শিক্ষক নয়, শিক্ষা কর্মকর্তা কিনছেন শিশুর খেলনা!
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের খেলনার জন্য প্রতিটি প্রাক-বিদ্যালয়কে পাঁচ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয় সরকার। এ টাকা দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠান শিশুদের উপযোগী ৩১টি খেলার সরঞ্জাম কিনবে। নড়িয়াতে এসব খেলনা কেনার দায়িত্ব নিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নিজেই। অধিকাংশ প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৮টি খেলনা কিনে দিয়ে তিনি আদায় করছেন দুই হাজার ১০০ টাকা করে।
নড়িয়া উপজেলায় ১২৩টি বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূ্চি আছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা হচ্ছে, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা প্রতিটি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দিবেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকসহ তিন শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি বাজার যাচাই করে এ টাকায় উন্নতমানের খেলার সরঞ্জাম কিনবেন। সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তারা বিষয়টি তদারকি করবেন। সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে পুতুল, অ্যালুমিনিয়ামের খেলনা হাঁড়ি-পাতিল, পিংপংসহ বিভিন্ন ধরনের বল, প্লাস্টিকের ক্রিকেট ব্যাট-বল, খেলনা গাড়ি, প্লাস্টিকের জীবজন্তু ইত্যাদি।
উপজেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার নড়িয়া উপজেলায় খেলনা কেনা বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৬ লাখ ১৫ হাজার টাকা।
অভিযোগ ওঠেছে, এই সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না। সরঞ্জাম কেনার দায়িত্ব নিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন আহাম্মেদ। তিনি নিজেই কয়েকটি সরঞ্জাম কিনে দিয়ে প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে দুই হাজার ১০০ টাকা করে রাখছেন। বরাদ্দ করা পাঁচ হাজার টাকার বাকি অংশ শিক্ষকদের দেওয়া হয়েছে আরো সরঞ্জাম কেনার জন্য। অধিকাংশ শিক্ষক অভিযোগ করছেন, মানহীন সামগ্রী দেওয়া হয়েছে শিশুদের জন্য।
উপজেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন আহাম্মেদ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাজার থেকে উপকরণ কিনে উপজেলা শিক্ষা কার্যালয়ের একটি কক্ষে মজুদ করেন। বিষয়টি নিয়ে বির্তকের সৃষ্টি হলে পণ্যগুলো সরিয়ে নড়িয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বই রাখার কক্ষে নিয়ে মজুদ করা হয়।
একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতাদের সমন্বয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষদের ওই পণ্য নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। শিক্ষা কর্মকর্তার হয়রানির হাত থেকে বাঁচতে অনেকেই ওই পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই পণ্যের মান খারাপ হওয়ায় পণ্য না নিয়েই চলে গেছেন।
শিক্ষকরা জানিয়েছেন, শিক্ষা কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহাম্মেদ বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকদের ১৮টি উপকরণ ধরিয়ে দিয়ে দুই হাজার ১০০ টাকা করে আদায় করছেন।
বিভিন্ন বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরবরাহ করা সরঞ্জামের দাম সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা হবে। একজন প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমার বিদ্যালয়ে সরবরাহ করা সরঞ্জামের দাম এক হাজার ২০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকার বেশি হবে না।’ প্রাক-প্রাথমিক কর্মসূচির এক শিক্ষিকা বলেন, 'ফেরিওয়ালাদের কাছে এর চেয়ে ভালো জিনিস পাওয়া যায়।'
২৪ নম্বর লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা পারভীন খানম বলেন, ‘আমি পাঁচ হাজার টাকার চেক তুলে স্যারের (উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা) হাতে দিয়ে এসেছি। তাঁরা মালামাল কিনে দিবে বলেছে। তাঁদের কথা না শুনলে কোনো কাজ নিয়ে গেলে হয়রানির শিকার হতে হয়।’
ডিঙ্গামানিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সেতারা ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে দুই হাজার ১০০ টাকা রেখে ১৮টি পণ্য দিয়েছে। উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছাবিহা খানমের কাছ থেকে পণ্য বুঝে নিতে বলেছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। আমি ১৮টি পণ্য পেয়েছি। এর মধ্যে গামলা ও বালতি ছাড়া সব পণ্য খারাপ মানের হয়েছে।’
এ ব্যাপারে নড়িয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও নড়িয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছাবিহা খানম বলেন, ‘শিক্ষক সমিতি কোনো পণ্য সরবরাহ করেনি। শিক্ষা কর্মকর্তা নিজেই পণ্যগুলো কিনে এনেছেন। তবে আমরা শুনেছি সব শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করেই পণ্য কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
এ ব্যাপারে নড়িয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহাম্মেদ বলেন, ‘শিক্ষকরা টাকা নিয়ে গেলে পণ্য কেনেন না। তাই নমুনা হিসেবে আমরা কিছু পণ্য কিনে দিয়েছি। যাতে পণ্যগুলো মানসম্মত হয়।’
শরীয়তপুরের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘শিশুদের খেলনার টাকা নিয়ে কেউ বাণিজ্য করেছে এমন কিছু আমার জানা নেই। তবে কেউ বাণিজ্য করে থাকলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’