নরসিংদীতে জান্নাতিকে পুড়িয়ে হত্যা, চার আসামি নাটোরে গ্রেপ্তার
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2019/06/19/photo-1560944331.jpg)
নরসিংদীতে স্কুলছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসী ওরফে জান্নাতিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত চার আসামিকে নাটোর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নরসিংদী সদর মডেল থানার পুলিশ নাটোরের নারায়ণপুর পুকুরপাড় এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তার হওয়া চারজন হলেন নিহত জান্নাতির স্বামী সাব্বির আহমেদ শিপলু ওরফে শিবু (২৩), শাশুড়ি শান্তি বেগম ওরফে ফেন্সী রানী (৪৫), শ্বশুর হুমায়ুন মিয়া (৫০) ও ননদ ফাল্গুনী বেগম (২০)। তাঁরা সবাই নরসিংদী সদর উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের খাসেরচর গ্রামের বাসিন্দা।
বুধবার দুপুরে নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন বলেন, পারিবারিক মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ত না হওয়ায় জান্নাতুল ফেরদৌসী ওরফে জান্নাতিকে পুড়িয়ে হত্যা করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এ ঘটনায় গত ১৫ জুন নিহতের বাবা শরিফুল ইসলাম বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। এ ঘটনায় ওই দিন রাতেই ছয়জনকে আটক করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্য মতে, পুলিশ ও ডিবি পুলিশের একটি চৌকস দল নারায়গঞ্জের রূপগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে। সেসব স্থানে না পেয়ে নাটোর জেলায় অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে মঙ্গলবার রাতে এজাহারভুক্ত চার আসামি মাদক ব্যবসায়ী শাশুড়ি শান্তি বেগম ওরফে ফেন্সী রানীসহ হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়। আজই তাদের আদালতে সোপর্দ করা হবে এবং আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
মামলার এজাহার ও নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, প্রায় এক বছর আগে হাজিপুর গ্রামের স্কুলছাত্রী জান্নাতির সঙ্গে পাশের খাসের চর গ্রামের হুমায়ুন মিয়ার ছেলে শিপলুর প্রেম হয়। কিছুদিন পরই পরিবারের অমতে তারা পালিয়ে বিয়ে করেন। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামীর আসল রূপ বেরিয়ে আসে। জান্নাতিকে পারিবারিক মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ত করতে শাশুড়ি শান্তি বেগম ও স্বামী শিপলু তাকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। এতে রাজি হয়নি জান্নাতি। তাই তার ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। এরপর শ্বশুরবাড়ির লোকজন পাঁচ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে। দরিদ্রতার কারণে যৌতুকের দাবি মিটাতে পারেননি জান্নাতির বাবা। ফলে জান্নাতির ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। যৌতুকের টাকা না দেওয়া ও মাদক ব্যবসায় জড়িত না হওয়ায় গত ২১ এপ্রিল রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় স্বামী শিপলু, শাশুড়ি শান্তি বেগম ও ননদ ফাল্গুনী বেগম জান্নাতির শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। দগ্ধ হয়ে ছটফট করলেও তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাননি তাঁরা। পরে এলাকাবাসীর চাপে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘ ৪০ দিন যন্ত্রণার পর গত ৩০ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
এদিকে ঘটনার পরপর জান্নাতির পরিবার সদর মডেল থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ তা নেয়নি। ২৫ এপ্রিল জান্নাতির দাদা মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম খান নরসিংদীর আদালতে মামলা করেন। আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। কিন্তু দেড় মাসেও তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি পিবিআই। এরই মধ্যে জান্নাতির মৃত্যু হয়। আসামিরাও গ্রেপ্তার হয়নি। উল্টো অভিযুক্ত ও তাদের স্বজনরা মামলা প্রত্যাহার করতে জান্নাতির পরিবারকে দফায় দফায় হুমকি দেয়।
নিহত জান্নাতির বাবা শরীফুল ইসলাম খান বলেন, মেয়ের শরীরে আগুন দেওয়ার পর পরই থানায় মামলা করতে যাই। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে আদালতে মামলা দায়ের করি। আদালত থেকে পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তারা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেনি। এদিকে হত্যাকারীরা অব্যাহতভাবে আমাদের পরিবারকে ভয়-ভীতি ও হুমকি দিচ্ছে। মামলা করলে আমার ছোট মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে। একই সঙ্গে আমাদের সবাইকে প্রাণে মেরে ফেলবে বলেও হুমকি দিচ্ছে।
এদিকে মৃত্যুর আগে আগুন দিয়ে পোড়ানোর বর্ণনা দিয়ে গেছে জান্নাতি। তার আর্তনাদ কেঁপে উঠেছিল পুরো হাসপাতাল চত্বর। পাশের বেডে থাকা এক রোগী ভিডিও ধারণ করেছে তার করুণ আর্তনাদ। সেখানে দেখা গেছে, মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল সে। তীব্র ব্যথা সইতে না পেরে দরিদ্র বাবার কাছে ব্যথানাশক একটি ইনজেকশন দেওয়ার দাবি জানায়। সেখানে সে বলছিল, ‘তোমার কাছে জীবনে আর কিছুই চাইব না বাবা। একটি ব্যথানাশক ওষুধ দাও।’ কিন্তু দরিদ্র বাবা সেই ইনজেকশন কিনে দিতে পারেননি।
জান্নাতির বাবা বলেন, একটি ইনজেকশনের দাম সাত হাজার টাকা। আরেকটির দাম তিন হাজার ৮০০ টাকা। আমি দরিদ্র চা বিক্রেতা। এত টাকা পাব কোথায়? তাই মেয়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে পারিনি। ধার-কর্জ ও ঋণ নিয়ে যত দিন ওষুধ দিতে পেরেছি, তত দিন বেঁচে ছিল। এরপর আর মেয়েকে বাঁচাতে পারিনি। এখন শুধু একটাই দাবি। হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।
বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফয়সাল সরকার বলেন, নরসিংদীতে ফেনীর নুসরাতের মতো আরো একটি ঘটনার জন্ম নিয়েছে। চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলেও থানা পুলিশ মামলা নেয়নি। বাধ্য হয়েই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।
এসব নিয়ে গত ১১ জুন ‘নুসরাতের মতো সৌভাগ্য নেই জান্নাতির পরিবারের’ শিরোনামে এনটিভি অনলাইনে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নজরে আসে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের নতুন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমানের। তাঁর নির্দেশে গত ১৫ জুন মামলা নিতে তৎপর হয় নরসিংদী সদর মডেল থানার পুলিশ। জান্নাতির বাবাকে খুঁজে বের করে থানায় এনে তাঁকে বাদী করে হত্যা মামলা নেয়। এতে অভিযোগ করা হয়, যৌতুকের জন্য জান্নাতিকে নির্যাতন ও মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ত না হওয়ায় তাকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন শাশুড়ি শান্তি বেগম, স্বামী শিপলু ওরফে শিবু, ননদ ফাল্গুনী বেগম ও শ্বশুর হুমায়ুন মিয়া।
মামলার পর পুলিশ পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে আটক করে। এঁরা হলেন শান্তি বেগমের বোন সাথী আক্তার, দেবর নওসের মিয়া, খালা পারুল বেগম, খালাতো ভাই টিউলিপ, মামা রতন মিয়া ও খালাত ভাই জাহাঙ্গীর।