গান কথা গল্প
আমার মতো ভাগ্যবান সুরকার কম : আলাউদ্দিন আলী
একসময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতে একটি কথা প্রচলিত ছিল। সেটি হলো- ‘আপনি আলাউদ্দিন আলীর সুরে গান করেননি, তো কিছুই করেননি। আপনার সংগীত জীবনই ব্যর্থ।’ সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী বাংলা গান, বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রে বহু শ্রোতাপ্রিয় গানের জন্মদাতা। তিনি শুধু একজন সংগীত পরিচালক নন, একাধারে তিনি সুরকার, নামকরা বেহালাবাঁদক এমনকি গান লিখে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকারও। জন্ম ১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর। জন্ম মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ী থানার বাঁশবাড়ী গ্রামের এক সাংস্কৃতিক পরিবারে। বাবা ওস্তাদ জাদব আলী। মায়ের নাম জোহরা খাতুন। মাত্র দেড় বছর বয়সে ঢাকার মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে চলে আসেন। তিন ভাই, দুই বোনের সঙ্গে সেই কলোনিতেই বড় হতে থাকেন এই গুণী শিল্পী। সংগীতে প্রথম হাতেখড়ি ছোট চাচা সাদেক আলীর কাছে। পরে ১৯৬৮ সালে যন্ত্রশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে পা রাখেন। শুরুটা শহীদ আলতাফ মাহমুদের সহযোগী হিসেবে, পরে প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজের সঙ্গেই কাজ করেন দীর্ঘদিন। লোকজ ও ধ্রুপদী গানের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা তাঁর সুরের নিজস্ব ধরন বাংলা সংগীতে এক আলাদা ঢং হয়ে উঠেছে বিগত প্রায় চার দশক ধরেই। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের বহু স্বনামধন্য শিল্পী তাঁর সুরে গান করে নিজেদের করেছেন সমৃদ্ধ। এই জীবন্ত কিংবদন্তির শত সহস্র গানের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক শ্রোতাপ্রিয় গানের জন্মকথা তুলে ধরা হলো।
এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই
আমি তো আর গীতিকার না, গানও লেখি না। ৮১/৮২ সাল হবে। তখন মিতালী মুখার্জি ঢাকায় আসেন। তাঁকে নিয়ে বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠান করার জন্য মুসা আহম্মেদ নামের এক প্রযোজক আমাকে দায়িত্ব দেন। তখন মিতালী মুখার্জি আমাকে খুব অনুরোধ করেন যে, “আলী ভাই, আপনার সুর করা ‘কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিল না’ গানটির মতো সুন্দর একটি মেলোডিয়াস গান করে দেন।” তো সেই রাতেই রেকর্ডিং শেষে বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে আনুমানিক দেড়টায় হারমোনিয়াম নিয়ে বসি। তখন হঠাৎ করেই এ রকম একটা থিম মাথায় আসে। আর সঙ্গে সঙ্গেই সুরটাও হয়ে যায়। পরের দিন রেকর্ডিং। আসলে যখন যেটা আসে সেটা হুট করেই আসে। আবার অনেক দিন চিন্তা করলেও আসে না। তো এভাবেই আমার এই গান লেখা। অনেকদিন অনেক গীতিকারের সঙ্গে কাজ করেছি। কে কী ধরনের শব্দ ব্যবহার করে, কী ধরনের থিম আনে সেগুলো খেয়াল করতাম। আসলে এই গানটা আমার অভিজ্ঞতারই ফল। এই গান বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারের পর জনপ্রিয় হয়। পরিচালক আমজাদ হোসেন একদিন আমাকে বললেন, তাঁর ‘দুই পয়সার আলতা’ সিনেমায় একটা দৃশ্যের সাথে এই গানটি মিলে যায়, তাই তিনি এটা ব্যবহার করতে চান। আমিও সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই।
ও আমার বাংলা মা তোর
এটা আমার খুব প্রিয় ও প্রাণের গান। কারণ এটা আমার জীবনের প্রথম সুর করা গান। গানটি গেয়েছে সাবিনা ইয়াসমিন। স্বাধীনতার ঠিক পরপর ১৯৭২ সালের কথা। আবুল উমরা মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন নামের আমার এক বন্ধু ছিল। সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসের ভেতর এক লাইন, দুই লাইন করে এই গান লেখা হয়। গানটি কিন্তু অনেক কঠিন। ছয়টা ঋতুকে একবারে গানের কথায় এনে গানটি শেষ করা, আবার প্রিয় মাকেও উজ্জ্বল করে দেওয়া এক দারুণ ব্যাপার। আমি জানি না, সুরটা হয়তো খারাপ হতে পারে কিন্তু বাণীর দিক থেকে আমার কাছে আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্যে পুষ্পেভরা’ গানের পর ওই মাপের একটি সমৃদ্ধ গান মনে হয়েছে।
সুখে থাকো, ও আমার নন্দিনী হয়ে কারো ঘরনি
এই গানটি গেয়েছিলেন চিত্রনায়ক জাফর ইকবাল। ও সিনেমায় নামার আগে মূলত একজন গিটারবাদক ছিল। আমাদের সাথে গিটার বাজাত। তাদের একটা ব্যান্ড ছিল। ওরা প্রতি শনি ও রোববার শেরাটন হোটেলে বাজাত। তারপর আমাদের ইন্দিরা রোডের স্টুডিওতে একদিন রবিন ঘোষের সুরে ‘পিচঢালা এই পথটাকে ভালোবেসেছি’ গানটিতে গিটার বাজাতে আসে। ওই বিখ্যাত গানের গিটারের পিসটা কিন্তু নায়ক জাফর ইকবালের বাজানো। তখন পরিচালক এহতেশাম ইকবালকে দেখে বলেন, ‘তোকে আমি ছবিতে নায়ক হিসেবে নেব।’ পরে উনি নায়িকা শাবানার সঙ্গে একটি ছবিতে ইকবালকে সত্যি সত্যি নেন। ওর বড় ভাই সংগীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজের সাথে যেহেতু আমি কাজ করতাম, সেই সূত্রে আমাকে খুব মানত সে। তো আমি একদিন তাকে বললাম, ‘চলো তোমার জন্য টেলিভিশনে একটা গান করি।’ কিন্তু ও খুব ভয়ে ভয়ে ছিল। তাকে দিয়ে প্রথম গান করি, ‘শেষ করো না, শুরুতেই খেলা, না ভেঙ না ...।’ এরপর করলাম ‘সুখে থাক, ও আমার নন্দিনী হয়ে কারো ঘরনি’ এই গান। তারপর ‘যেভাবেই আছি, বেঁচে তো আছি, জীবন আর মরণের কাছাকাছি’সহ ওকে দিয়ে আরো পাঁচ-ছয়টা গান করি। পরে নায়ক রাজ্জাক ভাইয়ের পরিচালনায় ‘বদনাম’ ছবিতে আমারই লেখা আমারই সুরে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো, আমি তো এখন আর নই কারো/ অন্ধগলির এই যে আঁধার, বন্ধু হলো আজ আমার’ গানটি গায় ইকবাল। মূলত এই সিনেমার সংগীত পরিচালক ছিলেন আনোয়ার পারভেজ। কিন্তু সেদিন তিনি ঢাকায় ছিলেন না। তাই আমিই সেদিন এই স্মরণীয় কাজটি করি।
সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ
আসলে হাদী ভাই আমার সুর করা চলচ্চিত্রে গান করার আগে বিটিভিতে নওয়াজীশ আলী খানের প্রযোজনায় সম্ভবত ‘বর্ণালী’ নামের একটি অনুষ্ঠানে প্রথম গান করেন। এই অনুষ্ঠানে হাদী ভাইয়ের জন্য পাঁচটা গান করার পর শেষ গান হিসেবে এই গানটা করি। গানটির গীতিকার ছিল মনিরুজ্জামান মনির। তারপর গানটি সবার খুবই ভালো লাগে। আসলে আমার বহু ভালো গানের গায়ক হলেন হাদী ভাই। হাদী ভাইয়ের গলাটা দরাজ একটা গলা। উনি উচ্চশিক্ষিত মানুষ এবং ওনার বাংলা উচ্চারণ খুবই নিখুঁত। আর উনি একটা গানের জন্য যথেষ্ট সময়ও দিতেন। উনি গান রেকর্ডিংয়ের জন্য তিন-চারদিন রিহার্সেল করতেন। তারপর গান রেকর্ডিংয়ে সময় দিতেন। তাই হাদী ভাই আমার প্রথম পছন্দ, সব সময়।
বন্ধু তিন দিন তোর বাড়ি গেলাম দেখা পাইলাম না
মজার একটি বিষয় হলো, এই গান কিন্তু প্রথমে সাবিনা ইয়াসমিন গেয়েছিলেন, তারপর রুনা লায়লা। প্রথমে ‘কসাই’ ছবির জন্য সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে আমি এই হালকা মেজাজের গানটি রেকর্ড করি। সিনেমা রিলিজ হওয়ার পর খুবই জনপ্রিয় হয়ে যায়। পরে আবার কলকাতার এইচএমভিতে গিয়ে মনে হলো এই গানটি ওখান থেকে রিলিজ হলে ভালো হয়। পরে রুনা লায়লাকে দিয়ে এই গান আবারও রেকর্ড করালাম। বাংলাদেশে সিনেমায় সাবিনা, কলকাতায় অডিওতে রুনা। এই সেই গান যেটা দুই বাংলা পুরোপুরি মাত করে ফেলে।
যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে, মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে
আমি আসলে দারাশিকো সাহেবের ‘সর্পরাণী’ নামের একটি সিনেমার কাজ করতে গিয়ে এই সুরটা করি। তখন এর কথা অন্যরকম ছিল। পরে ’৮৪- ’৮৫ সালে ঢাকায় প্রদীপ গোস্বামী নামের এক গীতিকারকে দিয়ে এই ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে’ গানটি লেখানো হয়। পরে এই কথা দিয়ে মিতালী মুখার্জি ও তাঁর স্বামী ভূপিন্দর সিংকে দিয়ে কলকাতায় এইচএমভির জন্য এই গানটি রেকর্ড করি। আমি এইচএমভিতে ১৯৮৬ সাল থেকে প্রায় ১০-১২ বছর নিয়মিত কাজ করেছি। প্রায় বছর দশেক সেখানে আমার গানের সর্বোচ্চ বিক্রি ছিল।
প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ
গানটি মূলত টেলিভিশনের জন্য করা ছিল। সম্ভবত ’৭৭/৭৮ সাল হবে। গানটি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খুব পছন্দের ছিল। উনি ওনার পছন্দের কারণে এই গানটি ব্যবহার করেছেন। আমি জানিও না। এ ব্যাপারে আমি কোনো কথাও বলিনি। এই ধরনের আরো গান আছে। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি লিখেছেন গাজী মাজহারুল ভাই। উনি বিএনপি করেন। আবার ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি এখন আওয়ামী লীগ সব জায়গায় তাদের মূল গান হিসেবেই বাজায়। যাই হোক এটা কোন ব্যাপার না। কে কী রকমভাবে, দলীয় দৃষ্টিতে গানকে দেখল, সেটা আমার কাছে মুখ্য নয়। আমার কাছে গান গানই। গান সবর্জনীন। গানের কোনো দেশ, গোত্র নেই। গানটির গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির। ও আমারই সৃষ্টি। তাকে আমি প্রথম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়ে আসি। মনিরুজ্জামানকে আমার ভাতিজা সুরকার আবু তাহের আমার কাছে নিয়ে আসে। আমাদের তখন ‘ঢাকা রেকর্ড কোম্পানি’ নামে ইন্দিরা রোডে একটা স্টুডিও ছিল। সেখান থেকে আমি ওকে পিক করি। তারপর ওর পড়ালেখা, থাকা খাওয়ার দায়িত্ব আমি নিয়ে নেই। তারপর তেজগাঁও কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, ডিগ্রি পাস করল, পরবর্তীকালে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটি লেখার সুবাদেই তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পেয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে একটা ভালো পোস্টে চাকরি পেয়ে যায় সে। সেখান থেকে মনিরুজ্জামান মনিরকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এমনও তো প্রেম হয়, চোখের জলে কথা কয়
‘দুই পয়সার আলতা’ সিনেমায় আব্দুল হাদী ভাইয়ের গাওয়া গান এটি। সুর আমার। রাজ্জাক ভাইয়ের লিপে ছিল গানটি। আমজাদ ভাই সব সময়ই একটি গল্প মাথায় রেখে প্রথমে একটা গান রেকর্ড করে নেন। তারপর ওই গানটা সারাক্ষণ ওনার কানের কাছে বাজতে থাকে। আর পুরো সিনেমার গল্পটা আস্তে আস্তে করে তিনি লিখতে থাকেন। এটা ওনার আজীবনের অভ্যাস। এভাবেই আমি ওনার সঙ্গে এত বছর ধরে কাজ করে আসছি। ওনার সঙ্গে আমার বহু মাইলফলক কাজ আছে। যেমন ভাত দে, জন্ম থেকে জ্বলছি, গোলাপী এখন ট্রেনে, কসাই, ফকির মজনু শাহ্, সুন্দরী ইত্যাদি ছবিতে কাজ করেছি।
সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে রে
রথীন্দ্রনাথ রায় এই গানটি করে। ও আমার অনেক ভালো বন্ধু। দারাশিকো সাহেবের পরিচালনায় ‘ফকির মজনু শাহ’ সিনেমায় ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে রে’ গানটিও রথি করে। গানটি লিখেছিল গাজী মাজহারুল আনোয়ার। এই সিনেমার গল্পটি মূলত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় ফকির মজনু শাহর ওপর তৈরি করা। তো সিনেমায় যখন একটা লাশ কাঁধে তুলে নেওয়া হয় তখন এই গান বাজে। আমি এই ছবিটি সিনেমা হলে গিয়ে দেখি- এই গান যখন হয় তখন দর্শক খুবই ইমোশনাল হয়ে যায়। রথি আমার আরো অনেক গানে প্লে-ব্যাক করেছিল। ও আমার যতটা ছবিতে গান গেয়েছে প্রতিটাই জনপ্রিয় হয়েছে। আমার সুরে তার গাওয়া ‘খোদার ঘরে নালিশ করতে দিল না আমারে’ গানটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
আমায় গেঁথে দাওনা মাগো, একটা পলাশ ফুলের মালা
রেডিওতে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বলে একটা সার্ভিস আছে। যারা বিশেষ করে কিছু গান রেকর্ড করে। সেখান থেকে ৮৪-৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে একটা গান করে দিতে বলা হলো। কিন্তু আমার গান তৈরি ছিল না। তো একদিন গীতিকার মরহুম নজরুল ইসলাম বাবুকে আমি ক্যান্টিনে পেয়ে যাই। সে তখন চা খাচ্ছিল। আমি তখন তাকে বললাম, রুনা লায়লা আসবে ১২টার দিকে। এখনো তো কোনো গান রেডি হয়নি। তো চলুন এই ফাঁকে গান করে ফেলি। সাড়ে ১০টা বাজে তখন। আমরা কথা ও সুর করতে শাহবাগ রেডিও স্টেশনের ৬ নম্বর স্টুডিওতে হারমোনিয়াম নিয়ে বসলাম। তারপর এই গান এক বসাতেই রচনা ও সুর করে ফেলি। পরে ওই দিনই দুপুর ১২টায় রেকর্ডিংয়ে ঢুকে রুনা লায়লা চমৎকারভাবে গেয়ে দেন। ওই দিনই গানটি প্রচার করা হয়। এই গানগুলো যখন মানুষ বিভিন্ন দিবস এলে বাজায় আমার শুনতে ভালোই লাগে। ভালো লাগারই কথা।
আছেন আমার মুক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার
আসলে গানের বাণী, সুর ও পরিবেশনা সুন্দর হলে আর কোনো কিছু লাগে না। এর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ এই গান। এই গানটির কথা গাজী মাজহারুল আনোয়ার ভাইয়ের আর সুর আমার। আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমায় অভিনেতা আনোয়ার হোসেন গায়েন চরিত্রে অভিনয় করেন। উনি গ্রামে-গঞ্জে-হাটে-ঘাটে গান গেয়ে বেড়ান। ওই ছবিতে আমি একটি সিকুয়েন্স বের করলাম, যেখানে ‘আছেন আমার মুক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’ গানটি মোটামুটি যায়। এখন যেমন একটা গান দৃশ্যায়নের জন্য আমাদের হাল আমলের বিশেষ করে মেয়ে শিল্পীরা ২৫-৩০ লাখ টাকা খরচ করেন। তারপরও সেই গান চলে না। একবার-দুইবার দেখে তারপর ওই গান লোকজনের কাছে পুরনো হয়ে যায়। কিন্তু ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমার এই গানটি যদি আরো ৫০ বছর পরে চলে, তখনো নতুন মনে হবে। কারণ এটা তো বাঙালির হৃদয়ের জিনিস। এটা নষ্ট হওয়ার নয়।
পারিনা ভুলে যেতে, স্মৃতিরা মালা গেঁথে
এটা ‘সাক্ষী’ সিনেমার গান। এই গানটি করার সময় শাহনাজ রহমতউল্লাহর গলার অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। তখন তো আর ডিজিটালি থামিয়ে থামিয়ে রেকর্ডের সুযোগ ছিল না, যে পরে এডিট করে ঠিক করা যাবে। পরে শাহনাজ গানটি সাত-আট বার গেয়েছে। তারপর গানটা কেটে কেটে জোড়া দিয়ে দিয়ে গানটি ‘ওকে’ করা হয়। তারপরও তো গানটি আজ ইতিহাস।
কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না
এই গানের একটি মজার তথ্য আছে। এটাও ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমার গান। গেয়েছে সাবিনা ইয়াসমিন। আসলে এই গান প্রথমে লেখার আগে আমজাদ হোসেন ভাই ছবির স্ক্রিপ্টটা লিখেন। যারা এই সিনেমা দেখেছে তারা জানে পুরো সিনেমায় নায়ক ফারুক এক সংলাপ বারবার বলত! ‘একটা কিছু কও গোলাপী, একটা কিছু কও’। মানে নায়ককে কেউ কোনো দিন কোনো কথাই দিল না। তো ওই সংলাপ থেকেই মূলত এই বিখ্যাত গানটি লিখেন আমজাদ ভাই। পরে এই গানটি সাবিনা ইয়সমিন ও হাদী ভাই করেন।
জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো
এই গানটি হাদী ভাই এবং সামিনা চৌধুরী দুজনই আলাদাভাবে গেয়েছিল। ১৯৮১ সাল হবে। সামিনা তখন বাচ্চা মেয়ে, ছোটদের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে গান করে। সেটা আমারই অনুষ্ঠান ছিল। ক্লাস সেভেন-এইটে পড়তো মনে হয়। কেন জানি আমার মনে হয়েছে ওর গলাটা সুন্দর আছে। ও পারবে। আমি তখন ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’ সিনেমার কাজ করছিলাম। তো আমি একদিন আমজাদ ভাইকে বললাম, ‘সংগীতশিল্পী মাহমুদুন্নবীর একটি মেয়ে আছে, ছোট মেয়ে, ওরে দিয়া একটা গান করাই।’ তখন আমজাদ ভাই বললেন, ‘তুমি যদি ভালো মনে করো, আমার তো কোনো আপত্তি নাই।’ তারপর ওরে দিয়া এই ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’ গানটি গাওয়াই। একটা বাচ্চার লিপে ছিল গানটি। তারপর আরেকটা রোমান্টিক গান ছিল, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসতো, আমার নয়ন দুটি জলে ভাসতো’। আমি আমজাদ ভাইরে আবার বললাম, ওই গানটা যখন উৎরে গেছে ববিতার লিপে, এই গানটাও ওরে দিয়া করিয়ে ফেলি।’ পরে এই দুইটা গানই অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায় এবং পুরস্কারও পায়। অল্প বয়সে প্লে-ব্যাক শিল্পী হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় সামিনা। এই সিনেমার জন্য আমি শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পাই। আমি মোট আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই। যা সুরকার হিসেবে সর্বাধিক। আমি ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরি’, ‘কসাই’ এই তিন সিনেমায় পরপর তিনবার শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে হ্যাটট্রিক করি।
আমার মনের ভেতর অনেক জ্বালা আগুন হইয়া জ্বলে
মইনুল হোসেনের পরিচালনায় আমি ‘প্রেমিক’ নামের এক ছবিতে গীতিকার হিসেবেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই। কলকাতায় সিনেমার কাজ চলছে। মূলত গীতিকার গাজী মাজহারুল ভাইয়ের গানটি লেখার কথা ছিল। কিন্তু গাজী ভাই ঠিক সময়ে কলকাতা গিয়ে পৌঁছাতে না পারায়, আমাকেই গানটি লিখতে হয়। গানটি গাইবে সাবিনা। তো গানটা রেকর্ড করে ঢাকায় দ্রুত পাঠাতে হবে। কারণ গান হাতে পেলেই কক্সবাজারে শুটিং চলবে। আমার সঙ্গে ফুয়াদ নাসের বাবু সহযোগী সংগীত পরিচালক হিসেবে ছিল, এখনো আমার সঙ্গে সে কাজ করে। তখন বাবুকে বললাম, তুমি গিটারটা ধরো, আমি সুর করি। ও এতই ক্লান্ত ছিল যে গিটার ধরে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরে ঘুম থেকে উঠে গান লিখে ও সুর করে গানটি করতে স্টুডিওতে চলে যাই। কলকাতার নিউমার্কেটের লাগোয়া ‘লিটন হোটেলে’ এই কাজগুলো আমরা করতাম। আসলে ওই লিটন হোটেলে বাংলাদেশের অনেক গানের জন্ম হয়েছে।
যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়
এই গান বিটিভিতে ঈদের আনন্দমেলা অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি করা হয়। আর যেহেতু ঈদের অনুষ্ঠান তাই ধুমধাম গানের চাহিদা বেশি। তখন মোস্তফা কামাল সৈয়দ, টেলিভিশনের প্রডিউসার হিসেবে আছেন। আমি বললাম- কামাল ভাই, আমি কিন্তু ধুমধাম গান করব না। আমি আমার ইচ্ছামতো গান করব, দেখবেন লোকে পছন্দ করবে। তারপরে শাহনাজ রহমতউল্লাহকে দিয়ে এই গান করালাম। এরপর কিন্তু গানটি যথেষ্ট সমাদৃত হয়। গানটি লেখা ছিল মনিরুজ্জামান মনিরের।
ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়
আমি ৯৩-৯৪ সালের দিকে ‘এই চরম আঘাত’ নামের একটি ছবির সংগীত করতে মুম্বাই যাই। মুম্বাইতে যাওয়ার সময় গানটির গীতিকার রফিকুজ্জামান আর আমি এই গানগুলো ঢাকা থেকে তৈরি করে নিয়ে যাই। আর ওই সময় মিতালী মুখার্জি মুম্বাই ছিলেন। আর গেলেই ওর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতাম। কাকে কোন গানটা দিলে ভালো হয়, সেটা ও আমাদের সাথে শেয়ার করতো। মুম্বাইতে যাওয়ার পর এই গান আমরা মিতালী মুখার্জি আর কুমার শানুকে দিয়ে গাওয়াই। গানটির পেছনে সবচেয়ে মজার একটি গল্প হলো, এখনকার সুরকারদের এই সুযোগ পাওয়াটা খুবই ভাগ্যের ব্যাপার, যা এই গানে আমি করতে পেরেছিলাম। এই গানটির জন্য সানাই ছিল, বাঁশি ছিল, স্যাক্সোফোন ছিল, চ্যালো ছিল দুইটা, প্রায় ৩০টি ভায়োলিন, ২৪ পিস রিদম প্লেয়ার ওই হলরুম ভর্তি ছিল। তাদের সঙ্গে নিয়ে গানটি সরাসরি রেকর্ড করা হয়। এর মিউজিক শুনলেই তা বোঝা যায়। এরপর তারা দুজন দুই-তিন টেকেই এই গান গেয়ে ফেলে। পরে তো গানটি সুপার ডুপার হিট হয়ে যায়। এটাই কুমার শানুর সঙ্গে আমার প্রথম কাজ। এর পরে তাঁর সাথে অনেক কাজ করেছি।
শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে
শরৎচন্দ্রের লেখা ‘রাজলক্ষী শ্রীকান্ত’ সিনেমার গান এটি। ১৯৮৭ সালের ছবি। চিত্রনায়ক বুলবুল সাহেব আমাকে গীতিকার ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালকে নিয়ে কাজ করার অনুরোধ করেন। তিনি আমাদের নজরুলগীতি শিল্পী সুজিত মোস্তফার বাবা। প্রথম দিন ওনার সঙ্গে বসলাম। স্টুডিওর কার্পেটে মাথায় হেলান দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাবলেন। উনি ভাবছেন আর আমি সুর গুনগুন করছি। অনেক সময় পার হওয়ার পর উনি বললেন, ‘না আজকে আর না, আজ হবে না।’ খুব চুজি এবং মুডি মানুষ ছিলেন তিনি। মন মতো না হলে লিখতেন না। পরের দিন এসে শুধু ‘শত জনমের স্বপ্ন, তুমি আমার জীবনে এলে’ এইটুকু পর্যন্ত লিখে আমাকে দিলেন এবং সুর করতে বললেন। আমি সুর করলাম। পরে ওনার নিজের লেখা যতটা না পছন্দ করলেন, তার চেয়ে আমার সুরটা পছন্দ করলেন তিনি। দুজনের মধ্যে একটা মেলবন্ধন তৈরি হলো। পরে এই গান পুরো লিখলেন এবং একটি কালজয়ী গানের সৃষ্টি হলো। ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে/কত সাধনায় এমন ভাগ্য মিলে।’
আসলেই আমার মতো ভাগ্যবান সুরকার কিন্তু খুব কম আছে। কেন, বলব? এত শিক্ষিত লোক আমার জন্য গান লিখেছেন, তা ভোলার নয়। এখন তো দুই পাতা লিখলেই গীতিকার। কোনোদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ দেখেনি কিন্তু গান লিখে সয়লাব করে ফেলছে। পারলে আমার ড্রাইভারও গান লিখে আজকাল। এমনকি স্টুডিওতে আমার জন্য ভাত রান্না করত যে ছেলেটা সেও এখন সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক। তাল, লয় বুঝে না, সুরও বুঝে না। কিন্তু বড় বড় শিল্পীও এখন তার গান করে। ভারতের কোনো হিন্দি গানকে হয়তো বাংলা করে সুর করে ফেলল এ রকমই। এই হলো সংগীতের অবস্থা। আমি একটু বেশি খুঁতখুঁতে কিন্তু আমি শিল্পীদের বেশি কষ্ট দেই না। আমি একটু ফোক, ক্লাসিক্যাল মিলিয়ে অন্যরকম একটা কিছু সুর করার চেষ্টা করি। তাই শিল্পীরা কিছুটা তটস্থ থাকে। আমি মনে করি অনেক কিছু গান, শিল্প-সাহিত্যে আনা উচিত না। আনলে সাময়িক হৈচৈয়ে সস্তা জনপ্রিয় হয় ঠিকই কিন্তু তার স্থায়িত্ব থাকে না। এটা এক ধরনের বিকৃত মজা, অসুস্থতা।
আমি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারপর ঢাকায় আবু হেনা মোস্তফা কামাল সাহেব, গাজী মাজহারুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম বাবু, মাসুদ করিম, কেজি মোস্তফা, মো. রফিকুজ্জামান, মো. মনিরুজ্জামান সাহেবদের গীতিকবিতায় সুর করেছি। এই প্রজন্মের সুরকাররা কোথায় পাবেন এ রকম গুণী গীতিকারদের? ধরেন গাজী মাজহার ভাইকে যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মাঝখান থেকে দুই লাইন পড়ে শোনান, তাহলে এর আগে পিছে ১০ লাইনও বলতে পারবেন। কিন্তু এই প্রজন্মের অনেক গীতিকার তো এক লাইন ছড়াও বলতে পারবে না।
আমি বাংলাদেশ, করাচি, লাহোর, কলকাতা, মুম্বাই একসাথে একই দিনে কাজ করেছি। ১৯৮৭ সালের ২৬ জুলাই একদিনের ঘটনা বলি। আমি সেদিন মুম্বাইয়ে রেকর্ড করছি। প্রতি ঘণ্টায় শিল্পীরা আসছেন, কখনো উদিত নারায়ণ, সাধনা সারগাম, বিনোদ রাঠোর, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি একেকজন, এক ঘণ্টা পরপর আসছেন, গান করছেন। আবার কলকাতায় আমার আরেকজন সহকারী স্বপন সেন এবং একই দিনে ফুয়াদ নাসের বাবু ঢাকায় মিউজিক রেকর্ডিং করছে। আমি সেদিন মুম্বাই, কলকাতা এবং ঢাকায় একই দিনে ৩০টা গান রেকর্ড করি। আমি মিউজিক এবং সুর করে একসাথে তিন জায়গায় শিল্পীদের ভয়েজ নেওয়ার ব্যবস্থা করি।