বিশ্ব ইজতেমা ঘিরে উত্তেজনা, জুবায়ের অনুসারীদে মহাসড়ক অবরোধ
বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানের পূর্বপাশে মহাসড়কে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছে বিশ্ব ইজতেমার তাবলিগ মুরব্বি জোবায়ের অনুসারী শুরায়ে নেজামের সহস্রাধিক মুসল্লি। পরে তারা মহানগর পুলিশ কমিশনার বরাবর বিভিন্ন দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি দেয়।
তাদের দাবিগুলো হচ্ছে গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীতে ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিতব্য ইজতেমার আগে ইজতেমা ময়দানে ভারতের মাওলানা সাদ অনুসারীদের জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়া, ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর সাদপন্থীদের আক্রমণে দুই মুসল্লি নিহত হওয়ার বিচার ও সাদপন্থীদের করা মামলা প্রত্যাহার।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি হিসেবে শুক্রবার জুমার নামাজের পর সহস্রাধিক শুরায়ে নেজামের অনুসারী প্রথমে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এর কার্যালয়ের সামনে টঙ্গী-কালীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কে অবস্থান নেয় । সেখানে তারা সমাবেশ করে দাবির বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। পরে সেই সমাবেশ পাশের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ছড়িয়ে পড়ে। শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) বেলা সোয়া ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত তারা এই কর্মসূচি পালন করে। এতে মহাসড়কে ঘণ্টা খানেকের জন্য যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
পরে সমাবেশ থেকে মুফতি মাসউদুল করীমের নেতৃত্বে শুরায়ে নেজামের একটি প্রতিনিধি দল জিএমপি দক্ষিণের উপ-পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে গিয়ে সাদ পন্থিদের ইজতেমা ময়দানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এ সময় জিএমপি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ জাহিদুল হাসান, জিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম নাসিরুদ্দিনসহ অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তারা ও ইজতেমা আয়োজক কমিটির অন্য মুরব্বিরাও উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশে অভিযোগ করা হয়, ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর ইজতেমা ময়দান দখল করতে মাওলানা সাদ অনুসারীরা ময়দানে থাকা নিরীহ মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায়। হামলার পর গত সরকার আমলে কোনো বিচার হয়নি, এ দাবি জানিয়ে মাওলানা জুবায়ের অনুসারীরা আজ বিক্ষোভ করেন। গতকাল কোনো সংঘর্ষ হয়নি। সমাবেশ থেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়, সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৪ ফেব্রুয়ারি সাদপন্থিদের কাছে ময়দান হস্তান্তর করা হবে।
সমাবেশে বক্তৃতায় শুরায়ে নেজামের অন্যতম নেতা মুফতি মাসুদুল করীম বলেন, ‘প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসররা মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে এনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে আনা হলে কিংবা সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে ইজতেমা ময়দানে সাদপন্থিদের জোড় ইজতেমা করতে দেয়া হলে পুরো গাজীপুর অচল করে দেয়া হবে।
স্বারকলিপিতে বলা হয়, ‘বিশ্ব ইজতেমা ২০২৫ উপলক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ের কার্যবিবরণীতে বিশ্ব ইজতেমার মাঠ হস্তান্তর বিষয়ে ক্রমিক নং ২ এ স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, প্রথম পর্বের আয়োজনকারীরা তাদের আয়োজন শেষে ইজতেমার মাঠ বিভাগীয় কমিশনার, ঢাকা এর নেতৃত্বে গঠিত বিশ্ব ইজতেমার মাঠ প্রস্তুত সংক্রান্ত কমিটিকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে মঙ্গলবার বেলা ৩টার মধ্যে বুঝিয়ে দিবেন। দ্বিতীয় পর্বের আয়োজনকারীরা ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ বিকেলে উক্ত কমিটির নিকট থেকে ইজতেমা মাঠ বুঝে নিবেন এবং ইজতেমা শেষে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখ দুপুরে উক্ত কমিটির নিকট মাঠ হস্তান্তর করবেন।
এতে আরও বলা হয়, সরকারের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সাদপন্থিরা সারা বাংলাদেশের সব জেলায় আগামী ২০ ডিসেম্বর ৫ দিনের জোড় করার উদ্দেশ্যে তাদের উগ্রপন্থি সাথীদের টঙ্গী ময়দানে আসার জন্য চিঠি পাঠায় যা সরকারের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সামিল। সাদপন্থিরা চাইছে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষ নিয়ে টঙ্গী ময়দানে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে সরকারকে বিপাকে ফেলতে। আমরা আশা করব তাদের এই দুষ্ট চক্রান্তকে নস্যাৎ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এর পূর্বেও তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাও করে রাষ্ট্রদ্রোহী অনেক কার্যকলাপ পরিচালনা করে এই সরকারের বিপক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।
প্রশাসনে স্মারকলিপি প্রদান শেষে জুবায়েরপন্থিদের গাজীপুরের শীর্ষ নেতা মুফতি মাসউদুল করীম বলেন, সাদপন্থিদের নেতা আব্দুল্লাহ মনসুর হুমকি দিয়ে বলেছেন, সাদ সাহেবকে আসতে না দিলে এ দেশে কোনো ইজতেমা করতে দেওয়া হবে না। সরকারের পক্ষ থেকে কোন ক্লিয়ারেন্স না পেলেও তারা টঙ্গীর মাঠে জোড় করার ঘোষণা দেন।’ তার এ উস্কানিমুলক বক্তব্যের প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করি। তাবলীগের সাথী, মাদ্রাসার বড় ছাত্র ও সাধারণ মানুষ টঙ্গীর মোড়ে বৃহস্পতিবার অবস্থান নিয়েছিল। এমন সময় সাদপন্থিদের একটি গাড়ি টঙ্গীর মাঠের দিকে যাচ্ছিল। তখন পুলিশ সদস্যরা ও আন্দোলনরত ছাত্ররা বাধা দেয় এবং তাদের গাড়ি এই রাস্তা দিয়ে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। পুলিশ সদস্যরা তাদের গাড়িকে ইউটার্ন নিতে বলেন। তারা তাদের কথা অমান্য করে ইউটার্ন না নিয়ে আমাদের সাথী ও আন্দোলনরত মানুষের উপর গাড়ি চালিয়ে দেয়। তখন আত্মরক্ষার্থে এলাকাবাসী ও আমজনতা ওই গাড়িতে চড়াও হন।
প্রসঙ্গত: আগামী ২০২৫ সালের দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্ব ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের ইজতেমার প্রস্তুতির অংশ হিসাবে গত ৩ ডিসেম্বর শুরায়ে নেজামের আয়োজনে বিশ্ব ইজতেমার ৫ দিনব্যাপী জোড় ইজতেমা শেষ হয়েছে।
শুক্রবার দুপুরে ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা যায়, ময়দানের ভেতরে জুবায়ের পন্থিদের কয়েক হাজার লোক অবস্থান করছেন। আর তুরাগ নদীর পশ্চিম পাড়ে সাদপন্থিদের মসজিদ ঘিরে কয়েক হাজার লোক অবস্থান করছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সাদ অনুসারী ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরব্বিরা গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনারের কার্যালয়ে যান। আলোচনা শেষে ফেরার পথে টঙ্গীর মুন্নু গেট এলাকায় জুবায়ের অনুসারীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে তাদের একটি প্রাইভেট কার ভাঙচুর করেন। এতে পাঁচজন আহত হন। যাঁদের পরে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
স্বারকলিপি দেয়ার পর মুফতি মাসুদুল করিম বলেন, ‘২০১৮ সালে সা’দ অনুসারীরা আমাদের ওপর হামলা করেছিল, কিন্তু আমরা বিচার পাইনি। তারা এ বছরও অন্যায়ভাবে ময়দানে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। আমরা তাদের বাধা দিয়েছি এবং আজ পুলিশকে স্মারকলিপি দিয়েছি।’
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম নাসিরুদ্দিন বলেন, কয়েক হাজার জুবায়ের অনুসারী স্মারকলিপি দিয়েছেন। ইজতেমা ময়দান ও আশপাশে বিশৃঙ্খলা এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।