গীতা থেকে জেমস

বলিউডে বাংলাদেশি কণ্ঠশিল্পী

Looks like you've blocked notifications!
গীতা দত্ত ও জেমস। ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবীব্যাপী সঙ্গীতের ভাষা একটাই। সঙ্গীতের কোনো সীমানা নেই, দেশ নেই। সঙ্গীত সবসময়ই মুক্ত। একে কাঁটাতারের বেড়ায় বন্দি রাখা যায় না। সঙ্গীতের আছে শুধু সুর। আছে তাল, লয় ও ছন্দ। আর সেখানে ভাষা যদি এক হয় তাহলে তো কথাই নেই!  ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের ভাষাগত মিলের কারণে আমাদের দেশের কণ্ঠ শিল্পীরাও টালিউডপাড়ায় বহু আগে থেকেই প্লে-ব্যাক করে আসছেন। আগামীতে করবেনও। কিন্তু বলিউড সিনেমায় হিন্দি গানে বাংলাদেশি কণ্ঠশিল্পীদের সে অর্থে খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে অবশ্য ভাষাগত পার্থক্যটা শুরু থেকেই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এটা সত্য! অথচ হিন্দি ও উর্দুর ভাষাগত আত্মীয়তার কারণে শুরু থেকেই হিন্দি গানে ভূমিকা রেখে আসছেন পাকিস্তানি শিল্পীরা। সে অর্থে বাংলাদেশি কণ্ঠশিল্পীরা পিছিয়ে রয়েছেন বৈকি। কিন্তু সেই পঞ্চাশের দশকে ভারতীয় সিনেমা কাঁপানো বাংলাদেশের মেয়ে গীতা দত্তের কথা আমরা অনেকেই ভুলে গেছি। হিন্দি গানের সুরের জগতে গীতা দত্ত থেকে শুরু করে হাল আমলের নগর বাউল জেমস, সেই অভাব দূর করে বাংলাদেশের নাম উজ্বল করেছেন। চলুন জেনে নেই সেই গুণী শিল্পীদের হিন্দি গান গাওয়ার গল্প। 

গীতা দত্ত
১৯৪২ সালে কিশোরী বয়েসেই মা-বাবার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে যান বাংলাদেশের ফরিদপুরের রাজ পরিবারের মেয়ে গীতা দত্ত। আসল নাম গীতা ঘোষ রায়চৌধুরী। পরে ১৯৫১ সালে তখনকার বলিউড সিনেমার অন্যতম প্রধান নায়ক ও পরিচালক গুরু দত্তের ড্যাবু ফিল্ম ‘বাজি’ সিনেমায় গান গাইতে গিয়ে প্রণয়ে জড়ান গীতা। পরে গুরুকে বিয়ে করে গীতা রায় হয়ে উঠেন গীতা দত্ত। যদিও তাঁদের দাম্পত্য জীবন তেমন দীর্ঘ হয়নি। 

যাইহোক, বোম্বে যাওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় বলিউড সিনেমায় গান গেয়ে জানান দেন নিজেকে। সেখানে মাত্র ১২ বছর বয়সে সুরকার হনুমান প্রসাদ একবার গীতার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে ১৯৪৬ সালে তাঁর ‘ভক্ত প্রহলাদ’ নামের চলচ্চিত্রে প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ করে দেন। যদিও ওই ছবিতে গীতা কোরাসে মাত্র দুই লাইন গেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অসাধারণ গায়কীর কারণে পরের বছরে গীতা ‘দো ভাই’ ছবিতে প্লে-ব্যাক করেন। এই ছবিতে তাঁর গান হিন্দি ছবির জগতে প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করে।

প্রথম দিকে ভজন এবং দুঃখের গান গাওয়ার জন্য বেশি পরিচিতি পেলেও ১৯৫১ সালে শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে ‘বাজি’, ‘দেবদাস’, ‘পিয়াসা’, ‘কাগজ কে ফুল’ সিনেমার গানগুলোর জন্য আজও তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলিউড ইন্ডাস্ট্রি।


গীতা দত্তের গাওয়া কিছু বিখ্যাত হিন্দি গান 

বাবুজি ধীরে চলনা, সিনেমা : ‘আর পার’
মেরা নাম চিন চিন চু, সিনেমা : ‘হাওড়া ব্রিজ’
আন মিলো আন মিলো, সহশিল্পী মান্না দে, সিনেমা : ‘দেবদাস’
মেরা সুন্দর সপনা বীত গয়া, সিনেমা :  ‘দো ভাই’
ও সপনেবালি রাত, সিনেমা : ‘পিয়ার’ 
তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির,  ‘বাজি’
বক্ত নে কিয়া কেয়া হাসিন সিতম, সিনেমা :  ‘কাগজ কে ফুল’
থান্ডি হাওয়া কালি ঘটা, সিনেমা : ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ’
জব বাদল লেহরায়া, সিনেমা : ‘ছুমন্তর’
হাওয়া ধীরে আনা, সিনেমা : ‘সুজাতা’
আজ সাজন মুঝে অঙ্গ লাগালো, সিনেমা : পেয়াসা
মেরে জিন্দেগি কে হামসফর, সিনেমা : ‘শ্রীমতি ৪২০’

রুনা লায়লা
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে গুণী শিল্পী রুনা লায়লার হাত ধরে হিন্দি চলচ্চিত্র গানে বাংলাদেশি শিল্পীদের আবারও যাত্রা শুরু হয়। মূলত ১৯৬৫ সালে উর্দু ছবি 'জুগনু'তে গান গেয়ে সঙ্গীতের ক্যারিয়ার শুরু করলেও ১৯৭৬ সালে বলিউডপাড়ায় নাম লিখান এই ভার্সেটাইল শিল্পী। শুরুটা হিন্দি গানের বিখ্যাত সংগীত জুটি কল্যাণজি-আনন্দজির সুরে তখনকার আবেদনময়ী নায়িকা হেলেনের লিপে ‘এক সে ব্যারকের এক’ সিনেমার শিরোনামের আইটেম গান গেয়ে আলোড়ন তুলেন রুনা। যদিও তারও আগে ১৯৭৪ সালে ভারতের চলচ্চিত্রপুরি মুম্বাইয়ে একটি লাইভ কনসার্টে মুগ্ধ হয়ে জয়দেব নামের সংগীত পরিচালক তাঁকে ভারতের রাষ্ট্রীয় টেলিভেশন দূরদর্শনে প্রথম গান করার সুযোগ করে দেন। সে সময় রুনা লায়লার বিভিন্ন হিন্দি-উর্দু গানে মুগ্ধ হয়ে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক খুশবন্ত সিং একবার এক পত্রিকায় লিখে বসেন- ‘তোমরা আমাদের রুনা লায়লা দাও, আমরা তোমাদের ফারাক্কার পানি দিয়ে দেব।’ 

‘ঘরোন্দা’ সিনেমায় ভূপিন্দর সিংয়ের সঙ্গে ‘দো দিওয়ানে শেহের মে’ গানের জন্য রুনা লায়লা ফিল্ম ফেয়ার ম্যাগাজিনের বেস্ট প্লে-ব্যাক সিঙ্গারের নমিনেশন লাভ করেন। এর পরে তিনি আরো কিছু গানে কণ্ঠ দেন। বিখ্যাত শিল্পী মোহম্মদ রফির সাথে ‘জান-ই-বাহার’ সিনেমার ‘মার গায়ো রে’ ডুয়েট গানটি শ্রোতারা খুব ভালোভাবেই গ্রহণ করেন। এ ছাড়া উর্দু চলচ্চিত্রে গাওয়া হিট গান ‘ও মেরা বাবু ছেলছাবিলা মে তো নাচুঙ্গি’ গানটি বলিউড সিনেমাতেও ব্যবহার করা হয়। শুধু তাই নয়, রুনা লায়লা একমাত্র বাংলাদেশি শিল্পী যাঁর ভারতে গান গাইবার ওয়ার্ক পারমিট আছে। শ্রদ্ধেয় শিল্পী রুনা লায়লা শুধু যে বাংলা-হিন্দি-উর্দু গান করেই বসেছিলেন তা নয়, তিনি বিশ্বের প্রায় ১৭টি ভাষায় গান করে বালাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। এরমধ্যে পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পস্তু, বালুচি, আরাবিক, ফার্সি, মালে, নেপালি, জাপানি, ইতালি, স্পেন, ফরাসি ও ইংলিশ অন্যতম।  

রুনা লায়লার কিছু হিন্দি গান

ইক সে বাড়কার ইক,  সিনেমা : ‘ইক সে বাড়কার ইক’
তুমহে হো না হো,  সিনেমা : ‘ঘরোন্দা’
মুঝে পেয়ার তুমসে নেহি, সিনেমা : ‘ঘরোন্দা’
দো দিওয়ানে শেহের মে, সহশিল্পী ভূপিন্দর সিং, সিনেমা : ‘ঘরোন্দা’
মার গায়ো রে, সহশিল্পী মোঃ রফি, সিনেমা : ‘জান-ই-বাহার’
আলীবাবা, সিনেমা : ‘অগ্নিপথ’
ও মেরা বাবু ছেলছাবিলা, সিনেমা : ‘ঘর-দোয়ার’
ম্যায় কালি আনার কি, সিনেমা : ‘সাপনো কা মান্দির’
অ্যায় দিলওয়ালে আও, সিনেমা : ‘ইয়াদগার’
কাহো সাখি কাহো, সিনেমা : ‘ইক দিন বহু কা’
এন্ড্রু কিশোর
বাংলাদেশের পুরুষ কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে প্রথম হিন্দি গানে প্লেব্যাক করেন এন্ড্রু কিশোর। তাও আবার কিংবদন্তী সংগীত পিরচালক আরডি বর্মণের সুরে। ১৯৮৬ সালে রাজেশ খান্না ও শাবানা অভিনীত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার প্রমোদ চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘শত্রু ‘ সিনেমায়। সুপারহিট গায়ক কিশোর কুমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গান করে সুনাম কুড়ান এন্ড্রু কিশোর। যার বাংলা নাম ছিল বিরোধ। এন্ড্রু কিশোর নিয়ে এক মজার গল্প আছে, যখন মা মিনু বাড়ৈয়ের কোল আলোকিত করে তিনি জন্ম নেন তখন মা তার প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের নামে সন্তানের নাম রাখেন ‘কিশোর’। ধীরে ধীরে সেই শিশুটি বড় হয়ে সংগীতাঙ্গনে পা রাখেন এবং বলিউড সিনেমায় পা রেখে তাঁর বলিষ্ঠ এবং সুমধুর কণ্ঠের জোরে মায়ের প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের গানে ভাগ বসান। 

আরডি বর্মণের সুরে মোট তিনটি গান তিনি করেন। তার মধ্যে দুটি হিন্দিতে এবং বাংলা ছবি বিরোধের জন্য তিনটি বাংলায় গান করেন। বিখ্যাত গীতিকার মাজরু সুলতানপুরির লেখা ‘সুরেজ চান্দা’, ‘মে তেরি বিসমিল হু’ এই হিন্দি গান দুটি গাওয়ার পাশাপাশি বাংলা ‘মুখে বল তুমি হ্যাঁ, ‘এর টুপি ওর মাথায়’ এবং ‘আজো বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা’ গানগুলো করেন এন্ড্রু কিশোর। আর ‘এর টুপি ওর মাথায়’ বাংলা গানটির হিন্দি ভার্সন ‘ইসকি টুপি উসকি সার’ গানটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার। আরডি বমর্ণ পঞ্চম আদর করে এন্ড্রু কিশোরকে ঢাকাইয়া বলে ডাকতেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের এই গুণী শিল্পীর কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে মুম্বাইয়ে প্লেব্যাক গানে ক্যারিয়ার গড়ার পরামর্শ এবং  বিশেষ অনুরোধ করেন। 

মিতালী মুখার্জি
ভারতের গজল শিল্পী ভূপিন্দর সিংকে বিয়ে করে দেশটির পুত্রবধূ হয়ে সেখানেই বসবাস করছেন বাংলাদেশি সংগীতশিল্পী মিতালী মুখার্জি। বাংলাদেশে তিনি মিতালী মুখার্জি নামে পরিচিত হলেও ভারতে মিতালী সিং নামেই পরিচিত। ১৯৮৭ সালে মিতালী প্রথম হিন্দি সিনেমায় নাম লেখান। বাঙালি সঙ্গীত পরিচালক বাপ্পী লাহিড়ীর সুরে রিলিজ পাওয়া রাজএন সিপ্পির পরিচালনায় 'সত্যমে জয়তে' চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করা ‘তু জান সে পেয়ারা হ্যায়’ গানটিই মিতালী মুখার্জির একমাত্র হিন্দি ফিল্মের গান।
জেমস
বলিউড ফিল্মি গানে বাংলাদেশের সর্বশেষ সংযোজন নগর বাউল শিল্পী জেমস। ২০০৫ সালে বলিউডের জনপ্রিয় সুরকার প্রীতমের সুরে অনুরাগ বসুর পরিচালনায় ‘গ্যাংস্টার’ সিনেমায় প্রথম কণ্ঠ দেন উপমহাদেশের জিম মরিসনখ্যাত জেমস। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় বাঙালি সংগীত পরিচালক প্রীতম কলকাতার বিখ্যাত ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’ গানটির হিন্দি ভার্সন ‘ভিগি ভিগি রাতে’ গানটির জন্য যুৎসই কণ্ঠ খুঁজছিলেন। পরে বাংলাদেশের হার্টথ্রব ব্যান্ড শিল্পী জেমসের গান শুনেই মুগ্ধ হয়ে তাঁকে গান করার প্রস্তাব দেন প্রীতম। তারপর তো গানটি হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য ইতিহাস। এখনো দেশটির বিভিন্ন রিয়ালিটি শো থেকে শুরু করে বিভিন্ন লাইভ অনুষ্ঠানে এই গান কণ্ঠশিল্পীদের প্রিয় তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। পরে প্রীতম আবার জেমসকে দিয়ে ২০০৬ সালে ‘ও লামহে’ ও ২০০৭ সালে ‘লাইফ ইন অ্যা মেট্রো’ সিনেমায় পরপর তিনটি গান রেকর্ড করান। ‘লাইফ ইন অ্যা মেট্রো’ সিনেমায় ‘আলবিদা’ ‘রিশতে’, ‘ওহ লামহে’ সিনেমার ‘চাল চালে আপনে ঘের’ এবং ২০১৩ সালে মিট ব্রস, অঞ্জনের ‘ওয়ার্নিং’ ছবির ‘বেবাসি’ গানটি বলিউডে এক সম্মানের জায়গায় আসীন করেছে জেমসকে, সঙ্গে বাংলাদেশকেও।