পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় মেয়ের মৃত্যু, ১২ বছরেও বিচার পাননি বাবা-মা
মেয়ের শোকে পরিবারের সবাই কাঁদছেন ১২ বছর ধরে। সুস্থ সবল কিশোরী মেয়েকে গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে পুলিশ কর্মকর্তার ঢাকার বাসায় কাজে দিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক মাস পর তার মরদেহ আসে বাড়িতে। দীর্ঘ ১২ বছর পরও তারা জানতে পারেননি কী কারণে মীনার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর লাশও দেখতে দেওয়া হয়নি। চেয়ারম্যান নিজে থেকে লাশ দাফন করেন খুব ভোরে। পুলিশের ভয়ে তখন কোন প্রতিবাদ করতে পারেননি। নীরবে কেঁদে চলেছেন ১২ বছর ধরে। এখন তারা কিশোরী মেয়ের হত্যার বিচার চান।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী ইউনিয়নের রাড়ুলী (বাগপাড়া) গ্রামের ভ্যানচালক হামিদ শেখ ও তার স্ত্রী মরিয়ম দম্পতির তিন মেয়ে আর এক ছেলে। অভাবের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে পুলিশ অফিসার তরিকুলের ঢাকার বাসায় কাজের জন্য দুই মেয়েকে পাঠান। কিন্তু কয়েক মাস পরে কিশোরীকন্যা মীনা লাশ হয়ে বাড়ি ফেরে। সেই সময় চেয়ারম্যানের ছেলে পুলিশ কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম উজ্জ্বল তখন এএসপি পদমর্যদায় এসএসএফে কর্মরত ছিলেন। থাকতেন ঢাকার ন্যাম ফ্ল্যাটে।
মৃত্যুর খবর গোপন রেখে মেয়ের ডায়রিয়া হয়েছে বলে গ্রাম থেকে মা–বাবাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। পিস্তল দেখিয়ে ও পুলিশের মারধর করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে মেয়ের কফিনে জড়ানো লাশ দেওয়া হয়। তাদের জানানো হয় মীনা আত্মহত্যা করেছে। রাতে বিশেষ ব্যবস্থায় লাশ পাইকগাছা এনে ফজরের নামাজের পর পুলিশ প্রহরায় দাফন করা হয়।
কিশোরী মীনার বাবা ভ্যানচালক হামিদ শেখ কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, তার মেয়ের কী কারণে মৃত্যু হলো তা আজও জানেন না। এতদিন প্রকাশ্যে কান্না করতে পারেননি চেয়ারম্যানের ভয়ে। চেয়ারম্যান অনেক আশ্বাস দিলেও কিছুই করেনি। তারা আজ তার কিশোরী মেয়ের হত্যার কারণ জানতে চান। বিচার চান তার মেয়ে হত্যার। তাদের মিথ্যা কথা বলে ঢাকায় ডেকে নিয়ে একটি ঘরে আটক রেখে সাদা কাগজে সই নেওয়া হয়। মীনা কোথায়? তাকে দেখব বলে তার স্ত্রী মরিয়ম কান্না করলে এক পুলিশ সদস্য পিস্তল দিয়ে তার স্ত্রীর মাথায় আঘাত করে। পিস্তল ঠেকিয়ে বলে কোনো কথা বললে গুলি করে দিব। এই সময় তার আর এক কন্যা রীনা পুলিশ কর্মকর্তার বোনের বাড়িতে থাকলেও তাকেও আসতে দেওয়া হয়নি।
মীনার মা মরিয়ম কান্নাজড়িত কণ্ঠে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, গত ১২ বছর ধরে নীরবে কান্না করেছি। কবরের কাছে গেলে চেয়ারম্যানের বাহিনী হুমকি দিত। তারা বলত মীনার কাছে পাঠিয়ে দিব। মীনার হত্যার বিচার চাই।
নিহত মীনার বোন রীনা জানান, ঢাকায় অন্য বাসায় কাজ করলেও তাকে মীনার মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়নি। বলেছে তোমার বাবা–মা ঢাকায় এসেছে, তাদের জন্য রান্না করে খাওয়াতে হবে। কিন্তু মা আর বাবা তাদের বাসায় যাওয়ার পর সে জানতে পারে, তার বোন মীনা আর নেই।
মামলাতো দূরের কথা মেয়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোন কথা বললেই চেয়ারম্যান আর তার ছেলে পুলিশ কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম হুমকি দিতেন বলে অভিযোগ করেন মেয়েহারা এই দম্পতি। তারা আরও বলেন, স্থানীয় সাংবাদিক ও এলাকাবাসী সবাই জানে, ১২ বছর আগে ফজরের নামাজের পর চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে থেকে খবর খুঁড়েছে। ভোরে জানাজার পর দাফন হয় কিন্তু কেউ লাশ দেখতে পারেনি।
বর্তমানে নাটোর জেলার পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম নাটোরে একটি হত্যা মামলার আসামি হয়ে খুলনা রেঞ্জে ওএসডি হিসেবে আছেন। খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি মো. রেজাউল হক বিষয়টি স্বীকার করলেও কোনো সাক্ষাত দিতে কিংবা কথা বলতে রাজি হননি।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলামের বাবা রাড়ুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ নিজেও একটি হত্যা মামলার আসামি। তবে দীর্ঘদিন ধরে সেটি উচ্চ আদালত স্টে করে রেখেছেন। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান হন। পরে চেয়ারম্যান হত্যা হলে সেই থেকে তিনি চেয়ারম্যান। সেই চেয়ারম্যান হত্যাকাণ্ডে তিনি আসামি হয়ে পলাতক হলে উচ্চআদালত মামলা স্টে করে রেখেছেন।
চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, মীনা প্রেম করে বিয়ে করতে না পারায় আত্মহত্যা করেছিল।
এলাকাবাসীর দাবি, এক যুগ আগে এসএসএফে কর্মরত সহকারী পুলিশ সুপারের বাসায় মীনা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হওয়া উচিত। দোষীদের বিচারের আওতায় আনা গেলে মীনার মা-বাবার পরিবার শান্তি পাবে।