ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলা, ঢাকায় প্রতিবাদ
ফিলিস্তিন ও লেবাননে ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত রয়েছে। বর্বর এই হামলার প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকায় আজ শুক্রবার (১ নভেম্বর) সকালে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশের উদ্যোগে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মিলনায়তনে এই আলোচনা সভা হয়। আলোচনার শুরুতেই ফিলিস্তিনবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র দেখোনো হয়।
‘মহান নেতা ইসমাঈল হানিয়া, সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ও ইয়াহিয়া ইবরাহীম হাসান আস সিনওয়ারসহ শীর্ষ নেতারা শাহাদাত ও গাজা-ফিলিস্তিন কেন্দ্রিক প্রতিরোধ অক্ষের অর্জন’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান ও আল কুদস কমিটি বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ড. শাহ্ কাউসার মুস্তাফা আবুলউলায়ী এতে সভাপতিত্ব করেন। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইরানের আল মুস্তফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন শাহাবুদ্দীন মাশায়েখী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক ড. আহমদ আব্দুল কাদের, দৈনিক আজকের ভোলা সম্পাদক অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ শওকাত হোসেন, ইসলামী শিক্ষা উন্নয়ন পরিষদ বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যক্ষ ড. এ কে এম মাহবুবুর রহমান। সভায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক জনাব জামাল উদ্দিন বারী। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
শাহাবুদ্দীন মাশায়েখ বলেন, ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে যায়নবাদী ইসরায়েল ফিলিস্তিনের জনসাধারণের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে এবং তাদের ভূখণ্ড জবরদখল করে যাচ্ছে। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পরাজয়ের পর প্রথমে মিশর ও জর্ডান এবং এরপর আরব বিশ্বের দেশগুলো ইসরায়েলমুখী হয়ে পড়ে। কিন্তু গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। যেখানে আরব বিশ্ব মাত্র কয়েক দিনে পরাজিত হয়েছিল সেখানে ফিলিস্তিনের যোদ্ধারা মাসের পর মাস তাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের পাশে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুথি, ইরাকের প্রতিরোধ যোদ্ধারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। আর ইরান সরাসরি ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণের মাধ্যমে ইসরায়েলকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। এসব আক্রমণে ইসরায়েলের সামরিক শক্তি ও তাদের তথাকথিত শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্সের দুর্বলতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মোকাবিলায় ইসরায়েলের অর্থনীতিতে চরম ধস নেমেছে। প্রবৃদ্ধির হার নিম্নগামী হয়ে পড়েছে। সামরিক ব্যয় মেটাতে তাদের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কে ইহুদিরা ইসরায়েল ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে।
শাহাবুদ্দীন মাশায়েখ আরও বলেন, কিছু কিছু দেশ মৌখিকভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার কথা বলে ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ইসরায়েল ও তার দোসরদেরকে নিজেদের ভূমি ব্যবহার করে ফিলিস্তিন ও প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য সংগ্রামরত দেশগুলোতে আক্রমণের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। এরকম কপটতা পরিহার করে যদি সত্যিকার অর্থে মুসলমানরা একতাবদ্ধ হয়ে যায়নবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাহলেই মুসলমানরা সফল হতে পারে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব প্রফেসর ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, গত বছরের অক্টোবর মাসের আগে আরব বিশ্বের পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়েছিল যে, কতিপয় আরব দেশ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার চিন্তা করতে থাকে। কিন্তু অক্টোবর মাসের যুদ্ধ সব হিসাব-নিকাশকে বদলে দেয়। আরব দেশগুলো নিজেদের পরিকল্পনা থেকে দূরে সরে আসতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, মুসলিম দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ না হলে ফিলিস্তিন মুক্ত করা সম্ভব নয়। আর মুসলমানদের ঐক্য সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে কারণ হলো দেশগুলোতে ইসলামপন্থী সরকার না থাকা। যদি দেশগুলোতে ইসলামপন্থী সরকার থাকত তবে মুসলমানরা একতাবদ্ধ হওয়ার সুযোগ লাভ করত। তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের উদাহরণ টেনে বলেন, ইরানে বিপ্লব হওয়ার কারণেই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে মজলুম ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানোর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান ও আল কুদস কমিটি বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ড. শাহ্ কাউসার মুস্তাফা আবুলউলায়ী বলেন, মুসলিম বিশ্বে বর্তমানে যে সংকট বিরাজ করছে তা মোকাবেলায় মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই। মুসলিম দেশসমূহ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমেই কেবল দানবীয় ইহুদিবাদী আগ্রাসনকে প্রতিহত করা সম্ভব। তিনি বলেন, ন্যাটোর ন্যায় মুসলিম দেশগুলোর একটি সামরিক জোট গঠন করা এখন সময়ের দাবি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অর্থনৈতিক জোট গঠন করে মুসলিম দেশসমূহ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। তিনি সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক সম্মিলিত হতে উদাত্ত আহ্বান জানান।
ইসলামী শিক্ষা উন্নয়ন পরিষদ, বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যক্ষ ড. একেএম মাহবুবুর রহমান বলেন, ইমাম খামেনি (রহ.) মুসলমানদের দুর্বলতার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন যে, মুসলমানরা তাদের শত্রু-মিত্র চিনতে পারে না। আর যারা চিনতে পারে তারা শাসনক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকার লোভে ইসলামের শত্রুদেরকে সহযোগিতা করে। তাই আমাদের প্রয়োজন শত্রু-মিত্রকে চেনা। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ আসা দরকার যাতে তরুণ প্রজন্ম এ বিষয়ে জানতে পারে, সচেতন হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন একতাবদ্ধ হওয়ার জন্য, কিন্তু আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। এর পেছনে ইসরায়েলের ষড়যন্ত্রও সবার কাছে স্পষ্ট। আর আল্লাহ তাআলার আদেশের বিপরীতে গিয়ে সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
দৈনিক আজকের ভোলা পত্রিকার সম্পাদক অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ শওকাত হোসেন বলেন, ইসলাম ও মুসলমানদেরকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হিসেবেই ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে ইহুদিদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হয়। সেই থেকে দখল ও নির্যাতন চলে আসছে। মুসলিম বিশ্ব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের জন্য সংগঠন গড়ে উঠলেও তারা আপোষকামী হয়ে ওঠে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ইমাম খোমেইনী রমজান মাসের শেষ শুক্রবার জুমআতুল বিদায় ‘আল-কুদস দিবস’ পালনের আহ্বান জানান। তিনি একই সাথে মুসলমানদের ঐক্যের জন্য আহ্বান করেন। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের চেতনায় হামাস গড়ে উঠলে ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলন গতি পায়। ইন্তিফাদা শুরু হয়। গত বছরের অক্টোবরে হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ করলে ইসরায়েল দুটি পদক্ষেপ নেয়। একটি হলো নির্বিচারে সাধারণ জনগণকে হত্যা করার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে হামাসের প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি করা আর দ্বিতীয়টি হলো আন্দোলনের নেতাদেরকে হত্যা করা। এরই ধারাবাহিকতায় তারা ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করে। এক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন যে, যায়নবাদী ইসরায়েল সবসময়ই মানুষ হত্যা করে চলছিল। কিন্তু বিশ্বের দৃষ্টি এদিকে ছিল না। হামাসের এই যুদ্ধের মাধ্যমে প্রাথমিক সফলতা অর্জিত হয়েছে। হামাসের পাশে হিজবুল্লাহ, হুথি, ইরাক ও সিরিয়ার যোদ্ধারা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমর্থন জুগিয়ে চলছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান।
আলোচনা সভার প্রবন্ধ উপস্থাপক দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক জামাল উদ্দিন বারী বলেন, ইসরায়েলী আগ্রাসনে গত ১৩ মাসে মুসলমানদের পূণ্যভূমি ফিলিস্তিনের গাজা শহরকে ধ্বংস স্তুপে পরিণত করা হয়েছে। নির্বিচার হত্যা করা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে। এদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েলি বোমায় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। গাজা উপত্যকার বিশ লাখের বেশি মানুষকে উদ্বাস্তু চরম খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষ ও মানবেতর জীবনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তিনি ফিলিস্তিন ও লেবাননে লি সেনাদের অব্যাহত গণহত্যা অভিযানের তীব্র নিন্দা জানান। অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ ও ইসলামী দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ইসরায়েলের অব্যাহত পাশবিক হামলার প্রতিবাদে ফিলিস্তিন ও লেবাননের সংগ্রামী জনতার প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রশংসা করে তিনি বলেন, মাতৃভূমি রক্ষায় ফিলিস্তিন ও লেবাননের মুজাহিদদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। আল্লাহর রহমত তাদের সাথে রয়েছে। বিজয় তাদের আসবেই।
সভা শেষে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে প্রতিবাদ মিছিল বের হয় যা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে গিয়ে শেষ হয়।