শাকিব আবার নিষিদ্ধ যে কারণে
চলচ্চিত্র পরিচালকদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে চলতি বছরের এপ্রিলের শেষের দিকে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (এফডিসি) অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন ঢালিউডের আলোচিত অভিনেতা শাকিব খান। এর দুই মাস না যেতেই শুক্রবার আবার এফডিসিতে নিষিদ্ধ করা হলো শাকিবকে। এবার চলচ্চিত্রের জ্যেষ্ঠদের নিয়ে মন্তব্য ও ‘যৌথ প্রতারণা’র (নীতিমালাবহির্ভূত যৌথ প্রযোজনা) ছবির পক্ষে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগে তাঁর ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এফডিসির ১৪ সংগঠনের জোট ‘চলচ্চিত্র পরিবার’।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় এফডিসিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে চলচ্চিত্র পরিবারের আহ্বায়ক ও চিত্রপরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার এফডিসিতে শাকিবকে নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ঈদের ছুটির পর এফডিসির সংগঠনগুলো থেকে তাঁর সদস্যপদ খারিজ করা হবে।
গুলজার আরো বলেন, চিত্রনায়ক ফারুকসহ জ্যেষ্ঠদের নিয়ে ‘অকথ্য’ ভাষায় মন্তব্য করেছেন শাকিব। একই সঙ্গে এই অভিনেতা চলচ্চিত্র পরিবারকে ‘স্টুপিড’ বলেছেন এবং যৌথ প্রতারণার পক্ষে কথা বলেছেন। তাই তাঁকে আর ছাড় দেওয়া হবে না।
‘রংবাজ’ ছবির চারটি গানের শুটিং শেষে রোববার সকালে ঢাকায় ফেরেন শাকিব খান। এরপর সন্ধ্যাতেই রাজধানীর মগবাজারের একটি হোটেলে যৌথ প্রযোজনার দুই ছবি ‘নবাব’ ও ‘বস-২’-এর সহনির্মাতা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন সেখানে। সেই বক্তব্যে তিনি চলচ্চিত্রের জ্যেষ্ঠ কিছু শিল্পীর উদ্দেশে কিছু বক্তব্য দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও তাঁর বক্তব্যে নির্দিষ্ট কারো নাম উল্লেখ ছিল না।
ওই দিন যৌথ প্রযোজনার ছবির প্রতারণার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে শাকিব বলেন, ‘আসলে আন্দোলনের নামে যা হচ্ছে তা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। বলা হচ্ছে চলচ্চিত্র পরিবার। তাহলে আমরা পরিবারের কে? আমরা সব সময় দেখেছি পরিবারের যে ছেলেটা বা মেয়েটা উপার্জন বেশি করে, পরিবার যার ওপর কিছুটা নির্ভর করে সেই সন্তানটিকে পরিবারের পক্ষ থেকে বেশি আদর-যত্ন করা হয়। আমরা এখন যদি চলচ্চিত্র পরিবার বলা হয়, তাহলে এখানে বিষয়টি উল্টো হয়ে যাচ্ছে না?’
“আমাদের অবস্থাটা এমন হয়ে গেছে, যে ওপরে উঠছে তাকে টেনে টেনে নামাও। ‘নবাব’ ছবি নিয়ে আন্দোলন করছে। আরে নবাব এমন একটি সিনেমা, যেটি বাঙালি জাতির জন্য গর্ব করার একটি সিনেমা, যেখানে বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসনকে ইন্টারন্যাশনালি হাইলাইটস করা হয়েছে। আপনারা যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁরা এমন একটি সিনেমা কি বানিয়েছেন আপনারা? নিজেকে প্রেজেন্ট করা যায় এমন আন্তর্জাতিক মানের একটি সিনেমা বানিয়েছেন আপনারা? বানাননি তো। অথচ এই ছবি নিয়ে বিরোধিতা করছেন।”
নবাব সিনেমায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বেড়েছে উল্লেখ করে শাকিব বলেন, ‘আরে বোকা এই ছবির নাম ভূমিকায় তো বাংলাদেশ। শাকিব খানের পাশে লেখা আছে কিন্তু বাংলাদেশ। আরেফিন শুভ বাংলাদেশ। এভাবে আমাদের দেশের যাঁরা কাজ করবেন, সাথে দেশের নামটি যুক্ত। রেবেকা আপা বলেন, ফারিয়া বলেন, আমরা যারা কাজ করছি, তারা কিন্তু দেশের হয়ে কাজ করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে রংবাজ ছবি নিয়ে শাকিব বলেন, “ঈদের দেশি একটি ছবি ‘রংবাজ’। অথচ এই ছবি নিয়েও যে রংবাজি করা হলো, তাকে আমরা কী বলব? এই ছবিকে কেন্দ্র করে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে যে নায়করাজ রাজ্জাককেও কিন্তু তাঁরা ছাড়েননি, যাঁর অবদান অস্বীকার করলেন, তাহলে কার অবদান আছে চলচ্চিত্রে? রংবাজ ছবিতে আমি কলকাতার একটি কোম্পানিকে যুক্ত করেছি। দেশি চলচ্চিত্রে তারা ইনভেস্ট করেছে। কারণ আমাকে তারা বিশ্বাস করে। আমি তাদের আরেকটি ছবিতে কাজ করেছি যার ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে, এখনো নাম ঠিক করা হয়নি।”
‘শুধু ইনভেস্টর নিয়ে আসা নয়, বাংলাদেশের যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের একেকজনকে আমি আস্তে আস্তে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছি। অথচ এই ছবিকে আপনারা বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করলেন। কিন্তু কেন? এটাও কি প্রতারণা?’
‘ভালো ছবির অভাবে হল বন্ধ হচ্ছে’
দেশে ভালো ছবি কম হচ্ছে মন্তব্য করে শাকিব বলেন, ‘ভালো ছবির অভাবে হলগুলো তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঈদে যদি আমার দুটি ছবি, শুভর ছবি, বাপ্পীর ছবি মুক্তি পায়, তা হলে না মার্কেট বড় হবে। দর্শক ছবি দেখে ভালো বলবে, তখন না আরো হলের সংখ্যা বাড়বে। অথচ আমাদের ছবি আটকে কার ছবি চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে? এখানে হল মালিকরা আছেন, তাঁরা বলুন কার ছবি দর্শক দেখেন?’
‘আমরা যারা চেষ্টা করে যাচ্ছি, তাদের গুনছেনই না? একেকজন সাহেব ধরে নিয়ে আসছেন, সাহেবরা এসে সাহেবের মতো বক্তৃতা দিচ্ছেন, অমুক সাহেব তমুক সাহেব, কোথায় ছিলেন আপনারা সাহেব? এতগুলো বছর তো কোনো সাহেবকে দেখিনি। নিজেদের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। যখন একটা ভালো উদ্যোগের সময় আপনাদের ডাকা হতো, তখন কিন্তু আসতেন না। সাহেবদের কাছে তো অনেক টাকা আছে। আপনারা ছবি নির্মাণ করছেন না কেন? তাঁরা সিনেমা বানাবেন না আবার যারা বানাবে তাদের ধরে রাখবেন আর নেতাগিরি করবেন।’
যৌথ প্রযোজনার বিষয়ে ঢালিউডের আলোচিত এই অভিনেতা বলেন, ‘আমার কথা হচ্ছে যৌথ প্রযোজনার নামে যদি প্রতারণা হয়, তাহলে আপনি আটকান সিনেমা। কিন্তু আইনের মাধ্যমে না করে পায়ে পায়ে আইন ধরছেন কেন? বাংলাদেশের মানুষ এইভাবে তাকায়, আপনি এভাবে তাকালেন কেন? আপনাকে দেখতে হবে এটা অশ্লীল সিনেমা কি না, ছবিটি দেশে খারাপ কোনো প্রভাব পড়ছে কি না। আরে নবাব এমন একটি সিনেমা যা বিশ্ব দরবারে দেশের নাম উজ্জ্বল করবে।’
‘আমি তো মনে করেছিলাম এই ছবি আনকাট সেন্সর তো পাবেই, আমার জন্য হয়তো প্রশংসাপত্রও দেবে। এরই মধ্যে ছবির গান, টেইলর প্রশংসা পাচ্ছে। অথচ এই ছবিকে আটকানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।’
‘চলচ্চিত্রের স্বার্থে কাজ করেছি
চলচ্চিত্রের উন্নয়নে নিজের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে শাকিব বলেন, “আমরা এর আগেও আন্দোলন করেছি। তা চলচ্চিত্রের স্বার্থেই করেছি। আজ কাজ করছি, তা-ও চলচ্চিত্রের স্বার্থেই। চেষ্টা করছি ভালো ছবি উপহার দিতে। কারণ ‘আয়নাবাজি’র পর আর কোনো ভালো ছবি হয়নি। তা হলে সিনেমা হল বাঁচবে কীভাবে? ভালো মানের ছবি যদি আমরা করতে পারি, তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন কান ফেস্টিভ্যালে আমাদের দেশের ফ্ল্যাগ উড়বে।’
‘আমি প্রধানমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী মহোদয়কে বলব, আপনারা শুধু আমাদের কাজ করার পরিবেশটা করে দিন। তা হলে কান বলেন, আর অস্কার বলেন, আমাদের দেশের পতাকা উড়বে ইনশাল্লাহ। প্রত্যেকটা জায়গাতে বাংলাদেশের ছবি প্রতিনিধিত্ব করবে ইনশাল্লাহ।’
বিদেশ থেকে ফিরে সাংবাদিকদের নিজের ক্লান্তির কথা জানিয়ে শাকিব বলেন, ‘দেশের বাইরে থেকে শুটিং করে সকালে দেশে ফিরেছি, এমনিতেই রোজা রেখে ক্লান্ত। তার পরও এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। কথা হচ্ছিল যৌথ প্রযোজনা নিয়ে, আরে যৌথ প্রযোজনা তো আমাদের জন্মের আগে থেকেই হয়ে আসছিল। মিঠুন চক্রবর্তী যখন বোম্বের সুপারস্টার ছিলেন, তখনো তিনি করেছেন ‘অবিচার’। কতজন শিল্পী ছিল আমাদের দেশের, তার পরও এখনো ছবিটি দেখাচ্ছে। কারণ ছবিটি ভালো ছিল।’
‘তখনকার পত্রিকাগুলো দেখেন’
যৌথ প্রযোজনার ছবির বিরোধীদের সমালোচনা করে শাকিব বলেন, ‘কিছু বাজে লোক তাঁরা মাঝেমাঝেই একটা কথা বলেন, কিছু দিন আগে যৌথ প্রযোজনার বিরুদ্ধে কাফনের কাপড় পরলেন, আর আজ আপনারাই এই ছবিতে কাজ করছেন। আরে স্টুপিড, তখনকার পত্রিকাগুলো দেখেন, টিভি নিউজগুলো দেখেন, ছবিগুলো দেখেন, ব্যানারে কী লেখা ছিল। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় হিন্দি-উর্দু ছবি চলবে না। আন্দোলনটা ছিল আমাদের উপমহাদেশের ছবির বিরুদ্ধে। এখন সেই কথা টেনে কেন বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন?’
‘যখন বলা হলো কলকাতার সঙ্গে আমাদের দেশের ছবি এক্সচেঞ্জ করবে, তখন আমরা বলেছিলাম আমাদের দেশে এমন ছবি হচ্ছে না। কারণ আমরা টেকনোলজির দিক দিয়ে পিছিয়ে আছি। দুই দেশ মিলে কাজ করলে ছোট বাজারে একটি বড় ছবি বানাতে পারব। কিন্তু বড় বাজেটের ছবি আমাদের এখানে একা বানাতে তা তোলা কষ্ট হয়ে যায়। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, দুই দেশের শিল্পী মিলে যৌথ প্রযোজনার ছবি করব।’
নিজ ছবির প্রশংসা করে শাকিব বলেন, ‘আরে আমি তো যৌথ প্রযোজনার মাত্র একটি ছবি করেছি ‘শিকারী’। মন্ত্রী মহোদয় থেকে শুরু করে সবাই প্রশংসা করেছেন, সবাই বলেছেন শাকিব খান আপনি আমাদের মান রেখেছেন। দেশের বাইরেও কিন্তু ছবিটি বড় করে রিলিজ হয়েছে। এবার যখন ছবিটি করেছি, দেশের মানুষকে দেখতে দিন, কী করেছি।’