হাওয়া : চলচ্চিত্রের মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা
মাত্র ৯টি চরিত্র।
৯০ রকমের ডাইমেনশন।
আমরা মাছ দেখি, খেয়ে তৃপ্ত হই; কিন্তু এর পেছনে যাঁরা কুশীলব হিসেবে জীবন বাজি রাখা শ্রম দেন, ভয়াল সমুদ্রকে পদানত করে রাখেন, তাঁদের জীবনের গল্প। বহুমাত্রিক ও মহাকাব্যিক জীবনবোধের গল্প। এই গল্পে লীন হতে হলে থিয়েটার হলে গিয়ে মুভিটি দেখতে হবে। নিজের অন্তর্জগত খুলে দিয়ে আখ্যান ভাবনায় নিজস্বতার ডালি সাজাতে হবে। তবেই আসলে মেজবাউর রহমান সুমনের চিন্তাশীলতার সতীর্থ হয়ে ওঠা যাবে।
অনেক দিন পর দর্শক আবার হলে যাচ্ছে।
প্রায় সবাই খুশি হয়ে বের হচ্ছে।
টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না বলে হাপিত্যেশ করছে। পেছনপানে ধাবিত হওয়া বাংলা সিনেমার জন্য এর চেয়ে বড় সুখবর আর কী হতে পারে।
মুভিটি দেখবার পর রীতিমতো খেই হারিয়ে ফেলেছি। কোনটা রেখে কোনটা বলব? আনকমন স্টোরিটেলিং, দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি, পারফরমারদের চরিত্রানুগ অ্যাক্টিং, ভিন্ন মেজাজের মিউজিক, দৃশ্যের মর্জিমাফিক আবহসংগীত, এক কথায় সবটাই অসাধারণ।
অত্যুঙ্গ জাদুবাস্তবতা, মিথের আধুনিকায়ন, ড্রামাটিক আইরনি, কমিক রিলিফ ও ক্লাইমেক্স বিনির্মাণে নির্দেশকের মুনশিয়ানা শতভাগ।
মনসামঙ্গলের চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যতরি সপ্তগ্রাম ও গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত ত্রিবেণী হয়ে সমুদ্রের পথে যাত্রা করত। প্রাচীন ভারতের চম্পক নগরীর সেই বণিক এবং মনসা দেবীকেও যেন স্মরণ করিয়ে দেয় একালের হাওয়ামঙ্গল।
ইবা তথা শরিফুল রাজের লৌকিক বাস্তবতা এবং গুলতি চরিত্রের নাজিফা তুষির অলৌকিক পরাবাস্তবতার একাঙ্গীকরণ অনন্য অভিধায় অভিষিক্ত হতে পারে। ম্যাজিক রিয়ালিজমের গডফাদারখ্যাত কলম্বিয়ান নোবেলজয়ী কথাশিল্পী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকেই যেন আমাদের বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরবার ওই ট্রলারটিতে দেখতে পেলাম।
সহজাত অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর স্পেশাল ভয়েস তাঁর অভিনয়কে অভাবনীয় ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
ছবিতে একটাই মাত্র গান।
গানটি এখন সবাই সবখানে গুনগুনিয়ে গাইছে।
হাশিম মাহমুদের কথা ও সুরে
তুমি বন্ধু কালা পাখি আমি যেন কী
বসন্তকালে তোমায় বলতে পারিনি!
সাদা সাদা কালা কালা
রং জমেছে সাদা কালা...
ইমন চোধুরীর সংগীতায়োজনে এরফান মৃধা শিবলুর মাদকতাময় ভরাট কণ্ঠশৈলী। সাথে পারকাশনিস্ট মিঠুন চক্রের দুর্দান্ত বাদন কানে প্রশান্তি এনে দেয়। কেবল খমককে সঙ্গী করে কাঁঠ, বাঁশ, হাঁড়ি পাতিলসমেত যে অযন্ত্রিক বাজনা; তা আনকমন ও ইউনিক। একটা মাত্র গানই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মোড় ফেরানোর জন্য যথেষ্ট। এর অনবদ্য উদাহরণ সময়ের জনপ্রিয় সংগীত : সাদা সাদা কালা কালা।
হাওয়া কি আধুনিক কালের রূপকথার গল্প? হতে পারে। এটা পানির গল্প, গভীর সমুদ্রের গল্প। যে সমুদ্র আমরা সচরাচর দেখি না। সেখানে কী ঘটে আমরা জানি না।
একদল জেলে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। গভীর সমুদ্র থেকে এক মেয়েকে উদ্ধার করে জেলেরা। মেয়েটি ফিশ বোটে আসার পর থেকেই ঘটতে থাকে অন্যরকম সব ঘটনা। মেয়েটি নিজেকে মৎস্য বলে পরিচয় দিলে কেন সে মৎস্য তা খোলাসা করে না। তাহলে এই মেয়েটা আসলে কে? সেটা হয়তো হাওয়ার পরবর্তী সিক্যুয়েলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। না হলেও ক্ষতি নেই।
মেয়েটি যেহেতু তরুণী, চলনে-বলনে যৈবতী কন্যার মনটাই দৃশ্যময়তা পায়; খুব স্বাভাবিকভাবেই নারীবিহীন একঘেয়ে মৎস্যজীবীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয় সে। নৌকার নিয়ন্ত্রক যেহেতু চাঁন মাঝি রূপী চঞ্চল চৌধুরী, তাঁর মনে হয় এই নারীর অধিকার তাঁর একার। কামনার আগুনে আত্মাহুতি দেওয়ার বাসনায় অন্যরাও কম যান না। কিন্তু ঘটনাচক্রে তরুণীটি প্রেমে পড়ে ইবা তথা শরিফুল রাজের। এরপর নানামুখী রহস্যময়তার মধ্য দিয়ে প্রেম অপ্রেম যৌনতা প্রতিশোধে ঘটনা এগিয়ে চলে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। ক্লাইমেক্স এন্টিক্লাইমেক্স শেষে আখ্যানের গ্রন্থিমোচন ঘটে অভাবনীয় ভাবে।
মনে হতে থাকে এ যে অবচয়িত জীবনের করুণ ট্রাজেডি। দর্শকের মনে ক্যাথারসিজ বা বিমোক্ষণ যেন ঘটতে চায়। কিন্তু না, ট্রাজেডি হয়ে উঠতে গিয়েও ফাইনালি ট্রাজিকমেডিতে রূপ নেয় গল্প। নায়ক আর নায়িকাকে এক পাটাতনে শুইয়ে মিলনাত্মক আবহ তৈরি করা হয়। এক অনির্বচনীয় ইন্দ্রজালিক জগৎ যেন ধরা দেয়। অতিপ্রাকৃত জাদুবাস্তবতা বিনির্মাণ করা হয়। যেখানে খুন হয়ে যাওয়া নায়ক রাও করে না ঠিকই, তবে নায়িকার অমৃত প্রেম যেন সে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না।
পরিচালক বা গল্পকারের নিপুণতা এখানেই যে গল্পটি শেষ হয়েও যেন শেষ হয় না। অনেক অমীমাংসিত রহস্য ও প্রশ্ন রেখে যায়। দর্শক অস্ফুটে বলে ওঠে এই সিনেমার সিক্যুয়েল তৈরি করা লাগবেই।
অপরাপর দর্শকের মতো আমরাও বলব অনে কদিন পর হলে গিয়ে টিকেট কেটে ভালো মুভি দেখা গেল। মুভির প্রথম দিককার মন্থর গতি দ্বিতীয়াংশের টান টান উত্তেজনা পুষিয়ে দিয়েছে। প্রথম দিকে আবহসংগীতের বাড়াবাড়ি অনেক ডায়ালগকে ম্রিয়মাণ করে দিয়েছে। কাহিনি, অভিনয়, চিত্রায়ন, কালার গ্রেডিং ও সম্পাদনা সেটা Recoup করে দিয়েছে। তবে আমি যেহেতু জেলা শহরে সেকেলে হলে মুভিটি দেখেছি, সেহেতু শব্দ ও কালারের খামতিটুকু আমাদের হলগুলোর সীমাবদ্ধতার খতিয়ানেই লিপিবদ্ধ করা যায়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মুভিটির মেকিং জাদু থেকে চোখ ও মন সরাতে পারছি না। অস্থির ও নিস্তরঙ্গ বিশাল সমুদ্রে একটা মাত্র নৌকার মধ্যে এমন এক মহাকাব্যিক কাহিনি ফাঁদা যায়, এর আগে কোনো ইংলিশ মুভি ছাড়া এমনটা দেখিনি। চঞ্চল চৌধুরী তাঁর দুর্দান্ত ভয়েস, মেকআপ-গেটআপ, এক্সপ্রেশনস ও অভিনয় দিয়ে বরাবরের মতো মন জয় করেছেন। নায়িকা নতুন হলেও তাঁর অ্যাপিয়ারেন্স ছিল দারুণ অ্যাট্রাক্টিভ।
শিল্পের লক্ষ্য কেবল সুন্দরকে রূপদান করা নয়, সত্যকে প্রকাশ করা। সত্যের ব্যাপ্তি কেবল সুন্দরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, অসুন্দরের রাজ্যেও তার অবাধ প্রবেশ। কাজেই জেলেদের মহাজীবনের সত্যানুগ Imitation তথা অনুকৃতি দেখবার আগেই যেন একপাক্ষিক নন্দনতত্ত্ব বিচার করতে না বসি আমরা।
মুভিটি সিনেপ্লেক্সের মতো হলে গিয়ে দেখুন, আমি নিশ্চিত আপনি চমকাবেন। আপনার দেখাতেই বাংলা সিনেমা এগোবে।