চড়া সুর, কড়া গান

সত্তরের সেরা লেড জ্যাপেলিন

Looks like you've blocked notifications!

হেভি মেটাল ঘরানার পাইওনিয়ার হিসেবে যে তিনটি ব্যান্ডের নাম বলা হয়, তাদের অন্যতম লেড জ্যাপেলিন। ব্যান্ডটির ‘স্টেয়ারওয়ে টু হ্যাভেন’ গানটি শোনেননি, এমন কোনো কড়া গানের সংগীতপ্রেমী মেলা ভার, অসম্ভবই বলা যায়। ১৯৬৮ সালে ‘ইয়ার্ডবার্ডস’ ব্যান্ডটি নাম-ঠিকানা-ঠিকুজি আর ঘরানা পরিবর্তন করে হয়ে যায় লেড জ্যাপেলিন। আর আগের ব্লুজ, সাইকাডেলিকের পাশাপাশি ফোক মিউজিকের প্রভাব সাথে নিয়ে আরও চড়া সুরে গিটার-নির্ভরতা বাড়িয়ে তাদের গানের ঘরানা আরো কড়া হয়ে ওঠে। পরে রোলিং স্টোন ম্যাগাজিন তো ব্যান্ডটিকে ‘দ্য হেভিয়েস্ট ব্যান্ড অব অল টাইম’ এবং ‘দ্য বিগেস্ট ব্যান্ড অব সেভেনটিজ’-এর স্বীকৃতিই দিয়ে দেয়! ১৯৯৫ সালে ব্যান্ডটি ‘রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেম’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্যান্ডটির অন্তর্ভুক্তির সময় লেখা হয়- সত্তরের দশকে লেড জ্যাপেলিন ততটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল, ষাটের দশকে যেমন ছিল ‘বিটলস’।

লন্ডনভিত্তিক এই ব্যান্ডটির মূল উদ্যোক্তা জিমি পেজ। তিনি ১৯৬৬ সালে বেজিস্ট হিসেবে ‘ইয়ার্ডবার্ডস’ এ যোগ দেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ব্যান্ডের দ্বিতীয় লিড গিটারিস্ট হিসেবে বাজাতে শুরু করেন। ব্যান্ডটিতে তখন লিড গিটারিস্ট ছিলেন জেফ বেক। বছরের শেষ দিকে অবশ্য বেক ব্যান্ডটি ছেড়ে দেন। তবে তখন থেকেই পেজকে দুই লিড গিটারিস্টের লাইনআপের নেশায় পেয়ে বসে। তিনি প্রথমে বেককে নিয়ে একটি লাইনআপ দাঁড় করানোর কাজ ‍শুরু করেন। ড্রামস আর বেইজে যোগ দেন ‘দ্য হু’ ব্যান্ডের কিথ মুন এবং জন এনউইসল। ভোকালিস্ট হিসেবে ভাবা হয় স্টিভ উইনউড এবং স্টিভ ম্যারিয়টের কথা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য লাইনআপটি আত্মপ্রকাশই করেনি। তবে পেজ, বেক আর মুন মিলে একটি গান রেকর্ড করেছিলেন। ‘বেকস বলেরো’ নামের ট্র্যাকটিতে ড্রামস বাজিয়েছিলেন জন পল জোন্স।

‘ইয়ার্ডবার্ডস’ শেষবারের মতো পারফর্ম করে ১৯৬৮ সালে। বেডফোর্ডশায়ারের লুটন কলেজ অফ টেকনোলজিতে। কিন্তু ব্যান্ডটির আরো বেশ কয়েকটি কনসার্টের কথাবার্তা পাকা করা ছিল। কাজেই এই নামেই তাদের আরো বেশ কিছু কনসার্ট করতে হলো। কিন্তু ব্যান্ডটির ঠিকুজি বদলে গেল ঠিকই! তখন ইয়ার্ডবার্ডসের লাইনআপ হলো- ভোকালে জিম ম্যাককার্টি, লিড গিটারে জিমি পেজ, ড্রামসে কিথ রেল্ফ এবং বেইজে ক্রিস ড্রেজা। ম্যাককার্টি ও রেল্ফ ব্যান্ড ছেড়ে দিলেন। পেজ আর ড্রেজাকে অনুমতিও দিলেন বাকি কনসার্টগুলো তারা ‘ইয়ার্ডবার্ডস’ নামেই করতে পারবেন। ওই কনসার্টগুলোর জন্য পেজ আর ড্রেজা নতুন সদস্যও নিলেন। ভোকালে পেজের প্রথম পছন্দ ছিল টেরি রেইড। রেইড অবশ্য না করে দিলেন। পরামর্শ দিলেন ‘ব্যান্ড অব জয়’-এর রবার্ট প্ল্যান্টকে নেওয়ার। প্ল্যান্টের আগ্রহেই একই ব্যান্ডের ড্রামার জন বনহ্যামকেও নেওয়া হলো।

ড্রেজাও বেশিদিন থাকলেন না নিউ ইয়ার্ডবার্ডসে। কিছুদিনের মধ্যেই ফটোগ্রাফির নেশায় মিউজিকই ছেড়ে দিলেন তিনি। তাঁর জায়গায় যোগ দিলেন জন পল জোন্স। তারপর ইয়ার্ডবার্ডসের পূর্বনির্ধারিত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ট্যুর ১৯৬৮-তে বেরিয়ে পড়লেন তাঁরা। যাওয়ার আগেই তাঁরা প্রথম রেকর্ডিং সেশনেও কাজ করে ফেললেন। পি জে প্রোবি-র অ্যালবাম থ্রি উইক হিরো-র জন্য জিম’স ব্লুজ ট্র্যাক ছিল তাঁদের প্রথম রেকর্ডকৃত ট্র্যাক। ট্র্যাকে প্ল্যান্ট হারমোনিকাও বাজান।

বছরের শেষ দিকে তাঁরা প্রথম অ্যালবামের কাজও শুরু করেন। রেকর্ড ও মিক্সিং করেন মাত্র নয়দিনের মধ্যে। পুরো খরচ বহন করেন পেজ। কিন্তু ওই অ্যালবামের শেষেই গোল বাধে। তার ফলাফলটা ভালো হলো না খারাপ, সে অবশ্য বাহাসের বিষয়। ওই গোলমালের কারণেই তাঁদের ‘ইয়ার্ডবার্ডস’ নামখানা বদলাতে হয়। তাঁদের অ্যালবাম বের করার খবর শুনেই ড্রেজা মামলা ঠুকে দেন। তাঁর দাবি, পেজকে ‘ইয়ার্ডবার্ডস’ নাম শুধুমাত্র স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ট্যুরে ব্যবহার করার জন্যই দেওয়া হয়েছিল।

অতএব ইয়ার্ডবার্ডসের তৎকালীন সদস্যরা নাম পরিবর্তন করতে বসলেন। পেজ এবং বেক যখন লাইনআপ বানাচ্ছিলেন, তাঁরা নতুন নাম ঠিক করেছিলেন ‘লেড বেলুন’। সেই নামটাই নিলেন পেজ। তবে কিছু বদল এলো। ব্যান্ডটির ম্যানেজার পিটার গ্র্যান্টের পরামর্শে ‘লেড’ থেকে ‘এ’ বাদ দেওয়া হলো। যাতে লোকজন ‘লেড’টাকে ‘লিড’-এর সাথে গুলিয়ে না ফেলে। আর বেলুনের বদলে নেওয়া হলো ‘জ্যাপেলিন’। যুক্তি, বেলুনের চেয়ে জ্যাপেলিন ব্যান্ডটির গানের ঘরানার সাথে অনেক বেশি মানানসই। ভারী এবং দাহ্য।

ব্যান্ডটি প্রথম ‘লেড জ্যাপেলিন’ নামে কনসার্ট করে অক্টোবরে। লন্ডনের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই কনসার্টের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন রিচার্ড কোল। এই রিচার্ড কোল পরেও তাঁদের ট্যুরগুলোতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ‍ভূমিকা পালন করেন।

গান দিয়ে তো বটেই, মাঠে নেমেই লেড জ্যাপেলিন চুক্তির মাধ্যমে সবাইকে চমকে দিল। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরেই পিটার গ্র্যান্ট আটলান্টিক রেকর্ডসের সাথে প্রায় দেড় লাখ ডলারের একটা চুক্তি সই করলেন। ওটা শুধু টাকার অঙ্কেই তখনকার সবচেয়ে দামি চুক্তি ছিল না, চুক্তির সব শর্তও ছিল লেড জ্যাপেলিনের অনুকূলে। শর্ত অনুযায়ী, লেড জ্যাপেলিনই তাদের অ্যালবাম ও ট্যুরের সময় নির্ধারণ করবে, তাদের অ্যালবামের ট্র্যাক ও ডিজাইন নির্ধারণ করবে, এমনকি তাদের সিঙ্গেল ট্র্যাক রিলিজের সময়ও তারাই ঠিক করবে। আর এই চুক্তিটা হয়েছিল আটলান্টিক ওদের পারফর্মেন্স দেখার আগেই, বুঝতে হবে ব্যাপারটা!

১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে লেড জ্যাপেলিন প্রথমে আমেরিকা ট্যুরে যায়। সে ট্যুরের মাঝেই তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘লেড জ্যাপেলিন’ মুক্তি পায়। তাদের প্রথম এই অ্যালবামটিই জায়গা করে নেয় বিলবোর্ড টপচার্টের সেরা দশে। একই বছরের অক্টোবরে মুক্তি পায় তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘লেড জ্যাপেলিন টু’। এই অ্যালবাম আরো বেশি সাফল্য পায়। এটা টপচার্টের শীর্ষে উঠে আসে। অনেকেই তাদের এই দুটি অ্যালবামকে চিহ্নিত করেন হার্ড রক থেকে হেভি মেটাল গড়ে ওঠার রূপান্তর-অ্যালবাম হিসেবে। বিশেষ করে দ্বিতীয় অ্যালবামটাকে দেখা হয় হেভি মেটালের মিউজিক্যাল স্টার্টিং পয়েন্ট হিসেবে।

কেবল চুক্তির শর্তেই না, ব্যান্ডটি আক্ষরিক অর্থেই গানের প্রশ্নে আপসহীন সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। সেই সময় ইংল্যান্ডে অ্যালবামের চেয়ে সিঙ্গেল ট্র্যাকের জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। তার ওপর বেশির ভাগ রেডিও-টিভিতে রক গান চালানো হতো না। রক ব্যান্ডগুলোর জন্য জনপ্রিয় হওয়ার মাধ্যম তখন কেবল ওই সিঙ্গেলগুলো। কিন্তু লেড জ্যাপেলিন আগাগোড়াই সিঙ্গেল ট্র্যাক প্রকাশের বিরুদ্ধে ছিল। তাদের কাছে পুরো অ্যালবামটাই একটা কম্পোজিশন। তাদের বেশ কিছু সিঙ্গেলস অবশ্য তাদের না জানিয়েই বাজারজাত করা হয়। বিশেষ করে আমেরিকায়। ১৯৬৯ সালের এ রকম এক পরিবেশনা ‘সিঙ্গেলস হোল লটটা লাভ’ তাদের জনপ্রিয়তা বেশ বাড়িয়ে দেয়।

এই আপসহীনতার আরেকটি প্রমাণ, তাঁরা টিভিতে গান করতে চাইতেন না, বরং সবাইকে কনসার্ট দেখতে বলতেন। টিভির ধারণকৃত গান নয়। প্রথম দিকে তাঁরা ক্লাবে, বলরুমে কনসার্ট করতেন। পরে জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে তাঁদের কনসার্টের পরিধিও বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় অ্যালবাম প্রকাশের পর তাঁরা আমেরিকাতেও নিয়মিত কনসার্ট করতে শুরু করেন। এই কনসার্টগুলোর কোনো কোনোটা চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলত। কনসার্টে তাঁরা প্রায়ই ইম্প্রোভাইজ করতেন। এগুলোর কোনো কোনোটির বুটলেগ ভার্সন পাওয়াও যায়।

১৯৭০ সালে পেজ এবং প্ল্যান্ট ওয়েলসের এক প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যান। সেখানে নির্জনে-নিরালায় বসে তাঁরা কম্পোজ করেন তৃতীয় অ্যালবামের গানগুলো- ‘লেড জ্যাপেলিন থ্রি’। এই অ্যালবামের কম্পোজিশনগুলোতে প্রভাব পড়ে ফোক এবং সেল্টিক মিউজিকের। অ্যালবামটি ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়। ইংল্যান্ড-আমেরিকা দুই দেশেরই টপচার্টের শীর্ষে ওঠে। কিন্তু সমালোচকরা অ্যালবামটিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। তাই নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গেও তাঁদের একচোট হয়ে যায়।

সত্তরের দশকের প্রথমার্ধ লেড জ্যাপেলিনের জন্য ছিল সোনায় মোড়ানো। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় তাদের চতুর্থ অ্যালবাম ‘লেড জ্যাপেলিন ফোর’। অ্যালবামটি ইতিহাসেরই অন্যতম ব্যবসাসফল অ্যালবাম। অ্যালবামের ‘স্টেয়ারওয়ে টু হ্যাভেন’ কখনোই সিঙ্গেল ট্র্যাক হিসেবে প্রকাশ হয়নি। হলে হয়তো সেটিও সর্বকালের অন্যতম বিক্রি হওয়া সিঙ্গেলে পরিণত হতো। ট্র্যাকটিকে বলা হয় ‘রেডিওতে সবচেয়ে বেশি অনুরোধকৃত ও প্রচারকৃত রক গান’। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় তাদের পঞ্চম অ্যালবাম ‘হাউসেস অব দ্য হোলি’, ৭৫-এ ‘ফিজিক্যাল গ্রাফিত্তি’। প্রতিটি অ্যালবামই টপচার্টের শীর্ষ দশে জায়গা করে নেয়।

সত্তরের দশকের প্রথমার্ধ লেড জ্যাপেলিনকে এক অন্য উচ্চতায় তুলে দেয়। তারা হয়ে ওঠে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যান্ড। তাদের মিউজিকের সাফল্যের পাশাপাশি তাঁদের রংচঙে পোশাকের বর্ণিল উপস্থাপনাও তাঁদের অনন্য করে তোলে। তবে তাঁরা এর চেয়েও বেশি আলোচনার খোরাক জোগান উন্মত্ত জীবনযাপনের কারণে। তাঁদের চলাফেরার জন্য নিজস্ব বোয়িং ৭২০ বিমান কেনা হয়, নাম দেওয়া হয় ‘স্টারশিপ’। থাকার জন্য একটা হোটেলের একটা অংশ পুরোটাই ভাড়া করা হয়, নাম দেওয়া হয় ‘রায়ট হাউস’। একবার জন বনহ্যাম বাইক চালিয়ে দেন সোজা সেই রায়ট হাউসের ভেতর দিয়ে। আরেকবার তাঁরা টোকিও হিলটনের একটা ঘরই ধ্বংস করে দেন। আর জানালা দিয়ে টেলিভিশন ফেলে দেওয়ার জন্য তাঁরা ছিলেন ‘বিখ্যাত’!

১৯৭৫ সালে লেড জ্যাপেলিন তখনকার ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় হলো আর্লস কোর্ট এরেনাতে টানা পাঁচ রাত পারফর্ম করে। প্রতি রাতেই সব টিকেট আগেই বিক্রি হয়ে যায়। মাঝে বেশ একটা বিরতি দিয়ে আমেরিকা ট্যুর। আর সেই ছুটিতেই দুর্ঘটনায় পড়েন রবার্ট প্ল্যান্ট। স্ত্রী মরিনকে নিয়ে তিনি ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন গ্রিসে। সেখানে রোডস দ্বীপে গাড়ি দুর্ঘটনায় মরিন প্রায় মরতেই বসেছিলেন। সে যাত্রা সবাই বেঁচে গেলেও পরের বছরের কনসার্টগুলো বাদ পড়ে যায়। সে অবসরে অবশ্য তাঁদের কনসার্ট ফিল্মটার কাজ শেষ করা হয়। ২০ অক্টোবর মুক্তি পায় ‘দ্য সং রিমেইনস দ্য সেম’ নামের সিনেমাটি।

পরের বছর থেকেই আবারও তাদের কনসার্ট-ট্যুর শুরু হয়ে যায়। একাধিক বার সে সময়ে কনসার্টে বেশি উপস্থিতির রেকর্ড ভাঙে ব্যান্ডটি। প্রথমবার ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল সিলভারডোম কনসার্টে। ৭৬ হাজারেরও বেশি দর্শক উপস্থিতি ছিল সেই কনসার্টে। টিকেট না পাওয়া হাজারখানেক ভক্তের দাঙ্গা-হাঙ্গামায় পুলিশ ৭০ জনকে আটক করে। পরের কনসার্টটি হয় ১৯৭৯ সালের আগস্টে। কোপেনহেগেনের নেবওয়োর্থ মিউজিক ফেস্টিভ্যালে তাদের পারফরম্যান্স দেখতে জড়ো হয় এক লাখেরও বেশি মেটালহেড।

প্রথম কনসার্টটির কয়েক দিন পরেই ৩ জুন লেড জ্যাপেলিন -এর একটি কনসার্ট খারাপ আবহাওয়ার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। টিকেটে অবশ্য লেখা ছিল, ঝড় হোক কি রোদ হাসুক, কনসার্ট চলবে। কিন্তু বজ্রপাতের পর আর ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি কনসার্ট কর্তৃপক্ষ। ফলাফল, দাঙ্গা-হাঙ্গামা। আবারও পুলিশের হাতে ভক্ত আটক।

১৯৮০ সালের ২৭ জুন। জার্মানির নুরেমবার্গে এক কনসার্টে পারফর্ম করছিল লেড জ্যাপেলিন। তৃতীয় গানের মাঝপথে হঠাৎই থেমে গেল সবকিছু। ড্রামস বাজাতে বাজাতে হঠাৎই ঢলে পড়ে যান জন বনহ্যাম। স্টেজ থেকে সোজা হাসপাতালে। সে যাত্রা অবশ্য বেঁচে যান বনহ্যাম। লেড জ্যাপেলিন-এর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বেশি খাওয়ার জন্যই এমন দুর্ঘটনা। সংবাদমাধ্যমে তার সঙ্গে খানিকটা অনুমান জুড়ে দিল। সেই খাওয়ার বস্তুটি নির্ঘাত মদ, নয়তো আর কি!

২৪ সেপ্টেম্বর। ব্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট রেক্স কিংয়ের সাথে প্র্যাকটিসে আসার পথে নাশতা করতে থামলেন বনহ্যাম। নাশতা সারলেন একটা হ্যাম রোল আর ৪ পেগ ভদকা দিয়ে। স্টুডিওতে এসেও সারা দিনই পেট পুরে মদ খেতে থাকলেন। রাত পর্যন্ত চললো অনুশীলন। তারপর সবাই মিলে গেলেন পেজের উইন্ডসরের বাসায়। সেখানে গিয়ে বনহ্যাম ঘুমিয়ে পড়লেন। রাত পৌনে ২টার দিকে জোন্স ও বেনজি (ব্যান্ডের নতুন ম্যানেজার) আবিষ্কার করলেন, বনহ্যাম মারা গেছেন। ময়নাতদন্তে অবশ্য উঠে এসেছে, মদ-টদ নয়, তার মৃত্যুর কারণ অ্যাসফিক্সিয়েশন বা আকস্মিক অক্সিজেন স্বল্পতা। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ১০ অক্টোবর তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

বনহ্যামের মৃত্যুর পর জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়, কে হতে যাচ্ছে লেড জ্যাপেলিনের নতুন ড্রামার? বাতাসে বেশ কিছু নামও ভাসতে থাকে। কোজি পাওয়েল, কারমিন অ্যাপিস, ব্যারিমোর বারলো, সায়মন কার্ক, বেভ বেভান। ৪ ডিসেম্বর একটি ঘোষণার মাধ্যমে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটায় লেড জ্যাপেলিন। এক লিখিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানিয়ে দেয়, বনহ্যামের মৃত্যুর পর তাঁরা আর লেড জ্যাপেলিনকে এগিয়ে নিতে চান না। নিচে স্বাক্ষরের জায়গায় স্রেফ লেড জ্যাপেলিন-এর নাম।

এরপরও অবশ্য ব্যান্ডটির আরেকটি অ্যালবাম বের হয়। সেটি অবশ্য ঠিক নতুন অ্যালবাম নয়। ব্যান্ডটির পুরোনো যেসব অ্যালবামে ঠাঁই না পাওয়া কম্পোজিশনগুলো ছিল, সেগুলো নিয়ে ১৯৮২ সালে প্রকাশ করা হয় কোডা। এ ছাড়া বেশ কয়েকবার লেড জ্যাপেলিন-এর জীবিত তিন সদস্য জিমি পেজ, রবার্ট প্ল্যান্ট ও জন পল জোন্স একসাথে মঞ্চে উঠেছেন। প্রথম তারা একসাথে মঞ্চে ওঠেন ১৯৮৫ সালে, ফিলাডেলফিয়ায় লাইভ এইড কনসার্টে। পরে ১৯৮৮ সালে আটলান্টিক রেকর্ডসের ৪০ বছর পূর্তিতে এবং ১৯৯৫ সালে রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেমে তাদের অন্তর্ভুক্তির অনুষ্ঠানে একমঞ্চে হাজির হয় লেড জ্যাপেলিন। আর সে অনুষ্ঠানে পেজ-প্ল্যান্টকে উদ্দেশ্য করে জোন্সের বক্রোক্তিই বলে দেয়, তাদের মধ্যে বেশ একটা দূরত্ব চলে এসেছে।

ব্যান্ডটির জীবিত তিন সদস্য শেষবার একত্রে মঞ্চে ওঠেন ২০০৭ সালে, আহমেত এর্তেগান ট্রিবিউট কনসার্টে। কনসার্টটি অনলাইনে টিকেটের চাহিদার ভিত্তিতে গিনেস বুকে নাম লেখায়। দুই কোটি মানুষ অনলাইনে টিকেট কেনার জন্য আবেদন করে। ড্রামস বাজান জন বনহ্যামের ছেলে জ্যাসন বনহ্যাম। লেড জ্যাপেলিন-এর পারফরম্যান্সে সবাই মুগ্ধ হয়। পেজ, জোন্স ও জ্যাসন লেড জ্যাপেলিন পুনর্গঠনে আগ্রহও প্রকাশ করে। কেবল বেঁকে বসেন প্ল্যান্ট। তাঁর বদলে প্রথমে অ্যারোস্মিথ-এর ভোকালিস্ট স্টিভেন টেইলর ও পরে অল্টার ব্রিজ-এর মাইলস কেনেডিকে বিবেচনা করা হয়। শেষমেশ ২০০৯ সালে এসে তাঁরা লেড জ্যাপেলিন-এর পুনর্গঠনের আশা চূড়ান্তভাবে ত্যাগ করেন। শেষ পর্যন্ত তাই সত্তরের দশকের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই হেভি মেটালের পাইওনিয়ার ব্যান্ডটিকে আবার নতুন করে মঞ্চে দেখার আশা বাদ দিতে হয় দুনিয়ার মেটালহেডদের।

লেড জ্যাপেলিন সদস্য

জিমি পেজ- গিটার

রবার্ট প্ল্যান্ট- ভোকাল

জন পল জোন্স- বেইজ, কীবোর্ড

জন বনহ্যাম- ড্রামস

অতিথি ড্রামার (বনহ্যামের মৃত্যুর পর)- টনি থমসন (১৯৮৫), ফিল কলিন্স (১৯৮৫), পল মার্টিনেজ (১৯৮৫), জ্যাসন বনহ্যাম (১৯৮৮, ১৯৯৫, ২০০৭), মাইকেল লি (১৯৯৫)

লেড জ্যাপেলিনের অ্যালবামগুলো

লেড জ্যাপেলিন (১৯৬৯)

লেড জ্যাপেলিন টু (১৯৬৯)

লেড জ্যাপেলিন থ্রি (১৯৭০)

লেড জ্যাপেলিন ফোর (১৯৭১)

হাউসেস অব দ্য হোলি (১৯৭৩)

ফিজিক্যাল গ্রাফিত্তি (১৯৭৫)

প্রেজেন্স (১৯৭৬)

ইন থ্রু দ্য আউট ডোর (১৯৭৯)

কোডা (১৯৮২)

গুরুত্বপূর্ণ ট্যুর ও কনসার্ট

লেড জ্যাপেলিন ইউকে ট্যুর উইন্টার ১৯৭১

লেড জ্যাপেলিন অস্ট্রেলেশিয়ান ট্যুর ১৯৭২

লেড জ্যাপেলিন নর্থ আমেরিকান ট্যুর ১৯৭২

লেড জ্যাপেলিন ইউকে ট্যুর ১৯৭২-৭৩

লেড জ্যাপেলিন ট্যুর অব নর্থ আমেরিকা ১৯৭৩

লেড জ্যাপেলিন নর্থ আমেরিকান ট্যুর ১৯৭৫

লেড জ্যাপেলিন কনসার্ট ট্যুর অব নর্থ আমেরিকা ১৯৭৭

নেবওয়োর্থ মিউজিক ফেস্টিভ্যাল, কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক ১৯৭৯

লেড জ্যাপেলিন ইউরোপিয়ান ট্যুর ১৯৮০