উন্নয়নের ছোঁয়া লাগছে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/05/14/photo-1431602729.jpg)
১৮০৭ থেকে ১৮১২ সালের মধ্যে কোনো এক সময় পূর্ব ভারতে জরিপ করতে এসে বর্তমান নওগাঁ পরিদর্শন করেন ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক বুকানন হ্যামিলটন। সেখানে পাহাড়পুরের একটি স্তূপকে বৌদ্ধ বিহার বলে অনুমান করেন তিনি। পরে ১৯২৩ সালে এখানে খননকাজ শুরু হয়। খনন শেষে পাওয়া একটি মাটির সিলমোহর থেকে জানা যায় এটি বৌদ্ধদের সোমপুর বিহার।
পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল (৭৮১-৮৮১) অষ্টম শতকের শেষ দিকে নওগাঁয় নির্মাণ করান এই সোমপুর বৌদ্ধ বিহার। মোট ২৭ একর জমির ওপর সোমপুর বিহার অবস্থিত। বিহারের আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট। পাহাড়পুর বিহারের ভিত্তি বেদীতে ৬৩টি হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি সংস্থাপিত আছে। এ ছাড়া মন্দিরের দেয়ালে প্রায় দুই হাজারটি পোড়া মাটির ফলক আছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য এখানে আছে ১৭৭টি কক্ষ। মোট ৮০০ জন ভিক্ষু বাস করতে পারতেন এই বিহারে।
সোমপুর বিহারের মূল ইমারতের নির্মাণ কৌশল অনেক উন্নত স্থাপত্য কলার ইঙ্গিত দেয়। মূল বিহারের উচ্চতা প্রায় ৭০ ফুট। পিরামিড আকৃতির বিহারের সব কিছু সংযোজিত হয়ে একটি চতুস্কোণ কক্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
পাল রাজাদের প্রতিষ্ঠিত বিহারটি প্রথমে বৌদ্ধ সন্নাসীদের আবাসস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরে বিহারটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র গিসেবে রূপান্তরিত হয়। বিহারটি জ্ঞান সাধনা, আরাধনা ও জ্ঞান বিস্তারে সে সময় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। বিহারটি খননকালে ১২৫ নম্বর কক্ষটিতে একটি মাটির পাত্রে খলিফা হারুন-অর-রশীদের আমলের রৌপ্যমুদ্রাও পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় কোনো সাধক বা ধর্ম প্রচারক মুদ্রাগুলো সোমপুর বিহারে এনেছিলেন।
মনোমুগ্ধকর, নান্দনিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের (ওয়াল্ড হেরিটেজ) অন্তর্ভুক্ত হলেও দীর্ঘদিন সেখানে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি। তবে দুই বছর আগে এখানে শুরু হয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বৌদ্ধ বিহার সংরক্ষণের কাজ।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ কাজের দায়িত্ব পালনরত উপসহকারী প্রকৌশলী মো. নাজমুল হুসাইন জানান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে সাউথ এশিয়ান ট্যুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় দুই ভাগে মোট ১৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকার উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে কাঠামোগত উন্নয়ন কাজ আট কোটি ৮৬ লাখ টাকার আর মূল বৌদ্ধ বিহারের সংরক্ষণে কাজ চলছে চার কোটি ৫০ লাখ টাকার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্যে এখন চলছে চারদিকে সীমানা প্রাচীর, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে প্রবেশ পথ, দর্শনার্থীদের জন্য টয়লেট কমপ্লেক্স, মসজিদ, গাড়ি পার্কিং এলাকা, দর্শনার্থীদের পুরো বিহার ঘুরে দেখার জন্য হাঁটার পথ, ভরাট পুকুর পুনঃখনন, আনসারদের জন্য ছাউনি নির্মাণ, স্টাফ কোয়ার্টার ও অফিসার্স কোয়াটারের নির্মাণকাজ।
অন্যদিকে, চার কোটি ৫০ লাখ টাকায় মূল বৌদ্ধ বিহারের সংরক্ষণ কাজের মধ্যে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার দূরীকরণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, মূল বিহারের গায়ে জন্মানো ঘাস তুলে ফেলে চুন, সুরকি দিয়ে নতুন করে গাঁথুনি, বন্ধ হয়ে যাওয়া কূপ পুনঃখনন, কূপের চারিদিতে রেলিং দিয়ে ঘিরে দেওয়ার কাজ এখন চলমান।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা জানান, সাউথ এশিয়ান ট্যুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে (সোমপুর বিহার) পর্যটকদের সুবিধার্থে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এগুলোর কাজ চলছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এই বিহার আরো সমৃদ্ধ হবে। সেইসঙ্গে বাড়বে দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের ভিড়।
ইতিহাস বলছে, বিহারের পূর্ব-দক্ষিণ কোণায় প্রাচিরের বাইরে একটি বাঁধানো ঘাট আছে। একে সন্ধ্যাবতীর ঘাট বলা হয়। কথিত আছে, মৈদলন রাজার কন্যা সন্ধ্যাবতী এই ঘাটে স্নান করতেন। একদিন তিনি ভেসে যাওয়া একটি জবা ফুলের ঘ্রাণ গ্রহণ করার পর গর্ববতী হন এবং কুমারী অবস্থায় এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। ওই সন্তান ‘সত্যপীর’ নামে পরিচিত।
পাহাড়পুরে বৌদ্ধ বিহারে বিহারের আকৃতিতে একটি জাদুঘর ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে সোমপুর বিহার খননকালে পাওয়া বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন প্রদর্শনীর জন্য রাখা আছে। যা দেখতে রোজ ভিড় জমান হাজারো দর্শনার্থী।