ইয়ামিন হত্যায় শেখ হাসিনাসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তা বিরুদ্ধে মামলা
সাভারে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনকে গুলি করে হত্যায় অবশেষে মামলা গ্রহণ করেছে মডেল থানা পুলিশ। এতে আসামি করা হয়েছে গুলির নির্দেশদাতা তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার শেখ হাসিনা, সাবেক আইজিপিকেও।
আজ সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) সকালে নিহত ইয়ামিনের মামা আব্দুল্লাহ আল কাবির বাদী হয়ে এই মামলা করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিকুর রহমান।
শেখ হাসিনাসহ মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন—সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহহিল কাফি, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলাম, সাভার মডেল থানার সাবেক ওসি শাহ জামান, উপপরিদর্শক (এসআই) সুদীপ কুমার গোপ, আমিনবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই হারুন অর রশিদ ও এসআই সাব্বির আহাম্মেদ।
মামলায় আসামির তালিকায় আরও রয়েছেন সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজিব, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখরুল আলম সমর, তাঁর মামা কুটি মোল্লা, ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্পাদক ও ভাকুর্তা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের কথিত ভাগ্নে, রাজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন ওরফে ট্যাপা জাকির, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক, সহসভাপতি নিজামউদ্দিন টিপু, সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাজাহারুল ইসলাম রুবেল, সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুল গনি, তাঁর ছেলে আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক হাসান তুহিন, কামরুল হাসান শাহীন, মেহেদী হাসান তুষার, আওয়ামী লীগনেতা ও বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সুজন, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনজুরুল আলম রাজীবের একান্ত সহকারী মো. রাজু, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাসুদ চৌধুরী, সাভার পৌর সভার ৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নুরে আলম নিউটন, ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মানিক মোল্লা, ব্যাংক কলোনি ছাপড়া মসজিদ এলাকার তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে রাজীব মাহমুদ, তার ভাই সাবেক ছাত্রলীগনেতা আহাম্মেদ রুবেল, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ও বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম মণ্ডল, ঢাকা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিজান ওরফে জি এস মিজান, সাভার পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির আহমেদ লিটন, নাছির উদ্দিন লিটন, তার ভাগ্নে সাভার কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইয়াকিন ইয়াছার, সাভার পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আতাউর রহমান অভি, যুবলীগনেতা ফয়সাল নাইম তুর্যসহ অজ্ঞাতপরিচয় অনেকে।
গত ২৫ আগস্ট ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলামের আদালতে মামলার আবেদন করেন নিহত ইয়ামিনের মামা আব্দুল্লাহ আল কাবির। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে সাভার থানাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। বাদীপক্ষে মামলা আবেদন করেন অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান মারুফ ও সাকিল আহমাদ।
সাভার মডেল থানায় এটি নিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলা করা হলো।
নিহত শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন ছিলেন এমআইএসটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই দুপুরে সাভারে প্রথম শহীদ হন তিনি।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা পয়েন্টে আন্দোলনরত এমআইএসটির শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনকে খুব কাছ থেকে গুলি চালায় পুলিশ। পরে গুলিবিদ্ধ ইয়ামিনকে সাঁজায়ো যানে ঘোরানো পর ফেলে দেওয়া হয় সড়কে। একপর্যায়ে পুলিশের দুই সদস্য বস্তা ফেলার মতো করে এক সড়কের এক লেন থেকে অন্য লেনে ফেলে দেন ইয়ামিনের দেহ। সেই ভিডিও চিত্র পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তা প্রকাশিত হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও।
ইউনিট কমান্ডার হিসেবে এ ঘটনায় নিজে নেতৃত্ব এবং উপস্থিত থেকে গুলি চালানোর হুকুম দিয়েছিলেন পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফি। তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের ছেলে সাফি মোদ্দাসের খান জ্যোতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত ও ২৯ ব্যাচের কর্মকর্তা। তাঁর বাড়ি সিরাজগঞ্জে।
আব্দুল্লাহিল কাফির নেতৃত্বেই ছাত্র জনতার মিছিলে গুলি চালানো হয়—পুলিশ সদর দপ্তর গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে এমন তথ্যই জানিয়েছেন সে সময় দায়িত্বে থাকা পুলিশের জুনিয়র কর্মকর্তারা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, দরজা খুলে সাঁজোয়া যানের ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন দুই পুলিশ সদস্য। পরে তাঁরা ওই সাঁজোয়া যানের উপর থেকে ইয়ামিনকে ফেলে দেন। এরপর তাঁকে টেনে হিঁচড়ে সড়কের এক পাশ থেকে ফেলে দেন অন্য পাশে। তখনও নড়াচড়া করছিলেন ইয়ামিন। ভিডিও চিত্রের এমন দৃশ্যে স্তম্ভিত হয়ে যান অনেকে। ওই সাঁজোয়া যানের পেছনে সশস্ত্র অবস্থায় দেখা যায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মীকেও।
গত ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাভারে পুলিশের গুলিতে মারা যায় কমপক্ষে ৭৫ জন। গুলিবিদ্ধ হয় চার শতাধিক। এদের মধ্যে অসংখ্য মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, অন্ধ হয়েছে অনেকে।