টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না পুলিশের গুলিতে দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হারানো মবিনের
পারিবারিক পিছুটানকে উপেক্ষা করে দোকান কর্মচারী মবিন মাল (১৭) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার উত্তরায় মিছিলে যোগ দেন। মিছিলে পুলিশের গুলিতে দৃষ্টিশক্তিসহ এক কানের শ্রবণশক্তি হারায় মবিন। প্রতিবন্ধি এক ভাইকে রেখে পাঁচ মাস আগে মারা গেছে তার বাবা। মবিন দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলায় তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব মবিনের পরিবার। চিকিৎসক জানিয়েছে, অপারেশন করলে দৃষ্টিশক্তি হয়তো ফিরে পাওয়া যেতে পারে। আর এতে খরচ করতে হবে তিন থেকে চার লাখ টাকা।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্রদের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেই এখন হয়ে পড়েছেন অসহায়। দেশবাসীর কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন নিজের চিকিৎসার। এই টাকা না হলে মবিনের পরিবারকে পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
শনিবার (১৭ আগস্ট) শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার সিধলকুড়া ইউনিয়নের বড় শিধলকুড়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় মবিনের পরিবারের সঙ্গে। মবিনের পরিবার এনটিভি অনলাইনকে এসব কথা জানান।
মনিবের পরিবার জানায়, প্রতিবন্ধী ছেলে জুলহাসসহ তিন ছেলেকে রেখে পাঁচ মাস আগে মারা যায় মবিনের বাবা মোফাজ্জল হোসেন মাল। এরপর মবিনের মা নাজমা বেগমের পক্ষে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়াও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। স্বজনদের পরামর্শে বড় ছেলে নাজমুল হুদা পলাশকে ড্রাইভারের চাকরি ও মবিনকে ঢাকার উত্তরার একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজে দেন। খেয়ে না খেয়ে বেশ চলছিল প্রতিবন্ধী ভাই জুলহাস, মা নাজমা বেগম ও মবিনের সংসার।
গত ১৮ জুলাই প্রতিদিনের মতো মবিন উত্তরার রাজলক্ষ্মীর পাশে তিন নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর সড়কের ২৭ নম্বর প্লটে লতিফ এম্পোরিয়ামের মো. ওয়াসিম তালুকদারের কম্পিউটারের দোকানে কাজে যায়। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। পারিবারিক পিছুটানসহ সব কিছু ভুলে মবিন দোকান বন্ধ করে মিছিলে যোগ দেয়। এরপর মিছিলটি যখন উত্তরা থানার দিকে যায়, তখন থানার ভেতর থেকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে পুলিশ।
পুলিশের ছোড়া ছড়ড়া গুলি এসে লাগে মবিনের চোখসহ মাথা ও কানে। মিছিলকারীরা মবিনকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পরিবারের সদস্যরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করান। সেখানে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করলেও এখনো মবিনের মাথায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। টাকার অভাবে হাসপাতালে যেতে না পারায় এখন সে বাড়িতেই আছে।
দৃষ্টিশক্তিসহ এক কানের শ্রবণশক্তি হারানো মো. মবিন মাল বলেন, প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকালে কাজের জন্য দোকানে যাই। দোকানে যাওয়ার একটু পরেই আন্দোলনের মিছিল বের হয়। তখন দোকান বন্ধ করে ছাত্রদের সঙ্গে মিছিলে যাই। মিছিলটি উত্তরা থানার সামনে গেলে পুলিশ গুলি করতে থাকে। গুলি এসে আমার কান ও চোখে লাগে। মিছিলের সাথীরা আমাকে প্রথমে কুয়েতমৈত্রী হাসপাতাল নিয়ে যায়। এরপর সেখান থেকে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতাল হয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে। আমার দৃষ্টিসহ শ্রবণশক্তি ফিরে পেতে আমি আন্দোলনকারীসহ দেশবাসীর সহযোগিতা চাই। নয়তো আমার মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে আমি অনেক বিপদে পড়ব।
মবিনের বড় ভাই নাজমুল হুদা পলাশ বলেন, বাবার মৃত্যুর পর ১৫ হাজার টাকা বেতনে এক মালিকের গাড়ি চালাই। ঘটনার দিন আমি বাড়িতেই ছিলাম। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমার মোবাইলফোনে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে কল আসে। জানতে চায়, আমি মবিনের বড় ভাই কি না? আমি তাকে হ্যাঁ বলতেই তিনি আমাকে জানান, দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চলে আসুন। আপনার ভাই মবিন পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে আছে।
এরপর আমি দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে মবিনকে খুঁজে পাই। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। নিজেদের সব কিছু মিলিয়ে থাকা এক লাখ ২০ হাজার টাকার বেশি আমরা খরচ করেছি। এখন ভিটে মাটি ছাড়া আর কিছুই নেই।
পলাশ বলেন, আমার ভাই শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি ফিরে না পেলে এক প্রতিবন্ধী ভাইয়ের সঙ্গে মবিনও পরিবারের বোঝা হয়ে যাবে। ডাক্তার বলেছে তিন থেকে চার লাখ টাকা হলে ভাই আমার পুরো সুস্থ হয়ে যাবে। আমি আন্দোলনকারী, দেশবাসী ও সরকারের নিকট সহযোগিতা চাই। আপনারা সবাই আমার ভাইয়ের জন্য এগিয়ে আসুন।