ভাঙ্গায় নির্মম গণহত্যার সাক্ষী জান্দিগ্রাম
ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের জান্দিগ্রামে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা নির্মম গণহত্যায় মেতে উঠেছিল। গণহত্যার বধ্যভূমিটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হানাদাররা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে লুটতরাজ, ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধে যখন পাকিস্তানিরা পর্যুদস্ত হচ্ছিল, তখন নিভৃত পল্লী জান্দিগ্রামে রাজাকার-আলবদরদের সহায়তায় হানাদাররা গোবিন্দ সেনের বাড়িতে হামলা চালায়। তাঁর বাড়িতে আত্মীয় উপেন্দ্র সেন, পল্টু সেনসহ ১০-১২ জন আশ্রয় নিয়েছিলেন। একদিন সকালে এসে রাজাকার ইমদাদুল হক ওরফে ইঙ্গুল কাজী তাদের আশ্বস্ত করেন যে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে ঢুকবে না। গোপনে ইঙ্গুল কাজী অন্য রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ে গ্রামে হানা দেয়।
সেই রাতের কথা স্মরণ করে কাতর হয়ে ওঠেন প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় রেনু বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি তখন গৃহবধূ। মুয়াজ্জিন তখনো ভোরের আজান দেননি। চারদিকে তখন অসম্ভব নিস্তব্ধতা। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সেনবাড়িতে গুলির শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যায়। সবাইকে ঘর থেকে বের করে হিন্দু-মুসলিম নারীদের আলাদা করে নিয়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ চলে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন। সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে দিগ্বিদিক গুলি করতে থাকে। যে যেদিকে, পারে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে।’
মুহূর্তেই মৃত্যু হয় কালিপদ চক্রবর্তী, গোবিন্দ চন্দ্র চক্রবর্তী, জীবন কৃষ্ণ সেন, মঙ্গলচরণ সেন, উপেন্দ্র নাথ সেন, ননী গোপাল সেন, কালাচাঁদ সেন, সোমেশ্বর সেন, পঞ্চানন ধোপা, টনিক সেন, সুধীর সেন, সৃষ্টিধর সেন, বিনয় সেন, নিত্যগোপাল সেন, মধূসুধন সেন, শংকর সেন, মাধব দত্ত, মইদা দত্ত, হীমন্ত দত্ত, ধীরেন দত্ত, সতীশ সাধু, আধ্যাত্মিক হিন্দু গুরু পানা সাধু, সুকেশ সেন, পল্টু সেন, পচা সেন ও অজ্ঞাত আরো ১০-১২ জনের। এ ছাড়া বাঁশঝাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কিছু লাশ পাওয়া যায়। নৃশংসভাবে হত্যার পর যেখানে সেখানে পড়ে থাকে হাত, পা, মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
জান্দিগ্রামের মহুরী মনিরুজ্জামান মিয়া বলেন, ১৯৭১ সালে এখানে যে ধরনের নৃশংসতা ঘটেছিল, তা বর্ণনাতীত। তিনি স্মৃতিচারণা করে বলেন, হায়েনার দলের হাতে অনেক নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। সারা রাত পাশবিক নির্যাতনের পর বাঁশঝাড়ের মধ্যে অনেকেই বিবস্ত্র অবস্থায় অচেতন হয়ে পড়েছিলেন।
বয়োবৃদ্ধ স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘রাজাকার ইঙ্গুল কাজীকে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা সারা রাত নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। গুলির শব্দে আমরা রাতের অন্ধকারে দিগ্বিদিক পালিয়ে যাই।
সকালে দেখি সুনীল দত্তের বাড়িতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ৪০-৫০টি বীভৎস লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। নারীরা সম্ভ্রম হারিয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আমরা পরে লাশগুলো একত্রে করে গণকবর দিই।’
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রব মিয়া বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে ঢুকে রাজাকারদের সহায়তায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে গিয়ে নারী-পুরুষদের বের করে নারকীয় উল্লাসের পর এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। আমরা তখন দূর থেকে ছছক্ষেতের মধ্যে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করি। পরে এসে দেখি বীভৎস লাশ আর লাশ। আমিসহ পার্শ্ববর্তী গঙ্গধরদী গ্রামের সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা আইয়ুব আলী, পুলিশ সদস্য তাজেলসহ কয়েকজন মিলে ৪০-৪৫টি লাশ গণকবর দেই। পরে আইয়ুব আলী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে ভুরঘাটা সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।’
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সুনীল দত্তের বাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও। পাশেই গণকবরটি অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ঘরটি ২০১৪ সালে পর্যন্ত ছিল। পরে সুনীল দত্তের পরিবার দেশান্তর হয়ে যাওয়ায় সবই অতীত হয়ে গেছে। পাশেই রয়েছে পানা সাধুর ভিটা। এখানে হিজলগাছগুলো এখনো রয়েছে।
তুজারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ রশিদ নান্নু মিয়া বলেন, ‘বধ্যভূমিটি অযত্ন-অবহেলায় রয়েছে। আমি উদ্যোগ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সহায়তায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছি।’
ভাঙ্গা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল বাশার মাতুব্বর বলেন, ‘এত বড় একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল অথচ বধ্যভূমিটি চরম অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা সত্যিই চরম লজ্জার।’