গান কথা গল্প
নিজেকে মজা করে ‘গতিকার’ বলি : আশিকুজ্জামান টুলু
সেই ছোট্টবেলা বাবা ওস্তাদ মুন্সী রইস উদ্দিনের কাছে যখন ফেরদৌসি রহমান, আব্দুল আলীমের মতো গুণী শিষ্যরা এসে তালিম নিতেন, তখন নিতান্তই ছোট্ট বালক তিনি। সংগীতের তেমন কিছু না বুঝলেও খেলাধুলার মাঝেই বাবার সুর লহর মনের ভেতর চলে যেত তাঁর। সেই অর্থে সংগীতজ্ঞ বাবার কাছ থেকে হাতেখড়ি না হলেও মনেখড়ি যে হয়েছিল তা তো বলাই যায়।
১৯৭৩ সালে প্রিয় বাবার মৃত্যুর পর উদীচীতে যাওয়া বড় ভাইয়ের সঙ্গে কখনো তবলা, কখনো বঙ্গ বাজিয়েছেন। অতঃপর ধীরে ধীরে সময়ের স্রোতে যখন তিনি বালক থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক হয়ে উঠছেন তখন ড্রাম, গিটার, কীবোর্ড এসব যন্ত্র সঙ্গী হয়ে উঠতে থাকে তাঁর। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন একাধিক সংগীতযন্ত্র বাদনে পারদর্শী। এরপর ‘চাইম’, কিছুদিন পর ‘আর্ক ব্যান্ডে’র কাণ্ডারি হয়ে ওঠেন তিনি- নাম আশিকুজ্জামান টুলু।
মা আলেয়া বেগম আর তিন ভাই এক বোনের সবার আদরের ছোট ছেলে টুলু। শুধু পরিবারের গণ্ডিতেই আটকে থাকেননি এই মানুষটি। নব্বই দশকের অনেক কালজয়ী গানের স্রষ্টাও হয়েছেন তিনি। আর এ কারণেই এখনো টুলুর নাম ভুলতে পারেনি এ দেশের সংগীতাঙ্গন। তিনি যেমন পশ্চিমা ধাঁচের ও রক গানের জন্য সুর করেছেন, ঠিক তেমনি রাগাশ্রয়ী সুরও করেছেন, এতে বাংলা গান হয়েছে ঋদ্ধ।
সংগীতশিল্পী, সংগীত পরিচালক, আর্ক ব্যান্ডের অভিভাবক টুলু একসময় দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান কানাডায়। তবে তাঁকে আজও ভোলেননি সংগীতপ্রেমী ও ভক্তরা। না ভোলার কারণ তাঁর অসাধারণ সব গান, সে হোক আধুনিক কি ব্যান্ডসংগীত। আজ আমরা জানব তাঁর গাওয়া অথবা সুর করা জনপ্রিয় গানগুলোর পেছনের কথা, গান নিয়ে নানা গল্প ও সতীর্থ গায়কদের নিয়ে অনভূতির কথা।
আমার হৃদয়ে তুমি
‘আমার হৃদয়ে তুমি’ গানটি লিখেছি আমি, সুর এবং গেয়েছিও আমি। এটা আসলে আমার স্ত্রীর সাথে মানে যখন আমাদের বিয়ে হয়নি তখন ওকে চিন্তা করেই গানটি লিখেছিলাম। পরে আমাদের আর্ক ব্যান্ডের ‘তাজমহল’ অ্যালবামে গানটি গাই। এটাকে আমার সত্যিকার জীবনের প্রেম পর্বের গান বলা যেতে পারে। আসলেই খুবই মেমোরেবল গান এটি। এই গানটি সুর করা আর লেখা একসাথেই হয়েছে। আর যেহেতু নিজের লেখা আর নিজের সুর তাই সুর করতে করতে বা লিখতে লিখতেই সুরটা দাঁড়িয়ে যায়। ১৯৯৫ সালের ঘটনা এটি। এই গানটি গাওয়ার পরও জানতাম না গানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কি না! তবে এখন যখন ফেসবুকে অনেকে বলে, ‘ভাই আপনার এই গানটি খুব পছন্দের’, তখন ভালো লাগে। কারণ তখন আমাদের এত ফিডব্যাক পাওয়ার সুযোগ ছিল না। এখন তো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম আছে। ফেসবুকে সবই বোঝা যায়, কী হচ্ছে না হচ্ছে। তখন তো এসব ছিল না।
আমি এই গানটি স্টেজে গাইতাম না। আসলে আমি স্টেজে গান গাইতে ততটা আগ্রহী না। আমি গান না গাইতে পারলেই খুশি হতাম। একান্তই গাইতে হলে ‘ওরে আমার পাগল মন’ গানটা গাইতাম। মানুষ ভাবতে পারে ভাব ধরছি। তবে এটাই সত্য। আমি গানই গাইতে চাইনি। আমি প্রায়ই বলি, আমি গায়ক হতে আসি নাই ভাই। মানে এসে বসি নাই, ধাক্কা খেয়ে বসেছি- এই টাইপ। ভানুর কমেডিটার মতো আর কি! সবাই মিলে ঠেলা দিয়ে আমাকে গায়ক বানিয়ে দিয়েছে। (হাসি)
ওরে আমার পাগল মন
এই গানটি আসলে পঞ্চমের গান। বেসিক্যালি পঞ্চমের কাছ থেকে যা শোনা গেছে তা হলো, ওর দুলাভাই ইজাজ খান স্বপন বলছিলেন, এটা নাকি ওদের বাসার কাজের বুয়ার লেখা এবং সুর করা গান। এই টাইপের একটি গল্প ছিল। কিন্তু বস্তুত আমাদের কাছে পঞ্চমই গানটি নিয়ে এসেছিল বলে আমরা এই গানটিকে পঞ্চমের গান হিসেবেই জানি। তো গানটি যখন আনা হলো তখন মাস্টার জমা দেওয়ার মাত্র তিনদিন বাকি। সর্বশেষ একটা গান করতে হবে। ধামাধাম এই গানটার কম্পোজিশন করা হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো গানটি গাইবে কে? শামীমকে বলা হলো তোমার যেহেতু গলাও আছে, তুমি এই গানটি গাও। ও বলল, না! ও রক গান ছাড়া ফোক গান গাবে না। সে ফোকটোক এসবের মধ্যে নাই, আমরা যেহেতু রক গাচ্ছি সেহেতু তাকেও রক দিতে হবে। আমি বললাম, ‘তোমার গলায় মানাবে দেখেই বলা। অন্তত আমার বোধশক্তি তাই বলে। আর হাসান, পঞ্চম গাইলেও ভালো লাগবে না।’ এসব বলার পরও শামীম রাজি হলো না। পরে পঞ্চমকে গাওয়ার জন্য বললাম। ও বলল, ‘ভাই কী বলেন এই গান গাইলে হবে?’ ওর গলায় নাকি মানাবে না। তখন পঞ্চম আর হাসান দুজন মিলে আমাকে গাওয়ার জন্য জোর দিতে থাকে। আমি বললাম, ভাই আমার গলা তো ‘আমার হৃদয়ে তুমি’ এই টাইপ গান গাওয়ার জন্য। ‘ওরে আমার পাগল মন’ তো সলিড ফোক গান, এর জন্য স্ট্রং গলা দরকার। ওরা বলল, ‘ওই হইবো দিয়া দেন’। পরে বাসায় একটু প্র্যাকটিস করলাম। আমার কথা হলো যা হয়, এর চেয়ে বেশি আর দিতে পারব না। পরের দিন স্টুডিওতে গিয়ে গানটি গেয়ে দিলাম। আমি গাওয়ার পর বললাম, ‘ভাই এইটুকুই পারব। আর পারব না।’ ওরা বলল, ‘না ভালো হইছে, খারাপ হয়নি।’ তারপর মাস্টার করে তাড়াতাড়ি জমা দিয়ে দিলাম। এই গানটি আমার কাছে মনে হয়েছে ফিতা ভরার জন্য গান। ১২টা গান তো ফিলাপ করতে হবে। ওমা! পরে দেখি ‘তাজমহল’ অ্যালবামের এই ‘ফিতা ভরা’ গানটিই ব্যাপক হিট হয়ে গেল। তখন শামীম এসে আমায় ধরছে, ‘তোরা আমারে এই গানটি দিলি না!’ তখন আমরা বললাম, ‘তোরে তো সাধা হইল, তুই রক গাইবি, ফোক গাইবি না।’ কিন্তু গানটি গাইলে ইতিহাস হয়ে যেত শামীম। গানটি না গেয়েও শামীম এখনো ইতিহাস হয়ে আছে আমাদের কাছে।
হেসে খেলে এই মনটা আমার
কাউসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা এবং মাকসুদের গাওয়া গান। আমি কাউসার ভাইয়ের লেখা ওই সময় খুব পছন্দ করতাম, এখনো করি। যেহেতু ‘স্টারস’ মিক্সড অ্যালবামটি একটি নতুন ভাবনা, কেন যেন মনে হয়েছিল এই অ্যালবামে কাউসার ভাইয়ের একটি হলেও গান থাকা দরকার। যদিও একটি নয়, একাধিক গান ছিল এবং আমার মন বলছিল গানটি আমি অ্যালবামের প্রথম গান হিসেবে দেব। ওই সময়টাতে মাকসুদ প্রচণ্ড জনপ্রিয় ছিল। এখনো পপুলার। কিন্তু ওই সময় তার একটা সময় চলছিল। তো এই গানটি যখন আমি সুর করলাম, তার পরপরই মনে হলো এটা মাকসুদ ভাই পারফেক্ট গাইতে পারবে। এই গানের ক্ষেত্রে আগে কথা নিয়ে সুরটা করলাম। সুর করার পর এই সুরটা মাকসুদকে ম্যাচ করল। মাকসুদ ভাই গানটি গলায় তুললও সুন্দর, এবং গাইলও খুব ভালো। পরে অনেকেই এই গানটি পছন্দ করেছে। ১৯৯৩ সালে এই মিক্সড অ্যালবামটি রিলিজ হয় এবং এটিই বাংলাদেশের প্রথম মিক্সড অ্যালবাম।
আসলে ব্যাপারটা এমন যে, আমার ছোট থেকেই অন্যদেরকে দিয়ে গান গাওয়ানোর খুব ইচ্ছা। আমি নিজে গায়ক হওয়ার ইচ্ছা কোনোদিনই ছিল না। আমি সবাইকে দিয়ে গান গাওয়াব, সংগীত পরিচালক হব- ওই স্বপ্নটাই ছিল। তো তখন শুরুর দিকে, যখন আমি সুর করতাম তখন কেউ আমার গান গাইতে চাইত না। এ জন্য আমার খুব কষ্ট হতো। কেউ আমাকে সিরিয়াসলি নিত না। গান দিলেও ‘আচ্ছা ঠিক আছে, গাব’, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, গাবোনে', ‘পরে দেখব’ এ রকম একটা ব্যাপার ছিল। তো যখনই সুযোগটা পেলাম যে, আমি ১৯৯০ পর্যন্ত 'চাইম' ব্যান্ডে ছিলাম এবং ঐ সালেই 'চাইম' থেকে বের হয়ে ১৯৯১ সালে 'আর্ক' ব্যান্ড গঠন করলাম। ব্যান্ডে থাকা অবস্থায় বাইরে কাজ করতাম না। মানে একটা নিষেধাজ্ঞা ছিল এবং ব্যান্ডের অন্যরাও বাইরে কাজ করত না। কিন্তু পরে ব্যাপারটি আমি সবার জন্য একটু ফ্লেক্সিবল করলাম। অন্যান্য সদস্যরাও ব্যান্ডের বাইরে কাজ করতে পারবে এবং আমিও পারব। আসলে শুধুমাত্র ব্যান্ড নিয়ে থাকলে হবে কি, একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নের গান করতে হবে, এর বাইরে যাওয়া যাবে না। যখনই এই স্বাধীনতাটা সবার এলো তখনই দেখা গেল হাসানও একটু বাইরে কাজ করছে, পঞ্চম করছে, আমিও একটু বাইরে কাজ করছি। এটা ১৯৯৩ সালের কথা বলছি।
আমার কাছে মনে হলো এমন কিছু করতে হবে যে, যাতে করে কম কাজে বেশি আর্টিস্টকে আমি কাভার করতে পারব। অনেকজন আর্টিস্টের মধ্য দিয়ে আমার বিভিন্ন ধরনের গান যাবে। ফলে আমার ভার্সেটাইলিটি আমি প্রকাশ করতে পারব এবং বিভিন্ন ধরনের গান করতে পারব। সবাইকে নিয়ে একটি অ্যালবামের কাজ করার চিন্তাটি যখন মাথায় এলো, তখন আমি সাউন্ডট্র্যাকের কর্ণধার বাবুল ভাইকে বিষয়টা বললাম। উনি খুবই ওপেন মাইন্ডের লোক ছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার এই প্রস্তাবটি লুফে নিলেন। 'টুলু ভাই, আপনি করেন। টাকা-পয়সা যা লাগে আমি দিমু। আপনি কইরা যান, আগায়া যান।’ উনি তো ঢাকাইয়া ছিলেন, তাই এভাবে চমৎকারভাবে কথা বলতেন। সত্যি সত্যি আমি অ্যালবামের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। শুরু করে দিলাম। আর যতজন শিল্পীর কাছে আমি গেলাম তারা সবাই আমার এই প্রস্তাবটি আনন্দে গ্রহণ করলেন।
গুড প্লান, গুড আইডিয়া এবং গুড স্টাইল। মনে আছে অ্যালবামের কাজ শেষ করে আমরা সবাই বেশ একটি অদ্ভুত ধরনের ছবি তুলেছিলাম। ছবিতে কেউ শার্ট তুলে, কেউ শার্টের হাত গুটিয়ে, পা গুটিয়ে, মুখ ভেংচি কেটে পোজ দিলাম...অদ্ভুত ছবি! ওইটা থেকেই আইডিয়া এসেছে যে, এতগুলো লোককে একসাথে আমার কাভার করতে হবে। অর্থাৎ এক ক্যাসেটেই আমি দশ রকমের, বারো রকমের, চৌদ্দ রকমের গান করব। এই কারণেই মিক্সড অ্যালবামের পরিকল্পনাটি করা হয়েছিল। এই অ্যালবামগুলো সাধারণত ঈদের সময় বের হতো, ঈদের সময়ই বেশ বিক্রি হতো। তখন ১০-১২টা এমনকি ৩০-৪০টা অ্যালবাম বের হতো। ঈদকে টার্গেট করেই মূলত অ্যালবাম বের হতো।
এই দূর পরবাসে তারা গুনি আকাশে আকাশে
চমৎকার এই গানটি লিখেছেন আসিফ ইকবাল। এই গানটি লেখার পর ১৯৯৬ সালে আমি সুর করি। মানে বিদেশ যাওয়ার আগে আগেই। আমি তখন জানি আমি বিদেশ যাচ্ছি। কারণ তখন অলরেডি আমি ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করেছি। অন প্রসেস হয়ে যাবে। তো মনে হয়েছিল এই গানটি করি। চমৎকার একটা গান। তো আগেই উপলব্ধি করতে পারতাম, বিদেশে গেলে কী হয়। কারণ এমনি আমি সাবিনা ইয়াসমিন আপার সঙ্গে বাজানোর কারণে বিভিন্ন দেশে যাওয়া হয়েছিল। তো ওখানে গিয়ে প্রবাসীদের দেখেছি ওদের কষ্টটা কতটুকু। আসলে ওই উপলব্ধি থেকেই গানটা গাওয়া। মানে প্রবাসী হওয়ার আগে গেয়েছিলাম। আর প্রবাসী হওয়ার পরে বুঝলাম কি গেয়েছি আমি...!
১৯৯৬ সালে গেয়েছি আর ১৯৯৮ সাল থেকে নিজেই প্রবাসী। গানটি অদ্ভুতভাবে আমার জীবনের সঙ্গে মিলে গেছে। আর এই গানটি কিন্তু সবচেয়ে ভালো অনুধাবন করতে পারে প্রবাসীরাই। এইখানে যারা আছেন তারাও হয়তো করেন। কিন্তু তারা হয়তো ভালো গান, কথা বা সুর ভালো এসব ভাবনায় গানটি অনুধাবন করেন। কিন্তু প্রবাসীরা সত্যিকার উপলব্ধিটাই করতে পারেন। কারণ গানটির কথাগুলো তাদের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। আর আমি যেখানেই যাই, গানটি আমাকে করতেই হয়। আসলে ওই যে বলেছিলাম, গান গাওয়ার পর বসে থাকতাম না, গানটি হিট করল কি না। গান হয়েছে মানেই তো শেষ। অন্য নতুন কোনো গানে চলে যেতাম। পরে এখন এসে হয়তো বুঝলাম, আরে গানটা তো মানুষ মনে রেখেছে।
আমি একাকী, একাকী, একাকী
এই গানটি হাসানের লেখা, ওর সুর। 'তাজমহল' অ্যালবামের গান। এই গানটি যখনই করা হলো, আসলে কোন গান আগে যাবে- কোন গান পরে যাবে তা আমরা হিসাব করতাম না। আগে গান করে ফেলতাম এবং গানের ভিত্তিতে, ভালোলাগার ভিত্তিতে আমরা নির্ধারণ করতাম কোন গানটা কোথায় যাবে। গানটা কম্পোজিশন করার পর দেখলাম যে, গানটা বিউটিফুল। রিদমটাও বেশ সুন্দর। গানটার মাঝে এক ধরনের অ্যাটাক আছে। এটা ভেবেই কম্পোজ করেছিলাম মূলত। গানের শুরুতেই 'একাকী' বলে যে টানটা, তা মানুষকে অনেক টেনেছে খুব। এ ছাড়া হাসানের আরো 'গুরু তোমার এমন বাণী' এই গানটিতে আমাদের আর্ক ব্যান্ডের ড্রামার ক্লাস সেভেন/এইটে পড়ুয়া সেই ছোট্ট ছেলে রেজওয়ান দুর্দান্ত ড্রাম বাজিয়েছে। গানটি করার পরে আমাদের নিজেদেরই অনেক ভালো লেগেছে।
সুইটি, তুমি আর কেঁদো না
এই গানটি করার পরই বুঝেছিলাম গানটি খুব জনপ্রিয় হবে। এটিও হাসানের লেখা ও সুর করা। গানটি খুব অদ্ভুত একটা গান। কিন্তু হাসানের লেখা ও সুর করে গাওয়া গানের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গান হচ্ছে..
'যারে যা উড়ে যা,
পাখি তারে বলে যা,
সে যেন আমারে
কখনো ভুলে না,
যারে যারে যা।’
গানটি শুনলেই আমার লতা মুঙ্গেশকরের 'যা-রে, যারে উড়ে যারে পাখি' গানটির কথা মনে পড়ত। আমার কাছে কেন জানি মনে হয় গানটার একটা প্রভাব হাসানের এই গানে আছে। এটিও 'তাজমহল' অ্যালবামের গান। আমরা রেকর্ডিংয়ে ট্র্যাক তৈরি করার আগেই বাসায় বসে নিজেরা খুব প্র্যাকটিস করতাম। আমাদের 'তাজমহল', 'জন্মভূমি' অ্যালবামগুলো আজিমপুরের সাউন্ড গার্ডেনে রেকর্ড করা হয়েছিল। এই হাসানকে আমি সন্তানের মতোই ভালোবাসি। ও খুব সহজ-সরল একটা ছেলে। ও যখন প্রচণ্ড জনপ্রিয়, তখন ওকে দেখে অনেকেই নেশা করত বা উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করত বলে মনে করলেও, হাসান কিন্তু সেসব কিছুই করত না। সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। গানের জন্য খুব ডেডিকেটেড একটা ছেলে।
আসলে আমি চলে যাওয়ার পর ও অনেক একা হয়ে যায়। ও পলিটিকসের শিকার হয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়। কিন্তু ওর মতো ভয়েস আর আসবে বলে মনে হয় না। হাসানকে ১৯৯৩ সালের দিকে পঞ্চমই আমার কাছে নিয়ে আসে। পঞ্চমই এসে বলল, টুলু ভাই ছেলেটিকে দেখেন। কী দারুণ গলা। কিছু করা যায় নাকি। আনার পর দেখলাম, আরে একি! একেবারে পল্লীগীতি গায় কিন্তু গলা আবার ওয়েস্টার্ন। আরে ওকে দিয়ে তো একটা ওয়েস্টার্ন টাইপ গান করানো যায়। তখন 'কপিয়ার' নামে একটি ক্যাসেট করি। যেখানে সব কপি গান। অর্থাৎ সব ইংরেজি গানের অরিজিনাল সুর এবং বাংলা লিরিক দিয়ে ক্যাসেটি করেছিলাম। একটা ই্উনিক আইডিয়া ছিল। বাংলা কথাটা হুবহু অনুবাদ করা হয়নি। আমাদের মতো করে লেখা হয়েছে। কিন্তু সুর আসল। এ জন্য নামও দিয়ে দিয়েছি 'কপিয়ার'। পরে তো এর জনপ্রিয়তার কারণে 'কপিয়ার-টু' করতে হয়েছিল। ওকে আমি প্রথম কপিয়ারে গাওয়ালাম এবং তার সাকসেসের রেটটা দেখলাম। আর হাসানও বেশ কিছু গান খুব ভালো গাইল। ওর গলার টোন, স্টাইল সবকিছু ভালো লাগল, তখনই আর লোভ সামলাতে পারলাম না! পঞ্চমকে বললাম, 'চলো হাসানরে নিয়া নেই’, পরে হাসান আর্কে ইন করল।
ভেবো না এই কান্না
এই গানটি আমার খুব প্রিয় একটি গান। গানটি লিখেছিল সাঈফ এবং গানটি আমি রেঁনেসা ব্যান্ডের নকিব খান ভাইকে দিয়েছিলাম। এই গানটি ওনাকে দেওয়ার পেছনে ব্যক্তিগত ভালো লাগা, ভালোবাসার ব্যাপার ছিল। একটা বিষয়ও ছিল, যা পাবলিকলি বলাটা যৌক্তিক হবে না। মোটকথা, এই মানুষটি তখন এক ধরনের কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। দূর থেকে এটা আমার কাছে মনে হয়েছিল, হয়তো ওনার নাও হতে পারে। আমার কাছে মনে হয়েছিল বলেই, এই গানটি আমি ওনার জন্যই করি। গীতিকারকে বলি এ ধরনের একটি লিরিক লিখে দিতে। যেখানে কোনো কিছুর জন্য থেমে থাকব না, আমার মধ্যেও এক ধরনের আগ্নেয়গিরি আছে। গানটি একটু সাসপেন্স ধরনের গান হবে। লেখাও হলো মনের মতো। মিউজিকটাতে সাসপেন্স, টোটাল গানের সিচুয়েশনটাতে সাসপেন্সকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম। আমার কিন্তু সাসপেন্স মিউজিক খুব ভালো লাগে। এ সুরটা আমার একদম ভেতরের সুর, একদম ব্যক্তিগত সুর।
কোনো এক সুন্দরী রাতে
পুরো অ্যালবামে ব্যান্ডশিল্পীরা গান করেছিল। শুধু একজন মেয়ে সলো আর্টিস্ট গান করেছেন- সামিনা চৌধুরী। সামিনাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। যেহেতু পছন্দের শিল্পী সেহেতু প্রথমেই ওর কথা মাথায় এলো। তবে গানটি যখন সুর করছিলাম তখন তো আর সামিনা কে ভেবে করিনি নিজের মতো করেই সুর করে ফেলেছি। কিন্তু সুর করার পর মনে হয়েছিল যে গানটি সামিনা ভালো গাইবে। ওই কারণেই সামিনা চৌধুরীকে দিয়ে এই গানটি করাই। ও খুবই চমৎকারভাবে গানটি গেয়েছিল। সলো আর্টিস্টরা যে ধরনের গান গায়, তার চেয়ে আলাদা স্টাইলে গান গাইত সামিনা। ও ব্যান্ডের সাথেও যেতে পারে আবার আধুনিকও হতে পারে। তো ওই চিন্তা করেই ভাবলাম যে একটা ফিমেল আর্টিস্ট থাকুক। এই গানটি মূলত ওর স্টাইলেরই একটি গান ছিল। এই কারণেই গানটি অ্যালবামে রাখা। গানটি লিখেছিল সিজান মাহমুদ।
নয়নে নয় তবু কাঁদে হৃদয়
এই গানটি শামীম গেয়েছে। গানটি আমজাদ হোসেনের ছেলে সোহেল আরমানের লেখা ও সুর করা। সোহেল আরমানই শামীমকে গানটি দিয়েছিল। 'তাজমহল' অ্যালবামের জন্য গানটি কম্পোজিশন করেছিলাম। শামীম গানটি খুব ভালো গেয়েছে। ও আমার খুব ভালো বন্ধু। শামীম কিন্তু আমার সঙ্গে চাইম ব্যান্ডেও ছিল। চাইমেও সে দু-একটা গান করেছে। যখনই আমি মিউজিক করেছি, তখন সব সময় একসঙ্গে থেকেছি। একসময় আমার অ্যাসিট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছে। যেমন আমার প্রথম মিক্সড অ্যালবাম 'স্টারস', ‘স্টারস-টু’ এবং 'শুধু তোমার জন্য'-তেও আমার অ্যাসিট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছে। যতকিছু গান রিলেটেড কাজ ছিল ও করত। পাশাপাশি গান গাওয়া তো ছিলই। সব অ্যালবামে ওর জন্য আমি গান রাখতামই। কারণ ও যেহেতু কষ্ট করছে এবং তার আসল উদ্দেশ্য ছিল গান গাওয়া, সে জন্য তাকে আমি গান করে দিতাম। প্রত্যেকটা ভালো অ্যালবামে শামীমের গান আছে কিন্তু।
নিজেই নিজের কাছে গল্প বলে
এটা আহমেদ ইউসুফ সাবেরের লেখা গান। আর এই গানটা সুর করার আগে আমি ভেবেছিলাম, গানটি আমি নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী ভাইকে দিয়ে গাওয়াব। এ জন্য ভাবছি সুরটি রাগ ভাগেশ্রীর ওপর করব। আমার খুব পছন্দের রাগ। পরে এই রাগের ওপর গানটি করে নিয়াজ ভাইয়ের কাছে গিয়ে যখন বলি এরকম একটি গান করেছি। তখন শুনে তিনি রাজি হয়ে যান। তারপর নিয়াজ ভাই তাঁর বাসায় ভালোভাবে প্র্যাকটিস করে এলেন। কারণ তিনি যখন স্টুডিওতে ভোকালটা দিলেন তখনই বোঝা গেল উনি খুব ভালোভাবে প্র্যাকটিস করেছেন। তিনি স্টুডিওতে বিউটিফুল গেয়েছেন। মানে আমার খুব বেশি বলতে হয়নি কিভাবে গাইতে হবে। যা দেখিয়েছি সেভাবে গাওয়ার পাশাপাশি নিজেও কিছু কাজ খুবই চমৎকারভাবে সংযোজন করেছেন। আসলে এ জন্যই এসব সিনিয়র শিল্পী নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে। কারণ প্রফেশনাল শিল্পী যেমন সুবীর নন্দী, সামিনা চৌধুরী এরা খুব তৈরি হয়ে স্টুডিওতে আসেন। স্টুডিওতে এসে খোঁড়াতে থাকেন না। মানে ওনারা যতটুকু দেন, দেখা যাচ্ছে যতটুকু চাওয়া ছিল তার চেয়েও বেশি কিছু দিয়ে দিচ্ছেন। আর এই জিনিসটাই ওনাদের ছিল।
নিঝুম রাত জেগে আছে কিছু কিছু তারা
এই গানটি মূলত আমার এক বন্ধুর সুর করা। ওর নাম সৌমেন্দ্র শংকর দাস। গানটি প্রথমে ওর কাছে শুনেই খুব ভালো লেগে গেল। তারপর তাকে বললাম, 'বাহ! গানটা তো বেশ দুর্দান্ত। এই গানটা আমাকে দিবি? সে বলল, 'হ্যাঁ নে'। পরে আমি এই গানটা আমাদের আর্ক ব্যান্ডের 'জন্মভূমি' অ্যালবামে করে ফেললাম। ২০১১ সালে যখন দেশে আসলাম তখন একটা ফোনো লাইভে সে আমাকে ফোন করে। ফোনে আমাকে বলে 'তুই কেমন আছিস..? তুই দেশের বাইরে কি জন্য, দেশে চলে আয়।’ আমি তখন তাকে বলি ‘তোর এই গানটা যখনই গাই, তখনই তোর কথা মনে করি’, সৌমেন্দ্র মূলত এই গানটির গীতিকার আসিফ ইকবালের সঙ্গেই একসাথে লিভার ব্রাদার্সে চাকরি করত।
তুমি অন্তর নিয়ে খেলতে ভালোবাসো, আমি যখন বুক ফাটাইয়া কাঁদি তুমি তখন হাসো
এই গানটি 'হারান মাঝি' অ্যালবামের গান। এটি ওই অ্যালবামের অন্যতম গায়ক অটোমনাল মুনের লেখা এবং সুর করা চমৎকার একটি গান। আমি শুধু গেয়েছি। আসলে গানটি আমার খুবই ভালো লাগে তাই গানটা করি। মুন খুবই অসাধারণ টেলেন্টেড একটা ছেলে। আসলে 'হারান মাঝি' একটা ব্যতিক্রমধর্মী অ্যালবাম এবং একটা অন্যরকমের একটা এক্সপেরিমেন্ট। ওই অ্যালবামে খুব ভালো ভালো গান ছিল।
তুমি আমার প্রথম সকাল, একাকী বিকেল ক্লান্ত দুপুর বেলা
১৯৯৩ সালে আমি প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম করি। এটা বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম। নাম ছিল 'শুধু তোমার জন্য'। এই অ্যালবামেই এই গানটি ছিল। গানটি লেখা লতিফুল ইসলাম শিবলীর। সুর আমার। গেয়েছেন শাকিলা জাফর আর তপন চৌধুরী। ইনফ্যাক্ট আমি তো হিট করানোর জন্য গান করি না। কিন্তু করার পর কেমন জানি হিট হয়ে যায়। এটা আসলে ডিপেন্ড করে গানটা কী রকম করে গাওয়া হয়েছে। সবকিছুর সম্মিলনের মধ্য দিয়ে একটা টিম ওয়ার্কের মধ্য দিয়েই একটি ভালো গান দাঁড়িয়ে যায়। ঠিক এইভাবে গানটির কথাও যেমন সুন্দর, সৌভাগ্যবশত গানটির সুরও সুন্দর হয়ে গিয়েছিল। যা পরে তপন চৌধুরী এবং শাকিরা জাফর খুবই সুন্দর করে গাওয়ার কারণে গানটা অনেক ভালো হয়ে যায়। মজার বিষয় হলো, গানটি প্রথমে শাকিলা এসে গেয়ে চলে যান। পরে তপন চৌধুরী গানটি গাওয়ার পর শাকিলা যখন এসে শুনল তখন তার মনে হলো, না গানটি আরো পারফেক্ট করে গাওয়া দরকার ছিল। তারপর আবার আরো একদিন এসে শাকিলা ভোকাল দেন। এই গানটি সুর করতে কিন্তু আমার বেশি সময় লাগেনি। মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লেগেছিল।
আকাশ ঢেকে রাখে
'হারান মাঝি' অ্যালবামে আমার আরেকটি গান ছিল। আকাশ ঢেকে রাখে। কবি তুহিন আখন্দের লেখা। ও অসাধারণ লেখে। কোনা ফরমায়েশি গীতিকার না। শখে লিখে। খুবই সিম্পল একজন মানুষ। একসময় নেতাটেতা ছিল রাজনীতি করত, কোনোদিন চাকরি করে নাই। জীবন ওর কাছে অন্যরকম। কিন্তু গানের জন্য পাগল। বাংলাদেশ থেকে একমাত্র তুহিন আখন্দই আমাকে প্রতি মাসে অন্তত একবার দুবার ফোন করে। শুধু বসে থাকে আমি কখন দেশে আসব। মজার ঘটনা হচ্ছে তুহিন আখন্দ কিন্তু গানটি আমাকে সরাসরি দেয়নি। দিয়েছিল শামীমের কাছে। ওর কাছে আরো আট দশটা গান দিয়ে রেখেছিল তুহিন। কারণ তখনো তুহিনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি। যদিও এক পাড়ায় থাকতাম আমরা। শামীম তখন আমার সাথে একরুমেই থাকত। কিন্তু শামীম আমাকে এই গানগুলো দেখাত না। শামীম বলছিল, তুহিনরে চিনেছিস? ও কিছু গান তোকে দেখানোর জন্য দিয়েছিল। অবশ্য ওর গান না করাই ভালো।’ আমি বললাম, কেন? ও বলল 'রংবাজ টাইপের ছেলে তো'। বললাম, রংবাজ টাইপের হলে সমস্যা কি? রংবাজ হইলেও তার যদি গান ভালো লাগে, ও তো আমার সাথে রংবাজি করছে না। শামীম বলল, 'তবুও চিন্তা করে দেখিস।’
তারপর শামীম একদিন তুহিনের গান আমার বিছানার নিচে থেকে বের করে দেখায়। ভেতরে দেখি আরো ৮-১০টা গান। 'তুই এখানে গান রেখে দিয়েছিস। দশদিন ধরে বলছি তোকে, তুই দেখাচ্ছিস না কেন'? তারপর সবগুলো গান দেখার পর আমি হতবাক। খুবই চমৎকার লিরিক। ওই ১০টা গানের মধ্য থেকে ৫-৬টা গান আমি সুর করেছি। তার মানে কত ভালো গান লেখা হতে পারে। ও খুব সিম্বলিক কথা লেখে। প্রেম ভালোবাসার কথাটাও অন্যভাবে বলে। এই 'আকাশ ঢেকে রাখে' গানটি সেই আমার বিছানার নিচে রাখা গানের একটি। তার আরেকটি গান আছে ‘মেঘ করেছে নীল আকাশের সাথে অভিমান', ওর লেখা আর আমার স্ত্রী টিনা কিবরিয়ার গান। খুবই সুন্দর লেখা গান ছিল।
এমন একটা সময় ছিল
এই গানটি লেখা বাপ্পি খানের। সুর আমার। গানটি প্রথম সুর করার পর বন্ধুর বড় বোন বন্যা আপাকে গানটি গাওয়ার জন্য দিয়ে দেই। পরে আমরা যখন আর্কের 'তাজমহল' অ্যালবাম করলাম পঞ্চম বলল, ‘টুলু ভাই এই গানটি আমার ভীষণ প্রিয়। আপনি কি আমাকে গান গাইতে দেবেন?’ আমি বললাম, দেখো গানটি তো আমি বন্যা আপাকে দিয়েছি, আর তুমি যদি ওনার কাছে চাও আরি উনি যদি তোমাকে দেন তাহলে আমার কিছু বলার নাই। পরে বন্যা আপার বাসায় গেলে পঞ্চমকে গানটি দিয়ে দেন তিনি। তখন পঞ্চম এই গানটি গাইল। ওর ভয়েস টেক্সচারটা অনেক সুন্দর ছিল। ওকে দিয়ে আরো সুন্দর সুন্দর গান করানো যেত। আমি চলে গিয়েছি দেখে অনেক কিছু হলো না। পঞ্চমকে দিয়ে অনেক কিছু সম্ভব। একজন গায়ক হিসেবে ওকে আসলে ইউজ করতে হবে। আমি জানি না ও নিজের কণ্ঠ সম্বন্ধে জানে কি না! কিন্তু ওর গলাটা বেশ ইউনিক। কেমন ভাঙা একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু পরে আর গাইল না ঠিকমতো।
পঞ্চম ১৯৯১ সালে আর্কে আসে। আমি যখন চাইম ব্যন্ড করি তখন, মানে ১৯৮৯ সাল থেকে পঞ্চম আমার কাছে আসে। ছোট্ট একটা ছেলে। সামিনার ছোট ভাই। মাঝে মাঝে বাসায় আসে। ওর গিটার বাজানো আর গাওয়া আমার খুব ভালো লাগত। একটা সময় আমার চাইম ব্যান্ড যখন ভেঙে গেল তখন আমি বললাম, চলো পঞ্চম আমরা একটা ব্যান্ড করে ফেলি? পঞ্চম শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠল। ও তখন বেশ ছোট। আর আমার হলো গিয়ে ব্যান্ড করতে হলে সবাই আমার সমান বড় হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যে ফিট সেই আসতে পারবে। বয়স কোনো বাধা না। যেমন রেজওয়ান আমাদের আর্ক ব্যান্ডের ড্রামার। ও যখন ড্রাম বাজাতে এলো। ক্লাস সেভেনের ছাত্র। তখন সে হাফপ্যান্ট পরে। তখনো ফুল প্যান্ট পরা শেখেনি। ছোট্ট ছেলে। কিন্তু অসাধারণ ড্রাম বাজায়।
তুমি আমার প্রিয় কবিতা
এই গানটি প্রিন্স মাহমুদের সুরে করা আমার গান। এটিও বেশ শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। প্রিন্সের সুরে ওর মিক্সড অ্যালবামগুলোতে আমি ১-২টা গান আমি করেছি। প্রিন্সের প্রথম দিককার অনেকগুলো মিক্সড অ্যালবাম আমার মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে ছিল। ও আমাকে এসে যখন বলেছিল 'টুলু ভাই মিউজিকটা করে দেন'। তখন আমি সব ওর কাজ করে দিয়েছিলাম। ওর গানগুলোর মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে কিবোর্ড বাজানো, রিদম, বেজ বাজানো এটা সেটা অনেক কিছুই। প্রিন্সের সুর আমার ভালো লাগে। বাংলা গানে ওর অবদান অনেক।
পড়ালেখা শেষ করে, বেকারত্বে ধুঁকে মরা- এ কেমন অভিশাপ বলো
এটি চাইম ব্যান্ডের 'মুক্তিযুদ্ধ' অ্যালবামের গান। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। '৮৪-'৮৫ সাল হবে। সেই সময়েই দেখতাম পড়াশোনা করে অনেকেই চাকরি-বাকরি পেত না, বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াত। তো ওই ফিলিংসটা থেকেই এ গানটা লেখা হয়েছিল। গেয়েছিল খালিদ। কীর্তন আঙ্গিকে গানটির সুর করা হয়। অ্যালবামটিতে ‘টোকাই' নামে একটি গান করেছি। গান শুধু প্রেমের জন্য না। মানুষের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে ওই সময়টাতে বক্তব্যধর্মী গান, কে কী করেছিল জানা নেই, তবে আমরা তখন বক্তব্যধর্মী গান করার চেষ্টা করতাম। সুর করার পাশাপাশি আমি অনেকগুলো গান লিখলেও নিজেকে গীতিকার ভাবি না বরং মজা করে ‘গতিকার’ বলি। অর্থাৎ যখন গীতিকার খুঁজে পাই না, তো গানটার একটা গতি করতে হবে, তাই গতিকার হয়ে গান লিখে ফেলি।
সেদিনও আকাশে ছিল চাঁদ
এই গানটার আসল সুরটা ছিল ক্যাসাব্লাংকার একটি ইংরেজি গানের। ওই গানটি শুনে আমি এত বেশি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম যে, সুরটা থেকে আমি বের হয়ে আসতে পারিনি। যার কারণে, আমার খুব ইচ্ছে করছিল এই সুরে যদি বাংলা কিছু কথা বসিয়ে গান করা যায়, তাহলেও খুব ভালো লাগবে। সেজন্যই এই গানটি আমি লিখেছিলাম। চাইম ব্যান্ডের আমলেই লিখেছিলাম। কিন্তু আর্ক ব্যান্ড গঠন করার পর এ গানটি করি আমি।
একটু পরে নামবে সন্ধ্যা, তুমি এখনই বলো না যাই
এই গানটা লেখা সাঈফের। সুর আমার। গেয়েছিল মাকসুদ। এটা আমার দ্বিতীয় ব্যান্ড মিক্সড 'স্টার-টু' অ্যালবামের গান। তবে এই গানটি কিন্তু আগে সুর করা হয়। তারপরে সাঈফ এই সুরের ওপর কথা লেখে। আর মাকসুদ ভাই দুর্দান্ত গেয়েছিল। গীতিকার সাঈফও কিন্তু খুব ভালো গায়। তার একটি অ্যালবাম 'কখনো জানতে চেয়ো না' বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তার দ্বিতীয় অ্যালবামটি পুরোটাই আমার করা ছিল।
আমার দু'চোখে অনন্ত মেঘ অজান্তা তোমার চোখেতে জল
এই গানটা সুবীর নন্দী দাদা যা গাইলেন না! অপূর্ব। সুবীরদা যে এত প্রস্তুত হয়ে স্টুডিওতে এসেছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্টুডিওতে যে রকম চেয়েছি সেভাবেই গেয়ে দিয়েছেন। ওনাদের অনেক সময় কমপ্রেসারও লাগে না। ওনারা যে লেভেলে গান করেন, লেভেল এক, ডায়নামিকসটা এক। যেমন আগে চাইম ব্যান্ডের খালেদের ডায়নামিকসটা এক থাকত, কমপ্রেসার বা লিমিটার ব্যবহার করতে হতো না। যাই হোক সুবীরদা এসে এই গানটিতে এক, দুইবার গেয়েই ফাইনাল টেক দিয়ে দিলেন এবং গানটি অদ্ভুত ভালো হলো। কিন্তু গানটার পেছনে আবার একটা ছোট্ট বেদনাদায়ক ইতিহাস আছে। অর্থাৎ গানটা লিখছিল শিমুল মোহাম্মদ। আমার খুব প্রিয় একজন বন্ধু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেই ১৯৮৪-৮৫-৮৬ সালের দিকে শিমুল এই গানটা লিখেছিল। ও কবি ছিল। ও কবিতা লিখত, ছড়া লিখত। জীবনে কখনো গান লেখেনি। ওর জীবনের লেখা গান এই একটাই। এই একটা গানই লিখে আমাকে দিয়ে বলেছিল, যা এই কবিতাটা দিয়া দিলাম তোরে, দেখ কিছু একটা করতে পারিস কি না! শিমুলও পলিটিকসের সাথে জড়িত ছিল। হাকিম চত্ত্বরে বসত। কাউরে তোয়াক্কা করত না। মজার ব্যাপার হলো, একটু রাফ অ্যান্ড টাফ টাইপের ছেলেদের সাথে আবার আমার খুব ফ্রেন্ডশিপ হতো বেশি। ওরা খুব ওপেন মাইন্ডেড হয়। তো এই গানটি সুর করে গান হওয়ার পর শুনেছিলাম, শিমুল মারা গেছে। ও গানটি শুনেছিল কি না আমার জানা নেই। কারণ ও গান দিয়েছিল বহু আগে আর সুর করছি বহু পরে ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে। ওকে গানটি দেওয়ার জন্য খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। আর যদি সে শুনে থাকে তাহলে খুব ভালো আর না শুনে থাকলে আমার জন্য খুবই বেদনার।
যাইহোক আজ শিমুলের নামটি আবারও উঠে এলো। আমি সাধারণত গীতিকার যারা থাকেন তাঁদের নাম উচ্চারণ করি। কারণ আমি নিজেই আশা করি, যখন কেউ আমার গান গায় তখন যেন আমার নামটা কৃতজ্ঞ চিত্তে বলেন। এইটাই তো আমাদের পাওয়া ভাই। একজন গীতিকার ও সুরকারের এটাই পাওয়া। এই শিল্পীরাই গান গেয়ে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছে বা দেশ বিদেশ ভ্রমণ করছে, হিট করছে, কোটি কোটি মানুষ তাদের চিনছে। ওনাদের প্রাপ্তি ওইটা। আর আমাদের প্রাপ্তি শুধুই এইটা- নামটা অন্তত স্মরণ করুক।
বিবিধ
এই দেশটাই অন্যরকম। বেশ ইমোশনাল মাটি। এখানে ভালো কিছু করতে হলে ফোকের ওপর দখল থাকতে হবে, এটা আমি বুঝে গিয়েছিলাম। ঘটনা হলো, যখন বিভিন্ন ধরনের গান শুনবেন, ততোই ভেতরটা সমৃদ্ধ হতে থাকবে। আর কিছুটা যদি ক্লাসিক্যাল জ্ঞান থাকে, তাহলে কিন্তু অনেক কাজে আসে। আর আমার সুরে ভেরিয়েশনের যে ব্যাপারটা উঠে এসেছে, তার পেছনের কাহিনী হলো, একসময় আমি খুব কবিতা পড়তাম। প্রচুর গল্পের বই পড়তাম। গানের কথা দেখে আমি বুঝতে পারি, গানের গল্পটা কি। আর ওই গল্পটাই আমার সুরকে প্রভাবিত করে। আমি আমার বাসায় কবিতা আবৃত্তি করে নিজেই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজাতাম। প্রত্যেকটা মানুষ কিন্তু লিমিটেড। এই লিমিটেশনটাকেও খেয়াল রাখতে হয়, বারবার একই জিনিসের যেন রিপিট না হয়। তখন কম্পোজারদের জন্য সহজ উপায় হচ্ছে কিছু রাগ জানা। একটা ভাগেশ্রীতে করলে অন্যটা ইমন বা ভৈরবীতে করা যেতে পারে। তাহলে এমনিই ভেরিয়েশন তৈরি হয়ে যায়। আবার যদি ওয়েস্টার্নে করেন, তখন ওয়েস্টার্নের কোন ঘারানায় করবে?
আর এগুলো বাদ দিয়ে সবারই কিন্তু নিজস্ব একটা সুর আছে, মানে ভেতরের একটা সুর। একান্ত ব্যক্তিগত একটা সুর। এটা বলার জন্য বলছি না, হিট করা গানগুলা দশ মিনিটের মধ্যেই হয়ে যায়। তিনদিন ধরে বসে, গবেষণা করে গান সুর করতে গেলেও গান অনেক সময় ভালো হয় না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভালো সুর কেউ করে না, ভালো সুর আল্লাহ্ দেয়। মনে হয় আমি কিছুই করি নাই, আপনাআপনি সুর হয়ে যাচ্ছে। কর্ড ধরেছি, সুর হয়ে যাচ্ছে। আগে জিনিসগুলা বুঝতাম না, যত বয়স বাড়ছে ততই উপলব্ধি করছি।