গান কথা গল্প

সঞ্জীব দাকে চাই কিন্তু আমি পাই না : বাপ্পা মজুমদার

Looks like you've blocked notifications!
বাপ্পা মজুমদার। ছবি : আয়াতুল্লাহ মামুন

সংগীতের মূর্ছনা আর তবলার লহড় পছন্দ হলেও ‘এইম ইন লাইফ’ ঠিক করার দিনগুলোতে ছেলেটির কোনোভাবেই গায়ক হওয়ার মনোবাসনা ছিল না। ছিল স্থপতি হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু কথায় বলে না ‘রক্ত কথা বলে!’ আর বলবেই বা না কেন? যাঁর শিরায় বাবা সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ বারীন মজুমদার এবং মা ইলা মজুমদারের রক্ত প্রবহমান তাঁকে তো সংগীতের সমুদ্রস্নানে নামতেই হবে। যাঁর সুরে একজন সঞ্জীব চৌধুরী ‘দলছুট’ হয়ে সবুজে বাসা বেঁধে, বিরান পথে হেঁটে যান। অথবা সঞ্জীব চৌধুরী যাঁকে অতি আদরের ‘আমার সন্তান’ গানটি তুলে দেন, সেই ছেলেটি তো আর সাধারণ কেউ হতে পারেন না! আর এই অসাধারণ ছেলেটির নাম শুভাশীষ মজুমদার বাপ্পা। বিখ্যাত মুকাভিনেতা পার্থ প্রতীম মজুমদার আর সংগীত পরিচালক পার্থ সারথি মজুমদারের আদরের ছোটভাই বাপ্পা। বলছি, সব প্রজন্মের প্রিয় শিল্পী হয়ে ওঠা বাপ্পা মজুমদারের কথা। জন্ম ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। তিনি একাধারে সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী।  বাবা-মা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী হওয়ায় সঙ্গীতে হাতেখড়ির তাঁদের কাছেই। আর তবলা শেখায় হাতেখড়ি দিয়েছেন ওস্তাদ কামরুজ্জামান। পরে বাবার সঙ্গীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘মণিহার সঙ্গীত একাডেমি’তে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওপর পাঁচ বছর মেয়াদি কোর্স শেষ করেন বাপ্পা। যা তিনি কখনোই গান গাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত মনে করেন না। বড় ভাই পার্থ মজুমদার তাঁকে ধরে ধরে গীটার বাজানো শেখান। পরে মূলত গিটারবাদক হিসেবেই সঙ্গীত শুরু করেন এই গুণী শিল্পী। তারপর কীভাবে কীভাবে যেন, হয়তো ‘জেনেটিক্যালি’ সঙ্গীত সমুদ্রে পা ভেজান বাপ্পা। ১৯৯৫ সাল ‘তখন ভোর বেলা’ প্রথম অ্যালবামের মধ্য দিয়ে একক শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আবার ১৯৯৬ সালে মাত্র দুজন মিলে ব্যান্ড দল দলছুটের ‘আহ্’ অ্যালবাম দিয়ে শ্রোতাদের মনে ‘বাহ্’ নয় ‘আহ্’-ই জাগিয়ে তুলেন। সেই ‘আহ্’ আজও একইভাবে বহমান বাংলা সংগীতে। বাংলা সঙ্গীতের সমুদ্র সন্তান বাপ্পা মজুমদার নিজেই সেই কিছু প্রিয় গানের গল্পকথা জানালেন নিজের মতো করে।

তুমি চক্ষু খুলে দেখ সব অন্ধকার একা নয়

এ প্রসঙ্গে যেটা বলি, মূলত প্রথম যেটাকে আমার গাওয়া বলে আমি মনে করি, সেটা হচ্ছে সঞ্জীব দার সুর করা ‘তুমি চক্ষু খুলে দেখ সব অন্ধকার একা নয়’-এই গানটি দিয়ে আমার মোটামুটিভাবে একক গায়ক হিসেবে সঙ্গীত জীবন শুরু। তখন ১৯৯৫ সাল। এই গানটা আমার প্রথম অ্যালবাম ‘তখন ভোরবেলা’র। সংগীতে মূলত আমি ছিলাম। আর তখন মিউজিক করেছিলেন পার্থ প্রতীম বাপ্পী। বাপ্পী দা ছিলেন আমার ওই অ্যালবামের প্রধান সংগীত পরিচালক। এই গান দিয়েই আমার রেকর্ডিং শুরু বলে আমি মনে করি। গানের কথা লিখেছেন আশাদ মান্নান। গান আছে অনেক গানই যে গানগুলো শুনলে মনে হয়, এ গানগুলো আরো ভালো করা যেতে পারত। ইনফেক্ট আমার যে কটা গান আছে সবই শুনলে আমার তাই-ই মনে হয়। সব গানই আমি হয়তো বেটার গাইতে পারতাম। এই বোধটা মনে হয় আমাকে আরো নতুন নতুন গান করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং ভালো কাজ করার  জন্য যে মানসিকতা প্রয়োজন, যে মনোবাসনাটা প্রয়োজন এটা তৈরি করে এই বোধটাই।

ধুলো পড়া চিঠি

২০০১ সালে ‘ধুলো পড়া চিঠি’ অ্যালবামটি প্রকাশ পায়। এই গানটির পেছনে একটি অদ্ভুত ঘটনা আছে। গানটা প্রথমে কিন্তু লেখা হয়নি। এটি প্রথমেই সুর করা হয়। আমার মনে আছে, তখন অনেক গরম, আমার বাসায় সারারাত জেগে, সেই অসহ্য গরমের মধ্যে জামাকাপড় খুলে গানটির প্রথমে প্রুফটা তৈরি করি। সেটার ওপর সুরটা করি। মনে আছে, গানের স্থায়ীটা করার পর অন্তরাটা করতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। গীতিকার মাস মাসুম পাশেই বসেছিল। সারারাত জেগে সুরটা হওয়ার পর সুরটা ক্যাসেটে রেকর্ড করে সকালবেলা মাসুমকে গান লেখার জন্য দিয়েছিলাম। মাসুম তখন দুই লাইন বা চার লাইন লিখেছে মাত্র। তারও দু-তিনদিন পর গানটি লিখে মাসুম নিয়ে আসে। গানটি রেকর্ড করা হয়। আরেকটা মজার তথ্য দেই এই  ‘ধুলো পড়া চিঠি’ গানটির বেজ লাইনটা কিন্তু বাজিয়েছে সুমন। মানে যাকে আমরা বেজবাবা বলি। অর্থহীন ব্যান্ডের সুমন। সবকিছু মিলিয়ে গানটার ভেতরে এক অন্য ধরনের ভালোবাসা আছে, ভালোলাগা আছে এবং আমার অনেক পছন্দরে গানের মধ্যে এই ‘ধুলো পড়া চিঠি’ একটা পছন্দের গান।

পরী- আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে

এই গানের গীতিকার রানা। রানা হচ্ছে আমার ছোট ভাই এবং আমাদের ভীষণ আদরের, ভীষণ পছন্দের, ভীষণ ভালোবাসার একটা ছোট ভাই। দুর্দান্ত গান লেখে। তেমনি দুর্দান্ত কবিতা লেখে। ওর লেখনি শক্তিও ভীষণ রকম ধারালো। মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা। আমার অনেক অনেক পছন্দের প্রিয় গানের গীতিকার কিন্তু এই রানা। যেমন : ‘পরী’, ‘বৃষ্টি পড়ে অঝর ধারায়’,’আমি ফিরে পেতে চাই’, ‘ খোলা আকাশ একটি গাছ’ এ রকম অনেক গানের গীতিকার রানা।

‘পরী’ গানটির মজার গল্প আছে। ধুলো পড়া চিঠির অ্যালবামের কাজ শেষ। আর একটি গান। কারণ ১১টা গান অ্যালবাম দেওয়া যাবে না। ১২টা গান হতেই হবে।  সেই ১২টা গানের জন্য আরেকটা গান প্রয়োজন। রানা আমাকে বেশ কিছু গান দিয়ে রেখেছিল। তারমধ্যে হঠাৎ করে এই গানটির লিরিকটা আমার চোখের সামনে পড়ে যায়। তখন আমি লিরিকটা নিয়ে বসি। কারণ পরের দিনই রেকর্ডিং। কারণ তখন তো শিডিউল নিয়ে কাজ করতে হতো। তখন সারারাত জেগে এই গানের সুর করি এবং কম্পোজিশন করি। কারণ তখন আমরা সিকুয়েন্স করে কাজ করতাম। পরের দিন সকালেই রেকর্ডিং। সারারাত জেগে পরের দিন সিদ্ধেশ্বরীর ‘মিউজিক ম্যান’ স্টুডিওতে যাই, গানটা নামাই এবং তখনই গানটা গাই। সম্ভবত এই গান গাইতে আমার দুটো টেক লেগেছিল। আমার ভয়েস টেক নিয়েছেলেন শব্দপ্রকৌশলী চারু। শুধু তাই না পুরো অ্যালবামটি চারুর রেকর্ডিং করা। চারুর মিক্স করা। আমাদের ‘হৃদয়পুর’, ‘ধুলো পড়া চিঠি’ এই অ্যালবামগুলো সাউন্ডের দিক থেকে শুধু ওই সময় না, এখনো আমার কাছে মনে হয় ওয়ান অব দ্য বেস্ট ইঞ্জিনিয়ারর্ড সাউন্ড। এই হচ্ছে পরী গানের ইতিহাস। পরি গানটা যে এত মেসিভলি পপুলার হবে তা কখনো কেউ কল্পনা করিনি। আরেকটা বিশাল ভূমিকা আছে এই গানটার পেছনে, যে মানুষটিকে আমরা সবসময় কৃতজ্ঞতা জানাই, তিনি হচ্ছেন উপস্থাপক আব্দুন নূর তুষার। কারণ তুষার ভাইয়ের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘শুভেচ্ছা’তে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে গানটির ভিডিও করেন এবং তাঁর অনুষ্ঠানে এই গান প্রচার করা হয়। আর এই গান প্রচারিত হওয়ার পর ভয়ংকর রকম জনপ্রিয় হয়ে যায়। বলতে পারেন আরো পপুলারিটি যোগ হয়।

কখনো ইচ্ছে হয়

এই গানটি মূলত আমার জন্য করা ছিল না। মাসুমের লেখা। সুর করেছিলাম কিন্তু নিজের জন্য না! অন্য এক শিল্পীর জন্য করেছিলাম। শিল্পীর নামটা আমি সঙ্গতকারণেই বলছি না। এই গানের যখন ট্রেক নামানো হয়, শিল্পী যখন গাইতে আসেন তখন তার গাইতে খুব সমস্যা হচ্ছিল। গানটার মধ্যে অনেক অফ আছে। মানে একটু অফ ট্রাকের টিউন ছিল গানে। শিল্পীর গাইতে সমস্যা হওয়ায় একপর্যায়ে তিনিই বললেন, গানটা তাঁর গাওয়া ঠিক হবে না। তারপর এই গান আমি আমার ‘ধুলো পড়া চিঠি’ অ্যালবামে নিয়ে আসি। শ্রোতারাও আমার কণ্ঠে এই গান পছন্দ করলেন।  

চলেছে রাতের ট্রেন

‘রাতের ট্রেন’ অ্যালবামটি ১৯৯৯ সালে রিলিজ পায়। এই গানের সুর ও সঙ্গীত দুটোই এই সময়ের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক হাবিবের ছিল। তখন হাবিব হাবিবুল নামেই পরিচিত ছিল। এই ‘রাতের ট্রেন’ অ্যালবামে হাবিবের সুর করা দুটি গান ছিল। একটি ‘রাতের ট্রেন’ আরেকটা গানের শিরোনাম ছিল ‘ভেসেছি’। আর এই দুটো গানই মাস মাসুমের লেখা ছিল। এই গানের তেমন কোনো স্পেশাল ঘটনা নেই। তখন হাবিবের সাথে কথা হলো, সে তখন বেশ ভাল কাজ করছে এবং কাজ করার জন্য খুবই আগ্রহী। সে সূত্রে হাবিবকে বললাম, ‘হাবিব করবা নাকি দুটো গান?’ সে সঙ্গে সঙ্গে খুব খুশি হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ করব’। গান করল। ট্র্যাক নামানোর সময় হাবিব থাকতে পারেনি। ও একটু ঝামেলার মধ্যে ছিল। ও আমাকে সিকুয়েন্সটা দিয়ে দিয়েছিল। তারপর আমি নিজে স্টুডিওতে গিয়ে আমার কিবোর্ড দিয়ে নামাই। পরে হাবিব নিজে উপস্থিত থেকে আমার ভয়েস নিয়েছিল। আলটিমেটলি গানটা মানুষ এখনো যথেষ্ট পছন্দ করে।

সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে

এই গানটি দলছুট ব্যন্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ্’ এর গান। আমি এবং সঞ্জীব দা ডুয়েট গেয়েছিলাম। তুষার ভাইয়ের ‘শুভেচ্ছা’ অনুষ্ঠানে প্রথম আমরা ‘সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে’ গানটি গেয়েছিলাম। এই গানটির কিছু অংশ শুট করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে। তখন অন্ধকার হয়ে গেছে এবং গাড়ির হেডলাইট দিয়ে গানটি শুট করা হয়েছিল। কারণ কোনো লাইট ছিল না,  এমনকি পাওয়ারও পাচ্ছিলাম না আমরা। ইনফেক্ট ‘সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে’ গানটি দিয়ে দর্শকরা আমাকে, সঞ্জীব দাকে গায়ক হিসেবে চিনতে শুরু করেছিল। এই গানের লিরিক এবং সুরকার ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। সঞ্জীব দার সুরে আমি বেশ কিছু গান করেছি যেমন, ‘রাণী ঘুমাই ভর দুপুরে’, ‘তুমি চক্ষু খুলে দেখ’, ‘জড়িয়ে আছ অক্টোপাস-ক্রিতদাস-ক্রিতদাস’, ‘বালিকা জেনেছে সব’-যেটা আমাদের দলছুটের ‘আয় আমন্ত্রণ’ অ্যালবামের প্রথম গান ছিল। এই ‘বালিকা’ গানটি সঞ্জীব দার স্ত্রী শিল্পীর লেখা ছিল। আরেকটি গান ছিল, হাট্টিমাটিম হাঁটছি হাঁটছি। আরেকটি ‘হৃদয়পুর’ অ্যালবামে ‘সবুজ যখন’ নামের গানটি ডুয়েট করেছিলাম। গানটি রানার লেখা ছিল। দাদার সঙ্গে গান গাওয়ার বিষয়টি, মিউজিক্যাল ইন্টারেকশনটা আমি খুব এনজয় করতাম। দাদাও খুব এনজয় করতেন। কারণ মিউজিক্যালি আমরা ভীষণ রকম কাছের ছিলাম। দাদা তো একাধারে আমার বন্ধু, বড়ভাই। আমাকে ভীষণ রকম ভালোবাসতেন। সবকিছু মিলিয়ে দাদা আমার কাছে বিশাল এক বিষয় আমি বলব। এখন যেটা অনুভব করি, সঞ্জীব দার অনুপস্থিতি প্রচণ্ড রকম মিস করি এবং সঞ্জীব দার অনুপস্থিতি কিন্তু টু-সাম এক্সটেন্ড আমার কাজেও কিন্তু ইফেক্ট করেছে। কারণ আমার অনেক কিছুতে সঞ্জীব দাকে চাই কিন্তু সেটা আমি পাই না।

বৃষ্টি পড়ে অঝর ধারায়

গানটি আমার জন্য একটি অসম্ভব রকম সিগনিফিকেন্ট গান। কারণ হচ্ছে, এই গানের যখন মিউজিক হয় এবং ভয়েস নেওয়ার সময় সঞ্জীব দা ছিলেন এবং গানটি যখন গাচ্ছিলাম ঠিক ওই সময় আমি প্রচণ্ড রকম ইমোশনাল ছিলাম। পুরো গানটি আমি একটা ইমোশনের জায়গা থেকে গেয়েছিলাম। এটা আমার খুব প্রিয় গান।

আমার সন্তান সে তো তোমার কাছে পাওয়া

দলছুটের ‘হৃদয়পুর’ অ্যালবামের গান। এটা দুর্দান্ত একটা গান। দুর্দান্ত লেখা, দুর্দান্ত সুর। এই ‘আমার সন্তান’ গানটিও আমি খুব ইমোশনের জায়গা থেকে গেয়েছিলাম। একটা কথা বলি, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’ গানটি আমি সঞ্জীব দাকে গাওয়ার জন্য জোর করেছিলাম। সঞ্জীব দা গানটি গাইতে চাননি। সঞ্জীব দার লেখা ছিল কিন্তু আমার সুর ছিল। সঞ্জীব দা কোনোভাবেই এই গান গাইবেন না। আর আমি বলেছিলাম, ‘এই গানটি আপনি না গাইলে হবে না।’ কারণ আমি গানটির সুর করেছিলাম, সঞ্জীব দাকে মাথায় রেখেই। আবার ঠিক উল্টোভাবে ‘আমার সন্তান’ গানটি কোনোভাবেই সঞ্জীব দা নিজে গাইবেন না। সঞ্জীব দার বক্তব্য হচ্ছে ‘এই গান তুই গাইবি।’ উনার কাছে মনে হয়েছে গানটা আমি গাইলে ভাল হবে। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল গানটা সঞ্জীব দা’ই করুক। সঞ্জীব দা নিজে কোনভাবেই গানটি গাইলেন না, আমাকে বললেন, ‘তোকে দিয়েই গানটা হবে’। তো এরকম ছিল, আমাদের অ্যালবামের বিষয়গুলো, আমাদের গানের দেন-দরবার।  

চাঁদের জন্য গান- আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ

এটা সঞ্জীব দার একদম ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গা থেকে লেখা গান। সুরও করেছিলেন দাদা।  সংগীত আমার। হৃদয়পুর অ্যালবামের এই গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল সে সময়। ওই অ্যালবামে ‘দোল ভাটিয়ালি, এ নদী রূপালী’ নামে আরেকটি গানও সঞ্জীব দা’র লেখা ও সুর করা ছিল। আমার কম্পোজিশন। আসলে সঞ্জীব দা যাই লিখেছেন তা দাদার অভিজ্ঞতালব্ধ লেখা।  যা যা উনি অনুভব করেছেন যা দেখেছেন এবং তার জীবনে ঘটে যাওয়া, সেগুলো নিয়ে সঞ্জীব দা সবসময় গান লিখেছেন। তার বাইরে কিন্তু সঞ্জীব দা কখনো কোনো গান লিখেননি। সঞ্জীব দা কখনো বানোয়াট কথা নিয়ে, বানোয়াট ঘটনা নিয়ে গান লিখতে পারেননি। সঞ্জীব দার একটা বক্তব্যই ছিল, উনি সবসময়ই বলতেন, তিনি বানিয়ে লিখতে পারেন না। যেটা উনি কখনো দেখেননি, কখনো অনুভব করেননি, সেই অনুভূতি নিয়ে তিনি কখনো লিখতে পারেন না। সুতরাং ফরমায়েসি লেখা সঞ্জীব দাকে দিয়ে কখনোই হয়নি। আরেকটা তথ্য দেই, সঞ্জীব দার ভয়েস নিতে একদমই সময় লাগত না। কারণ সঞ্জীব দা প্রাণ থেকে গান করতেন। এই কারণে উনার গান গাইতে সময় লাগত না বেশি। একটা হাফ শিফটে উনি দুটি, তিনটি গান গেয়ে দিতে পারতেন। সঞ্জীব দা গানটা শুনতেন আর যদি গানটা একটু কঠিন হয়, সঞ্জীব দার যদি ভয়েস ভালো না থাকত, তাহলে তিনি একপর্যায়ে নিজেই বলতেন- ‘নারে আজকে হচ্ছে না।’ সঞ্জীব দার এবং আমার মূলত একসাথে কাজ করার কারণটাই ছিল, একই ধরনের টেস্ট। কারণ আমরা একজন আরেকজনের মিউজিক্যাল টেস্টটা খুব ভালো বুঝতাম এবং সঞ্জীব দা যে ধরনের গান পছন্দ করতেন, সে ধরনের গান আমিও পছন্দ করতাম। সঞ্জীব দা যে ধরনের গানগুলো শুনে বড় হয়েছেন সৌভাগ্যক্রমে আমিও সে ধরনের গান শুনে বড় হয়েছি। এ কারণে আমাদের যোগাযোগের জায়গাটা বেশ শক্ত ছিল। একটা চিত্র প্রদর্শনীর জন্য আমি, সঞ্জীব দা আর অশোক কর্মকার মিলে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ করছিলাম। সেই মিউজিক করতে গিয়ে সঞ্জীব দা যা বলতে চাচ্ছেন তা আমি আগেই বুঝে যাচ্ছিলাম বা সঞ্জীব দা বলার আগেই আমি করে ফেলছিলাম। এটা ১৯৯৫ সালের কথা। তখন মোটামুটিভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা একসাথে কাজ করব। টু ম্যান ব্যান্ড ফর্ম করলাম। ১৯৯৬ সাল থেকে দলছুট ব্যান্ড যাত্রা শুরু করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রথম অ্যালবাম হলো ‘আহ্’। আর ব্যান্ডের একটা নাম দিতে হবে, অনেক নামের মধ্য থেকে ‘দলছুট’ নামটা আমাদের পছন্দ হয়। এটার কোনো ইনার মিনিং ছিল না।

দিন বাড়ি যায়

এই গানের তেমন কোনো কাহিনী নেই। ‘দিন বাড়ি যায়’ অ্যালবামটি ২০০৬ সালে রিলিজ পায়। গানটি লেখা হচ্ছে রাসেল অনীলের। ওর লেখার মধ্যে অদ্ভুত রকমের একটা ফিলিং আছে- যেটা আসলে সচরাচর পাওয়া যায় না। অসম্ভব জোরালো লেখা। রাসেল কিন্তু সঞ্জীব দার ডিরেক্ট স্টুডেন্ট। সে কারণে ও সঞ্জীব দা বলতে অজ্ঞান। সঞ্জীব দাকে ছাড়া ও কিছু বোঝে না এবং লেখার ক্ষেত্রেও সে প্রচণ্ড রকম সঞ্জীব দার ফলোয়ার। সঞ্জীব দা কিন্তু ওকে হাতে ধরে ধরে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। ‘এভাবে লিখিস না ওভাবে লেখ; এই শব্দটা ব্যবহার করিস না, এই শব্দটা ব্যবহার কর।’ ওর লেখার মধ্যে সঞ্জীব দার ছাপটা প্রবল। যেকোনো গানের ক্ষেত্রে লিরিক একটা বড় কারণ। লিরিক যদি ভালো হয়, আর লিরিকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কেউ সুর করতে বসে তাহলে গানটাও আপনা-আপনি সুন্দর হয়ে যায়। এই গানও তেমনি একটি সুন্দর কথা আর সুরের গান।

লক্ষ্মীসোনা চাঁদের কণা

এটা আমার লেখা প্রথম গান। আমি সর্বসাকুল্যে তিনটি গান লিখেছি। দ্বিতীয় গান ‘ঘুম আসে না’, শেষে লিখলাম ‘কী করি’ গানটি। এই ‘লক্ষ্মীসোনা চাঁদের কণা’ গানটি হঠাৎ চাক্ষুস একটা ঘটনা দেখে মনে হলো লিখে ফেলি। আর ‘ঘুম আসে না’ আমার একেবারই নিজের অনুভূতির জায়গা থেকে লেখা। মাঝখানে বেশ কিছুদিন ঘুমের কষ্ট হচ্ছিল। ইনসমনিয়া যাকে বলে। গানের সুরটা পাকিস্তানের শাফকাত আমানত আলী খানের ‘FUZON’ ব্যান্ডের সুরের সাথে মিলে যায়। আসলে একই রাগে ওই গানটিও করা ছিল। আমার এই ‘ঘুম আসে না’ গানটিও ওই একই রাগে করেছিলাম। তাই অনেকেই বলে আমি নাকি ওদের ওই গানের সুরটি চুরি করেছি। সো তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমি চুরি করিনি, আমি একই রাগের ওপর ভিত্তি করে গানটি গেয়েছি। যাইহোক মানুষ বলতেই পারে। বাক স্বাধীনতা সবারই আছে। যদি কেউ বলেন তাহলে এটা নিয়ে যুদ্ধ করার কিছু নেই। শুধু এটুকুই বলব- এটা আমার মৌলিক গান।

আঁধারে জোছনা হয়ে

জুলফিকার রাসেলের লেখা, আমার সুর করা গান। সেমি-ক্লাসিক ফরমেটে করা। আমি অনেক মনোযোগ দিয়ে গানটি করেছিলাম। এটা আমার অনেক পছন্দের গানের মধ্যে অন্যতম। যদিও গানটা করা হয় কম। এই গানগুলো কম করার প্রধান কারণ হচ্ছে অডিয়েন্স। কারণ এই গানগুলো বুঝতে পারবে এ রকম অডিয়েন্স আমরা সবসময় পাই না। টিভি লাইভে করা যায়। জুলফিকার রাসেলের আরেকটি গান আমার সুরে গেয়েছিলেন জুয়েল ভাই আর কনকচাঁপা ‘চোখের ভেতর স্বপ্ন থাকে’। আরেকটা জুয়েল ভাইয়ের জন্য করা ‘সামনে তোমার চাঁদের পাহাড়’ গানটিও জুলফিকারের। জুলফিকার গীতিকার হিসেবে অসাধারণ। আমার সব থেকে বেশি গানের গীতিকার কিন্তু জুলফিকার রাসেল। আমার ক্যারিয়ারে, যে কজনের সঙ্গে কাজ করেছি- আমি এখন পর্যন্ত সব থেকে বেশি লেখা গান তাঁর। আমার খুব ভালো লাগে ওর লেখা। ওর লেখার মধ্যে এক অদ্ভুত রকম প্রাণ আছে। যেটা খুব খুব রেয়ার। চোখের সামনে ছবিটা ভেসে ওঠে। এটা হচ্ছে একটা গীতিকারের সব থেকে বড় গুণ বলে আমি মনে করি।

কাল সকালে বৃষ্টি হবে, ভিজবে সারা শহর

অঞ্জন দত্তের মতো বিশাল এক মানুষের সঙ্গে মিউজিকের কাজ করতে পারাটা আমার জীবনের একটা সেরা অর্জন বলে আমি মনে করি। অঞ্জন দত্তের সঙ্গে কাজ করার মূল জায়গাটাও কিন্তু জুলফিকার রাসেল করে দিয়েছিল। ও এরেঞ্জ না করলে হয়তো অঞ্জন দত্তের সঙ্গে কাজ করার সুযোগটা আমার হতো না। পুরো কৃতিত্বই আমি জুলফিকারকে দেই। কারণ ও পুরো বিষয়টাই অ্যারেঞ্জ করেছিল। এই চমৎকার লিরিকটা জুলফিকারের। সুর আমার। আর অঞ্জন দা গেয়েছেনও দুর্দান্ত। তা ছাড়া অঞ্জন দত্ত একজন মানুষ হিসেবে অসাধারণ। তিনি যত বড় মাপের মানুষ, ততখানিই বিনয়ী।

মন পবনের ঘুড়ি

ফাহমিদা নবী আপার সঙ্গে কাজ করা প্রসঙ্গে আমি একটা কথায় বলব, আমি কাজ করেছি বহু মানুষের সঙ্গে, কিন্তু ফাহমিদা আপার মতো একজন অসাধারণ শিল্পীর সাথে কাজ করতে পারাটাও আমি মনে করি, আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। তিনি মানুষ হিসেবে চমৎকার, শিল্পী হিসেবে চমৎকার একজন শিল্পী। আর সব থেকে বড় কথা হচ্ছে- এটা সবসময় সবার বেলায় হয় না, ফাহমিদা আপার সাথে আমার ভয়েসের ব্লেন্ডিংটা খুব ভালো। আমি ডুয়েট গান তেমন একটা করিনি কিন্তু সব থেকে ভালো যেটা মার্চ করেছে- সেটা আমার আর ফাহমিদা আপার ভয়েস। সে কারণে আমার আর ফাহমিদা আপার ডুয়েট গান হলে সেটা মানুষ খুব ভালোভাবে নেয়।

ইচ্ছেরি বাতাসে

এই গানটিও ফাহমিদা নবী এবং আমি ডুয়েট গেয়েছিলাম। তবে মূল গানটা ছিল আসামের গায়ক জুবিনে গার্গের সুর করা। আমি জুবিনের কাছ থেকে সুরটা নিয়েছিলাম। এই গানেরই একটা ট্রান্সলেশন ফরমেট করা হয় বাংলায়। এটা ‘ফড়িং’ নামের একটা মিশ্র অ্যালবামের গান। জুলফিকার রাসেলের লেখা, ওরই আয়োজন ছিল এবং ওরই ইচ্ছা ছিল এই গানের একটা বাংলা ফর্ম হোক। সে হিসেবেই করা। পরে এই গান বেশ জনপ্রিয়তা পায়।

তোমার বাড়ির রঙের মেলায়-বায়োস্কোপ

গানটি কবি কামরুজ্জামান কামুর। তাঁর সাথে মূল যোগাযোগের জায়গাটা সঞ্জীব দার ছিল। দাদার মাধ্যমেই কামু ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। ‘ভাঁজখোলো আনন্দ দেখাও’ গানটি কামরুজ্জামান কামু ভাইয়ের লেখা। সুরটা মূলত সঞ্জীব দা আর কামু ভাই দুজন মিলেই করেছিলেন। যদিও ফোক আঙ্গিকের। সংগীত ছিল আমার। তারপর মেসিভলি যেটা জনপ্রিয় হয়েছিল সেটা ‘বায়োস্কোপ’ গানটি। কথা ও সুর কামরুজ্জামান কামুর। তাঁকে আমরা অনেক অনেক শ্রদ্ধা জানাই। এ রকম আরো অসংখ্য  গান আমাদের দিবেন এটাই আমরা চাই।

অঝর ধারায় শ্রাবণ

আমার দাদা- পার্থ মজুমদার দার সুর ও সঙ্গীতে একটা অসাধারণ গান। একটা মিক্সড অ্যালবামের জন্য করা হয়েছিল গানটি। দাদা নিশ্চই আমার কথা ভেবে সুর করেছিলেন। আমি মনে করি বাংলাদেশে বর্তমানে যে কয়জন কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে সর্বশীর্ষে যদি কেউ থেকে থাকেন সেটা হচ্ছেন পার্থ মজুমদার। যদিও তাঁর ফোকাসটা অনেক কম। মানে অনেক আজেবাজে শিল্পী কম্পোজারকে মানুষজন চিনে, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি চেনা উচিত ছিল পার্থ মজুমদারকে। কারণ পার্থ মজুমদার আমার বড়ভাই হিসেবে বলব না, উনি মানুষ হিসেবে একজন দেবতাতুল্য। তাঁর মিউজকের মধ্যে সেই পবিত্রতা কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়। আমি মনে করি যে, উনি মিউজিশিয়ান হিসেবে আমাদের থেকে অনেক অনেক অনেক বড়। উনি অনেক কিছু জানেন। যেটা আমরা অনেক কিছু না জেনে পেয়ে যাচ্ছি। তার থেকে বেশি উনার পাওয়া উচিত ছিল।

বেঁচে থাক সবুজ

২০১২ সালে রিলিজ হওয়া ‘বেঁচে থাক সবুজ’ অ্যালবামের এই শিরোনামের গানটি এবং ‘বকুল বালা’ গানটি অনেক বেশি শ্রোতাপ্রিয় হলে আমি খুশি হতাম। দুটি গানই গুণী অভিনেতা শঙ্কর শাঁওজাল দার লেখা। শাঁওজাল দার লেখার কারণে এই গানগুলোর মধ্যে যেই গভীরতা আছে, যে কাব্য আছে এবং গানগুলোর মধ্যে যে বিষয় আছে সেই বিষয়গুলো আসলে মানুষের সামনে আসা অনেক বেশি জরুরি ছিল বলে আমার কাছে মনে হয়।

তুমি আমার বায়ান্ন তাস- বাজি

বাজি গানটা সঞ্জীব দার লেখা। মনে আছে, গানটি হাতে পাওয়ার পর আমি, মনে মনে ভেবেছিলাম এটাকে রক টাইপের কিছু একটা করব। তখন মাথার মধ্যে ‘The Police’ ব্যান্ডের ‘Every Breath You Take’ গানটি খুব ঘুরছিল। তো ওই অনুভবটা মাথায় নিয়ে এই গানের সুর করেছিলাম আমি। যদিও ওই গানের সঙ্গে আমার এই গানের কোনোই মিল নেই। কিন্তু  ‘তুমি আমার বায়ান্ন তাস’ গানটির মূল অনুপ্রেরণার জায়গাটা কিন্তু এই ‘The Police’। আর গানটির সুর করে যখন সঞ্জীব দাকে শোনাই তখন দাদা মহাখুশি। বলেছিলেন, ‘এটা তুই কী করেছিস। ভয়ঙ্কর ব্যাপার তো।’ পরে রেকর্ডিং করলাম, ভয়েস দিলাম, গান মিক্সড হলো এবং তখন থেকেই কেমন জানি মনে হচ্ছিল, গানটা শ্রোতারা অনেক পছন্দ করবেন এবং হয়েছেও তাই। আমরা কৃতজ্ঞ।