ক্যাপ্টেন ছাড়া অথৈ সাগরে জাহাজ, দিশেহারা নাবিক
বিনোদন জগতের অন্যতম বড় মাধ্যম চলচ্চিত্র। একটি চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে (প্রডাকশন) কাজ করে প্রায় ২০০ লোক। শুটিংয়ের আগে ও পরে (প্রি-প্রডাকশন-পোস্ট প্রডাকশন) আরো কাজ করে ১০০ জনের মতো। একটি সিনেমা নির্মাণ ও প্রদর্শনের সঙ্গে যুক্ত থাকে ১৮টি পেশার মানুষ। এর মধ্যে দু-তিনটি পেশার মানুষ ছাড়া বাকিরা দৈনিক মজুরিতে কাজ করে।
প্রতীকী অর্থে একটি সিনেমাকে বলা হয় জাহাজ। আর সিনেমার পরিচালককে বলা হয় ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ বা জাহাজ চালক। কারণ, এই ৩০০ মানুষ শুধু পরিচালকের কল্পনায় দেখা বিষয়টি পর্দায় তুলে ধরতে আপ্রাণ চেষ্টা করে।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মন্দাভাব চলছে। এখন বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপে স্তব্ধ মানবজীবন। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বন্ধ প্রায় যোগাযোগব্যবস্থা। সরকারি বিধিনিষেধের আওতায় দেশের রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা, থানা ও ইউনিয়ন। বন্ধ রয়েছে বিনোদন কেন্দ্র, শুটিং।
এতে বিপাকে পড়েছে দৈনিক মজুরিতে কাজ করা মানুষগুলো। প্রভাব পড়েছে চলচ্চিত্রে নানা পেশার মানুষের জীবনের ওপর। এদের অনেকের বাড়িতে খাবার নেই, নেই বাড়ি ভাড়া দেওয়ার মতো সামর্থ্য। এফডিসিতে প্রযোজক সমিতি ও শিল্পী সমিতির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ চোখে পড়লেও অজ্ঞাত কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ চলচ্চিত্রকর্মীরা।
সাধারণত শুটিং শুরু হয় সকাল ৮টায়। ৭টা থেকে সবাই আসতে শুরু করে। তবে প্রডাকশন বয়রা আসে ৬টায়। সবার জন্য নাশতা প্রস্তুত করে বসে থাকে, কেউ এলেই যেন খাবারটা দিতে পারে। রাত ১১টায় শুটিং শেষে যে যার মতো বাসায় চলে যায়। সব গুছিয়ে প্রডাকশন বয়দের বাসায় যেতে রাত ১২টা থেকে ১টা বাজে। দিনমজুরি হিসেবে পায় ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা।
প্রডাকশন বয় দিলু মিয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কাজটা ভালোবেসে করি। যে কারণে দুই টাকা কমবেশি চিন্তা করি না। অন্তত বাসায় ফেরার সময় চায়ের দোকানে তো সম্মান পাই, আমি ফিল্মের লোক। তবে এখন কষ্ট হচ্ছে। কারণ যে দোকানদার ফিল্মের মানুষ হিসেবে সম্মান করত, সেই দোকানদার টাকা পায়। দুই মাস ধরে দিতে পারি না। আবার ঘরে খাবার নাই, তারপরও আনতে পারছি না। টাকা চায় না, তবে কেমন করে যেন তাকায়; এ কারণে বাকিতে কিছু চাইতে লজ্জা করে।’
পরিচালকদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে দিলু বলেন, ‘সারা বছর ওস্তাদদের সঙ্গে কাজ করি। কত গুণী মানুষ তাঁরা। তাঁদের পায়ের জুতাটা পর্যন্ত এগিয়ে দেই। করোনার কারণে এক মাস ধরে বাসা থেকে বাইরে যেতে পারছি না। আমরা আর কত টাকাই বা পাই বলেন। মনে করেছিলাম, ডিরেক্টর স্যারেরা আমাদের জন্য কিছু করবেন। তাঁরাই তো আমাদের মাথা। কিছুই তো করলেন না। দুয়েকজনকে ফোন দিয়েছি, তাঁরা নাকি নিজেরাই সমস্যায় আছেন।’
প্রডাকশন বয়ের পর পরই কলাকুশলীরা শুটিংয়ে আসতে শুরু করে। শুটিংয়ের অন্তত দুই ঘণ্টা আগে আসে মেকআপম্যান। মেকআপ রুমটি সাজিয়ে শিল্পীদের জন্য অপেক্ষায় থাকে। পরিচালক শুটিং প্যাকআপ করার পর আবার সব শিল্পীর মেকআপ তুলেই বাসায় ফেরা। দিনমজুরি হিসেবে পায় দেড় হাজারের মতো। তাঁর সহকারীরা পায় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। তবে মেকআপ করার জন্য সরঞ্জাম দিতে হয় মেকআপম্যানকেই। তার জন্য বাড়তি কোনো টাকা পায় না তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মেকআপম্যান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা সারা বছরই কাজ করি পরিচালকদের সঙ্গে। তাঁরাই আমাদের মা-বাপ। এই দুর্দিনে তাঁরা কেন আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। আমি পরিচালক সমিতির সভাপতিকে ফোন দিয়েছিলাম, তিনি ফোনটা পর্যন্ত ধরলেন না। আমরা বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। শিল্পীদের কাছে হাত বাড়াচ্ছি। সেখানে সম্মানজনক সাড়া পাচ্ছি, সেটাও বলা ঠিক হবে না।’
একটি চলচ্চিত্রে পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করে তিন থেকে চারজন। শুটিং কোথায়, কী হবে, কারা কাজ করবে, সব ঠিক আছে কি না; সব দায়িত্ব বহন করে তারা। দিনমজুরি হিসেবে পায় হাজার টাকার মতো।
সহকারী পরিচালক মিজান বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে এখন কাজ বন্ধ, তবে আমাদের অবস্থা অনেক আগে থেকেই ভালো না। এফডিসিতে এরই মধ্যে কয়েকবার ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে তেমন একটা সমন্বয় ছিল না। যে কারণে কিছু মানুষ সহযোগিতা পেলেও আমরা চলচ্চিত্রকর্মীরা ঠিকমতো পাচ্ছি না। আমরা মনে করি, এই উদ্যোগটা পরিচালক সমিতিকে নিতে হবে। কারণ তারাই আমাদের ক্যাপ্টেন, আমরা নাবিক মাত্র।’
এ বিষয়ে বরেণ্য পরিচালক মালেক আফসারি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ হিসেবে পরিচালক সমিতির এখন মুখ্য ভূমিকা পালন করা উচিত। সব সমিতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত কীভাবে এই চলচ্চিত্রকর্মীদের বাঁচানো যায়। এখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কোনো সমস্যা নেই। কারণ এখন ঘরে বসে অনলাইনেই কথা বলা যায়। করোনার ভয়ের চেয়ে ক্ষুধার জ্বালা অনেক বেশি। একবেলা না খেলেই তো মাথা ঘোরায়। আর যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের কথাটা একবার চিন্তা করেন।’
আফসারি আরো বলেন, ‘আমাদের এফডিসিতে যতগুলো সংগঠন রয়েছে, সবারই ছোট-বড় ফান্ড রয়েছে। আমি মনে করি, আগে ফান্ডের টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা প্রয়োজন, বেঁচে থাকলে আবারও ফান্ড গঠন করা যাবে। এখনো যেহেতু সরকারের কাছে চাওয়া হয়নি, কবে চাইবে আর কবে দেবে, তার তো কোনো ঠিক নাই। যা-ই হোক, সবাইকে নিয়ে পরিচালক সমিতির সমন্বয় করা উচিত। ক্যাপ্টেন হিসেবে নিজের দায়িত্বটা পালন করা উচিত।’
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এফডিসিতে প্রত্যেকের আলাদা সংগঠন রয়েছে। সবাই নিজেদের মতো চেষ্টা করছে। আমরাও পরিচালক সমিতির সদস্যদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। যারা সমস্যায় আছে, তাদের টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’
ক্যাপ্টেন হিসেবে সব সমিতির সমন্বয় করছেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে গুলজার বলেন, ‘অন্য সমিতিগুলো এখনো আমাদের বলেনি সমন্বয় করতে। তবে আমাদের কিছু চেষ্টা আছে, আমরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছি, সেখান থেকে কিছু টাকা আসতে পারে। যদি আসে, তবে আমরা সব সমিতি মিলে সবার মধ্যে বণ্টন করব।’