স্বাধীনতার ৫৩ বছরে সুপ্রিম কোর্টে নতুন ইতিহাস
বিদায়ী ২০২৪ সালে দেশের উচ্চ আদালতে স্বাধীনতার ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলো ঘটেছে। প্রথমে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির পদত্যাগের ঘটনা ঘটে। বিচার বিভাগ পৃথক হলেও বিগত ১৫ বছরে পৃথকের কোনো সুযোগ হয়নি। তবে সেটির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কোটা নিয়ে হাইকোর্টের একটি রায়ের পর পতিত সরকার বিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। সেই গণআন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। সেই সাথে পরিবর্তন হয় বিচার বিভাগেরও। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে শেখ হাসিনার সরকার দেশে বিরোধীদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতন চালায়।
সবশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে আদালতকে ব্যবহার করে সরকার। যার পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগে বাধ্য হন প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। বিদায়ী বছরেই প্রথম কোনো বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। হাইকোর্টের ১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ না দিয়ে ছুটিয়ে পাঠানো হয়।
বিদায়ি ২০২৪ বছরে সুপ্রিম কোর্টে সাংবিধানিক মামলার নিষ্পত্তি ছিল উল্লেখযোগ্য হারে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম জুডিসিয়াল পুনর্বহালের রায়, বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাসের রায়, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত ও খালাসের আদেশ, বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বাবরসহ সাত আসামিকে খালাসের রায়সহ আলোচিত অনেক রায় ও আদেশ এসেছে উচ্চ আদালত থেকে।
বিদায়ী বছরে উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতিকে লক্ষ্য করে এজলাস কক্ষে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনাও ঘটে। যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করার অভিযোগে এ বছরই উচ্চ আদালতের ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠান প্রধান বিচারপতি।
বিদায়ী বছরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ কোটাপদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ কোটাপদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। ফের উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ। একপর্যায়ে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় শেখ হাসিনার সরকার।
১০ আগস্ট তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। পাঁচ বিচারপতি হলেন- এম ইনায়েতুর রহিম, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন।
প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পদত্যাগ দাবিতে সে দিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বর্ধিত ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। ছাত্র-জনতার দাবির মুখে তারা পদত্যাগ করেন। একসঙ্গে ছয় বিচারপতির পদত্যাগ সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এর আগে কখনও হয়নি।
বিকেলে খবর আসে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম। মুহূর্তের মধ্যে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন রাজপথ থেকে দাবি ওঠে, ছাত্র-জনতা প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে চান। অন্য কোনো বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে তা মেনে নেওয়া হবে না— বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এমন ঘোষণা দেন।
অবশেষে ১০ আগস্ট রাতেই বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনিই প্রথম বিচারপতি যিনি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। দেশের বিচার বিভাগে এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়োগ দেন। এরপর ১২ আগস্ট আপিল বিভাগে চারজন বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
এ ছাড়া চলতি বছরের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দেন হাইকোর্ট।
এ ছাড়া গত ১১ নভেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজার বিরুদ্ধে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে করা আবেদন) মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে খালেদা জিয়াকে দেওয়া ১০ বছরের সাজাও স্থগিত করেন আদালত। আপিল শুনানি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে সাজা।
গত ২৭ নভেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সাত বছরের দণ্ড থেকে খালাস দেন হাইকোর্ট।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার বিরুদ্ধে গত ২০ নভেম্বর আপিল শুনানি শুরু হয়। ৩ নভেম্বর এ মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার বিরুদ্ধে আপিল শুনানির জন্য নিজ খরচে পেপারবুক তৈরির অনুমতি দেন হাইকোর্ট।
২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে অন্য তিন আসামিকেও সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। খালেদা জিয়াসহ প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া ট্রাস্টের নামে কেনা কাকরাইলে ৪২ কাঠা জমি বাজেয়াপ্ত করে তা রাষ্ট্রের অনুকূলে নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন খালেদা জিয়া।
আলোচিত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে ১ ডিসেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
হাইকোর্টে ২০২৪ সালে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ে হাইকোর্ট বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে আগামী জাতীয় সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে।
১৬ অক্টোবর দুর্নীতি ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করার অভিযোগ ওঠায় ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এরপর থেকে তাদের আর হাইকোর্টের বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
ওই ১২ বিচারপতি হলেন— বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি আশীষরঞ্জন দাস, বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি আতাউর রহমান খান, বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দিন, বিচারপতি মো. আক্তারুজ্জামান, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম, বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন, বিচারপতি খিজির হায়াত ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান।
গত ২৭ নভেম্বর স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারকে জামিন দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান ও বিচারপতি আলী রেজার হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ১৪ আগস্ট চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে জামিন আবেদন করেন এসপি বাবুল আক্তার। ১৮ আগস্ট বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে আদেশ দেন। পরে তিনি হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন। হাইকোর্টের জামিন চেম্বার আদালতে বহাল থাকায় তিনি কারামুক্তি লাভ করেন।
বিদায়ী বছরে বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সাত আসামিকে খালাস দেন হাইকোর্ট। এছাড়া উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার সাজা কমিয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন করা হয়।