‘মা হিসেবে কিছু করার নেই বলে রাস্তায় নেমেছি’

রাত পৌনে একটা। তখনও হুড়মুড় করে ক্রেতারা বের হচ্ছিলেন রাজধানীর পান্থপথের বসুন্ধরা শপিংমল থেকে। অথচ, পৌনে ১২টায় এ বিপণীবিতানের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, শপিংমল বন্ধ ঘোষণার এক ঘণ্টা পরও ভেতরে থাকা ক্রেতারা বের হচ্ছিলেন। এ দৃশ্য গতকাল শনিবার (২৩) দিবাগত রাতের।
এমন সময় নজর গেল এক নারীর দিকে। পরনে বোরখা, চোখ-মুখও নেকাব দিয়ে ঢেকে রাখা। তিনি বসুন্ধরা শপিংমলের মূল গেটে গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তিদের কাছে সাহায্য চাচ্ছিলেন। ওই নারী দাবি করছিলেন, তিনি অসুস্থ। সন্ধ্যার পর থেকে রাত পৌনে একটা পর্যন্ত তিনি ৩ হাজার ৫০০ টাকা সহযোগিতা পেয়েছেন।
এ প্রতিবেদক ওই নারীর ছবি তোলেন। কিন্তু তিনি ছবি ও নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করেন। বোরখা পরা ওই নারী বলেন, ‘আমার একটা মেয়ে আর একটা ছেলে রয়েছে। তারা দুজনই লেখাপড়া করে। ঈদের সময় ওরা জামা-কাপড় নেবে বলে কান্না-কাটি করছে। মা হিসেবে আমার কিছু করার নেই বলে রাস্তায় নেমেছি। আমার ওষুধ আর বাচ্চাদের জামা-কাপড় কিনতে সাহায্য চেয়ে বেড়াচ্ছি।’
ঠিক রাত সাড়ে ১২টার দিকে জুয়েল মিয়া নামের এক প্রতিবন্ধীকে দেখা যায় বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স থেকে বের হওয়ার রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে। জুয়েল মিয়ার এক পা কাটা। ক্রাচে ভর দিয়ে থাকা অবস্থায় তিনি সাহায্য চেয়ে হাত বাড়াচ্ছেন। তা দেখে ক্রেতারা জুয়েলকে টাকা দিচ্ছেন। জুয়েলও খুশি মনে তা গ্রহণ করছেন।

জুয়েল মিয়ার অন্য সব দিন রাজধানীর পান্থপথ মোড়ে ভিক্ষা করেন। কিন্তু রোজা শুরুর পর থেকে তিনি বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে দাঁড়ান। কারণ, ঈদকে সামনে রেখে এখানে ক্রেতার সংখ্যা বেড়ে গেছে। জুয়েলদের টাকা পাওয়ার পরিমাণও বেড়ে গেছে।
শপিংমলের সামনে জুয়েলের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদেকর। সে সময় তিনি বলেন, ‘আজ বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ টাকার মতো পেয়েছি। কোনোদিন কম হয়, কোনোদিন আবার বেশি। সবই ভাগ্য। কারও মন ভালো থাকলে ১০০-৫০০ টাকাও দেয়, আবার কেউ দেয় না। কেউ আবার ৫-১০ টাকাও দেয়। আমি প্রতিবন্ধী, মানুষের সহযোগিতা নিয়ে বেঁচে আছি।’
বসুসন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে এক বয়স্ক ব্যক্তিকে দেখা যায় ঈদ শপিং করতে আসা ব্যক্তিদের কাছে সহযোগিতা চাইতে। ওই ব্যক্তির কাছে জানতে চাওয়া হয়, কত টাকার মতো সহযোগিতা পেলেন আজ? উত্তরে তিনি বলেন, ‘বেশি হয়নি বাবা। আমার শরীরিক অসুবিধা নেই। সে জন্য কম লোকে দেয়। তারপরও কেউ কেউ দেয়।’
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেও তিনি ক্রেতাদের কাছে টাকা চাচ্ছিলেন। সে সময় তার কাছে আবার জানতে চাওয়া হয়, শরীর যেহেতু ভালো, কাজ করে তো খেতে পারেন। কিন্তু তিনি এ কথার কোনো জবাব দেননি। শপিং কমপ্লেক্সের সামনে এমন আরও কয়েকজনকে দেখা গেল ভিক্ষা করতে।
গত শুক্রবার দিনগত রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর কাঁঠালবাগানের আল মুসলিম হোটেলে দুজন প্রতিবন্ধীর সঙ্গে কথা এ প্রতিবেদকের। সে সময় তারা সাহ্রী করছিলেন। তাদের একজনের নাম দীন ইসলাম, আরেকজনের নাম বিশু। ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারা, রাত-দিন একসঙ্গেই থাকেন। এ দুজনও ভিক্ষা করে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে। তারা দুজনই জানালেন, এখন ভালো টাকা-পয়সা আয় হচ্ছে।
দীন ইসলাম বলেন, ‘আমরা রোজার পর থেকে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে বসি। আজ আমার ২ হাজার ৮০০ টাকায় আয় হয়েছে। এখন একটু বেশি আয় হচ্ছে। সামনে ঈদ। সব সময় এমন হয় না।’
অন্যদিকে বিশু বলেন, ‘আজ আমার দুই ৩০০ টাকা হয়েছে। ঈদের আরও ৮-৯দিন বাকি রয়েছে। সামনে আরও বাড়বে আয়।’
দীন আর বিশু, দুজনই রাজধানীর পান্থপথের একই বাসায় থাকেন ১২ বছর ধরে। এই পুরো সময়টা তারা একসঙ্গে ভিক্ষা করে চলেছেন। তবে, শনিবার রাত ১২টার পর তাদের দুজনকে দেখা যায়নি বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে।