বাংলাদেশের বজরঙ্গি ভাইজান জামাল ‘মনুষ্যত্বের পরিচায়ক’
বাংলাদেশের বজরঙ্গি ভাইজান হিসেবে খ্যাত জামাল ইবনে মুছাকে ‘মনুষ্যত্বের পরিচায়ক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন বরগুনার একটি আদালত। সে সঙ্গে পাচারকারী চক্রের দায়ের করা মিথ্য মামলা থেকে জামাল ও তাঁর ১৪ স্বজনকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে।
জামাল ইবনে মুছা ও তাঁর ১৪ স্বজনের বিরুদ্ধে বরগুনার বেতাগী উপজেলার গেরামর্দন গ্রামের হাসি বেগমের দায়ের করা মামলার (নম্বর ৯৮/২০১৬) শুনানি শেষে গত মঙ্গলবার বরগুনার নির্বাহী বিচারিক আদালতের বিচারক মো. সাজেদুল ইসলাম এ রায় দেন। আজ শনিবার রায়ের কপি প্রকাশিত হয়। সেখানেই দেখা যায়, জামাল ইবনে মুছাকে মনুষ্যত্বের পরিচায়ক বলে আখ্যা দিয়েছেন আদালত।
রায়ে বলা হয়, ‘দুই পক্ষের আইনজীবীগণের দাখিলকৃত নথিপত্র এবং সাক্ষ্য প্রমাণ পর্যালোচনায় এ কথা স্পষ্ট যে জামাল ইবনে মুছার মানবহিতৈষী কর্মকাণ্ড এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্থাপিত নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত তাঁকে প্রকৃত একজন মানুষের মর্যাদা দিয়েছে। এ রকম সুবিবেচক, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন একজন মানুষের পক্ষে বাদী কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকাকে অত্র আদালত অযৌক্তিক মনে করছেন।’
রায়ে আরো বলা হয়, ‘বাদী কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগের সঙ্গে বিবাদীগণের সংশ্লিষ্টতাকে অযৌক্তিক এবং হয়রানিমূলক বিবেচনা করে অত্র আদালত সকল বিবাদীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিচ্ছেন।’
এ মামলার পাশাপাশি হাসি বেগম ও তার সহযোগীদের দায়ের করা আরো একাধিক মিথ্যা মামলা থেকে এরই মধ্যে অব্যাহতি পেয়েছেন জামাল ইবনে মুছা। এ ছাড়া একই চক্রের দায়ের করা আরো চারটি মামলা রয়েছে জামাল ও তাঁর স্বজনদের বিরুদ্ধে। সেসব মামলায়ও হাজিরা দিতে এবং মামলার খরচ চালাতে এখন নিঃস্ব প্রায় বাংলার বজরঙ্গি ভাইজান ওরফে জামাল।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে পাচারকারীর কবলে পড়ে বরগুনার গ্রামে বন্দি থাকা শিশু অভিরূপ সনুকে (১১) তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়ে মানবিকতার অনন্য এক উদাহরণ তৈরি করেন জামাল। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসিত হন বরগুনার এই বাসিন্দা। বলিউডের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-এর কাহিনী ও ঘটনার সঙ্গে মিল থাকায় নায়ক সালমান খানের সঙ্গে তুলনা করে জামাল ইবনে মুছাকেও আখ্যা দেওয়া হয় বাংলাদেশের বজরঙ্গি ভাইজান হিসেবে।
শিশু সনুকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে সেই ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বছর জামাল বিন মুছাকে লড়তে হয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী এক পাচারকারী চক্রের সঙ্গে। শিশু সনু হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় রুষ্ট ওই কুচক্রী মহলের দায়ের করা একের পর এক মিথ্যা মামলায় দিশেহারা হয়ে পড়েন জামাল ও তাঁর স্বজনরা। জামালের কারণে শিশু সনুকে ভারত থেকে অপহরণ করে পাচার করে আনা পাচারকারী চক্রের নাম-পরিচয় প্রকাশ হয়ে যায়। শুধু ভারত থেকে পাচারই নয়, ওই পাচারকারী চক্রটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে একাধিক নারী ও শিশুকে ভারতে পাচারের অভিযোগও রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বরগুনার বেতাগী উপজেলার প্রত্যন্ত গেরামর্দন গ্রামে আস্তানা গেড়ে থাকা ওই পাচারকারী চক্রের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
মিথ্যা মামলা আর হয়রানি থেকে রেহাই পেতে বরগুনা জেলা পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছেন জামাল ইবনে মুছা। তিনি বলেন, ‘আপনার-আমার সকলেরই সন্তান রয়েছে। তেমনি এক ছোট্ট শিশুকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পাচারকারীচক্রের দায়ের করা একের পর এক মিথ্যা মামলায় কত না হয়রানি হয়েছি। ছেলেসন্তান আর স্বজনসহ জেল খেটেছি আমি। অথচ অতটুকু নিষ্পাপ একটি শিশুকে যে বা যারা অপহরণ করে মুক্তিপণ চাইল, পাচার করে আনল বাংলাদেশে, সেই পাচারকারী চক্রকে শনাক্ত করতে পুলিশের কি কিছুই করার ছিল না?’
জামাল ইবনে মুছা আরো বলেন, সত্যকে মিথ্যা দিয়ে যতই চেপে রাখা হোক না কেন, তা একদিন প্রকাশ পাবেই। এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা একই পাচারকারী চক্রের তিনটি মিথ্যা মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। পুলিশ যদি নিরপেক্ষ তদন্ত রিপোর্ট দেয়, তবে সব মামলা থেকেই তিনি অব্যাহতি পাবেন এবং পক্ষান্তরে আদালত পাচারকারী চক্রের মূল হোতা হাসি বেগম ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই ব্যবস্থা নেবেন বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন।
এদিকে গেরামর্দন গ্রামের স্থানীয় অধিবাসী পরিভানু (৪৫) অভিযোগ করে বলেন, তাঁর ছেলে হাসিবকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে হাসি বেগম আজ থেকে চার বছর আগে ভারত নিয়ে গেছে। সেই থেকে আর কোনো খবর নেই তাঁর ছেলের।
একই গ্রামের অধিবাসী জুয়েল মিয়ার দাবি, হাসি বেগম ও তার ছয় বোনের সবাই পাচারকারী চক্রের সদস্য। তারা সবাই ভারতে যাওয়া-আসা করে। সেখানে তারা দীর্ঘদিন ধরে ডলার ব্যবসাসহ নানা রকমের প্রতরণামূলক ব্যবসা চালিয়ে আসছে বলে তিনি জানান।
অভিযুক্ত হাসি বেগমের ছোট বোন রহিমার প্রাক্তন স্বামী মিরাজ (৩০) বলেন, রহিমা বেগম তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করে ব্যবসার কথা বলে তাঁকে ভারত নিয়ে যায়। পরে ভারত নিয়ে রহিমাকে বিয়ে করতে তাঁকে বাধ্য করা হয়। বিয়ের পর তাঁকে (মিরাজ) বিভিন্ন প্রতারণামূলক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য করে রহিমা ও তার সহযোগীরা। মিরাজ আরো জানান, পরে নানা রকম কৌশল করে ভারত থেকে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
এত অভিযোগ, তার পরও বরগুনার বেতাগী উপজেলার প্রত্যন্ত গেরামর্দন গ্রামে আস্তা গেড়ে থাকা ওই পাচারকারী চক্রের কাউকেই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
এ বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক জানান, শিশু সনুর বাংলাদেশে আসার ঘটনার মধ্য দিয়ে জানা যায় যে বেতাগী উপজেলার গেরামর্দন গ্রামে একটি পাচারকারী চক্র রয়েছে। এ বিষয়ে যথাযথ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।