সাইবার নিরাপত্তা বিল সংসদে উত্থাপন, জাপার আপত্তি
‘সাইবার নিরাপত্তা বিল-২০২৩’ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। এরপর বিলটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঁচ দিন সময় বেঁধে দিয়ে সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়। আজ মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বিলটি সংসদে তোলেন।
বিলটি উত্থাপনের শুরুতেই জাতীয় পার্টির সদস্য ফখরুল ইমাম আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘অংশীজনরা এই বিলের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত আইনের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। প্রস্তাবিত আইনকে টিআইবি কালো আইন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের মৌলিক অধিকার যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বন্ধের উপাদান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল, খসড়া আইনেও রাখা হয়েছে। অনেকেই এই খসড়া আইনকে নিবর্তনমূলক বলে মনে করছেন।’
জবাবে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘ডিজিটাল সেবা বৃদ্ধির পাশাপাশি সাইবার জগতে ঝুঁকিও বাড়ছে। সাইবার অপরাধগুলো এত বেশি মারাত্মক, এত বেশি জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, অর্থ ও উপাত্ত সংরক্ষণের জন্য এটা বেশি প্রয়োজন। যার ফলে ২০১৮ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রণয়ন করা হয়।’
প্রতিমন্ত্রী পলক বলেন, ‘বর্তমান প্রয়োজন, সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টার পরামর্শে, প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা, আইনমন্ত্রী সময়ে সময়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, জাতীয় পর্যায়ের সংবাদ মাধ্যম, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার সংস্থা, সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সাইবার সিকিউরিটি আইনটি উত্থাপন করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে যেগুলো অজামিনযোগ্য ছিল সেখানে জামিন যোগ্য করা হয়েছে। চারটি ধারা শুধু অজামিন যোগ্য হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে।’ আইনটিকে উদার ও ভবিষ্যতমুখী বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বিলের ৪২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন যে, কোনো স্থানে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে সাক্ষ্য প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন হওয়ার বা করার সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে তার, কোন পরোয়ানা ছাড়াই সেখানে তল্লাশি, সরঞ্জাম জব্দ, দেহ তল্লাশি, এবং পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তারের এখতিয়ার রয়েছে। এই ধারাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ছিল।
বিলের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা হবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা ১০ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
বিলের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এ রূপ কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে, তাহলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। বিদ্যমান আইনে এই অপরাধের সাজা সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড রয়েছে।
বিলের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে সেজন্য ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই ধারা নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যাপক আপত্তি রয়েছে।
সাংবাদিক নেতারা বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধিতে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একই অপরাধের বিচার এই আইনের মধ্যে যুক্ত করার কারণে সাংবাদিকদের পেশাগত কাজে হয়রানির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বিলের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এইরূপ কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক বল সম্প্রীতি বিনষ্ট করে যা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা এমন ঘটনা ঘটার উপক্রম হয়, তাহলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হবে একটি অপরাধ। এর সাজা সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
বিলের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তিনি অনধিক ৭ (সাত) বছরের কারাদণ্ডে, বা অনধিক ২৫ (পঁচিশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ১৪টি ধারার মধ্যে ১৮ (১) (খ), ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৪৬ ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। অজামিনযোগ্য চারটি ধারা হলো ১৭, ১৯, ২৭ ও ৩৩। নতুন করে জামিনযোগ্য করা ২১ ধারায় সাজা কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। তবে অর্থদণ্ড সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা আগের মতোই রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই ধারায় সাজা ছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। এছাড়া ৩০ ধারায় আইনবহির্ভূতভাবে ‘ই-ট্রানজেকশন’ (ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে লেনদেন) সংক্রান্ত অপরাধ ও সাজার কথা বলা আছে।
প্রস্তাবিত আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ছিল ছয়টি। এখন দুটি ধারা নতুন করে জামিনযোগ্য করায় অজামিনযোগ্য ধারা রয়েছে চারটি। এর মধ্যে ১৭ ধারায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশ সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের কথা রয়েছে। ১৯ ধারায় কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতিসাধন, ২৭ ধারায় সাইবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ৩৩ ধারায় হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধের কথা বলা হয়েছে।
এর আগে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকার জাতীয় সংসদে সরকার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করেছিল। শুরু থেকেই এই আইন নিয়ে সাংবাদিকদের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও এই আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে বেশ কয়েকবার আপত্তি তোলা হয়েছিল। দেশ–বিদেশে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে সাইবার নিরাপত্তা আইন করতে যাচ্ছে। যদিও ডিজিটাল আইনের বেশির ভাগ ধারার বিষয়বস্তু অনেকটা অবিকৃতভাবে প্রস্তাবিত আইনে রেখে দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তন বলতে জামিনযোগ্য ধারা বেড়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত হলেও এই আইনে করা মামলাগুলোর বিচার নতুন আইনে হবে না, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই হবে।