেমেয়েদের মুখে দেব তেমন কোনো ব্যবস্থাও নেই।’ কাদাপানিতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলছিলেন সানাপাড়ার আলেয়া খাতুন। সানাপাড়া গ্রামটা সাতক্ষীরা জেলার কলারোয় উপজেলায়। টানা বৃষ্টিতে উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদ এখন মানুষের দুঃখ। এ নদের পানি উপচে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে মানুষ।
পানি সরে যাওয়ার জন্য এসব এলাকার বাসিন্দাদের আগামী ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে। বসতবাড়িসহ ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে। পানি সরে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাসিন্দাদের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। ২০ বছর ধরে কপোতাক্ষ নদের তীরের এ বাসিন্দারা এ দুর্দশা নিয়ে জীবনযাপন করছে।
টানা বৃষ্টিতে কপোতাক্ষ উপচে কলারোয়ার প্রায় ৭০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ১৫ দিনের বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এমন হাজার হাজার মানুষ। কয়েকটি বিলে পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে ফসল ও আমন বীজতলা। একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পানির চাপে বাড়িঘরও ধসে পড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আশঙ্কা করছেন আরো তিনটি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ভেঙে যেতে পারে।
কলারোয়ার দেয়াড়া, যুগিখালী ও জয়নগর ইউনিয়নের গ্রামের পর গ্রাম কপোতাক্ষ নদের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রতিবছরই এভাবে ছয় মাস ধরে কপোতাক্ষ নদের অভিশাপে ডুবে থাকতে হয় তাঁদের। পানি অপসারণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রাকৃতিকভাবে পানি শুকালে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়।’
ছয় মাস এসব এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। নানা ধরনের রোগ-পীড়ার শিকার হতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। গবাদি পশু বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষ হয়ে পড়ে কর্মহীন। একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবারও।
যে কারণে সমস্যা
পলি জমে গত দুই দশক ধরে স্রোতহীন হয়ে পড়েছে কপোতাক্ষ নদ। পলি জমে তলদেশ উঁচু হয়ে পড়ায় ধারণক্ষমতা ও নাব্য হারিয়েছে এ নদ। বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি হলেই এর পানি উপচে পড়ে। ২০ বছর ধরে কপোতাক্ষ নদের তীরের গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের এ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জমে থাকা পানি ছয় মাস আটকে থাকে। আর তা সরার জন্য নির্ভর করতে হয় প্রকৃতির ওপর।
এ ব্যাপারে কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন বলেন, ‘কপোতাক্ষ নদের অভিশাপ এখন কেবলমাত্র কলারোয়া নয়, যশোরের চৌগাছা, মনিরামপুর, কেশবপুর; সাতক্ষীরার তালা, খুলনার পাইকগাছাসহ ১২টি উপজেলার কয়েকশ গ্রামের প্রায় ২০ লাখ মানুষের মধ্যে বিস্তার করেছে। কপোতাক্ষ নদ গভীরতা ও নাব্য হারানোয় প্রতিবছর দুই কূলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি জানান, সরকার কপোতাক্ষ নদ খনন শুরু করেছে। বৃষ্টির কারণে তা বন্ধ আছে।
খননকাজে স্বচ্ছতার অভাব আছে মন্তব্য করে ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘খনন শেষ হলে কপোতাক্ষ আবারও এর হৃতযৌবন ফিরে পাবে।’
সংকটে বিপর্যস্ত জীবন
যুগিখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য সিরাজুল ইসলাম জানান, ‘গত প্রায় ২০ বছর ধরে এ অবস্থায় আমরা দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছি। অথচ এর স্থায়ী সমাধান হলো না আজও।’
সানাপাড়া, পাকুড়িয়া, মাঠপাড়া, কাশিয়াডাঙ্গা, জানকা, মালোপড়াসহ কয়েকটি গ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে রান্না করে খেতে পারছেন না। উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে আছেন তাঁরা। এসব এলাকার নলকূপগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়া খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে চর্মরোগ। এ ছাড়া শিশু ও বৃদ্ধরা নানা রোগের শিকার হচ্ছেন।
পানিবন্দি এসব মানুষের চলাচলের একমাত্র মাধ্যম এখন কলার ভেলা ও নৌকা। গ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের গবাদি পশু বাঁচাতে সড়কের ধারে চালাঘর তৈরি করেছেন। এলাকাজুড়ে দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের তীব্র সংকট।
উপজেলার একাধিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের কাছে এখন পর্যন্ত ওষুধপত্র ও ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি। এরই মধ্যে উফাপুর গ্রামের চারটি বিলের দেড় হাজার বিঘা জমির ফসল এবং আমন বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। উফাপুর স্লুইসগেটের কপাট না থাকায় সব সময় পানি ঢুকছে বিল ও লোকালয়ে। কপোতাক্ষর পানির তোড়ে ভেসে গেছে বহু মাছের ঘের। ডুবে গেছে পুকুরগুলোও। বাড়িঘরে পানি ওঠায় কাঁচাঘর বাড়ি ধসে পড়তে শুরু করেছে।
সানাপাড়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য মোস্তফা, মোবারক, বজলুর, ইসলাম, মনি আক্তার, সাত্তার, আতিয়ার, অজেদ আলীসহ কয়েকজন জানান, বর্ষায় অতিবৃষ্টি হলেই নদের পানি উপচে পড়ে। এই পানিতেই তলিয়ে থাকতে হয় তাদের।
মালোপাড়া গ্রামের মনিন্দ্র মালো জানান, তিনি ও তাঁর প্রতিবেশীরা প্রতিবছরই নিজেদের বাড়িঘর ও জানমাল রক্ষায় রাস্তার ধারে বালুর বস্তা ও ইট ফেলে উঁচু বাঁধ তৈরি করেন। বছর শেষে পরের বর্ষা মৌসুমে আবারও করতে হয় একই কাজ। এভাবে গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ কাজ করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, জলাবদ্ধতার কারণে বহু বড় গাছও মারা যায়।
দেয়াড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান জানান, ‘দেয়াড়া কর্মকারপাড়ার নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে বহু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া পাকুড়িয়া স্লুইসগেট থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়, জানকা ঈদগাহ থেকে তরুলিয়া পর্যন্ত এবং কাশিয়াডাঙ্গা কুটির মাঠ থেকে মালোপাড়া পর্যন্ত তিনটি নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর যে কোনো একটি ভাঙলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে।’ তিনি আরো জানান, পানি অপসারণের কোনো পথ নেই। কপোতাক্ষ খননকাজ চলছে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে কাজ বন্ধ রয়েছে।
দেয়াড়া ইউনিয়নের দুই-তৃতীয়াংশ কপোতাক্ষবেষ্টিত উল্লেখ করে চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান জানান, বাঁধ রক্ষা করতে না পারলে পুরো ইউনিয়নই প্লাবিত হবে।
কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন জানান, ‘পানি অপসারণ করার চেষ্টা চলছে। আর মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রীও তাড়াতাড়ি পৌঁছাবে বলে জানিয়েছেন তিনি।