অস্কার ইতিহাসের সেরা পাঁচ বছর
কড়া নাড়ছে অস্কার। কয়েকদিন পরই শ্রেষ্ঠত্বের হিসাবনিকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। এ বছরের অস্কার মনোনয়ন তালিকা দেখে বলা যায়, ২০১৫ নিঃসন্দেহে হলিউড সিনেমার জন্য একটি শক্তিশালী বছর ছিল। কিন্তু ক্ল্যাসিক বছর হিসেবে বিবেচনা করার জন্য যথেষ্ঠ উপাদান কি ছিল এই সিনেমাগুলোতে? এবারের সেরা সিনেমাটি কি জায়গা করে নিতে পারবে ইতিহাস সেরাদের তালিকায়? প্রশ্ন থেকেই যায়।
অস্কার ইতিহাসের দিকে তাকালে এমন কিছু বছরের সন্ধান পাওয়া যায় যেখানে লড়াই হয়েছিল একেবারে সেয়ানে-সেয়ানে, প্রতিটা ছবিই ছিল সমানভাবে সেরা হওয়ার দাবিদার। যেমনটা হয়েছিল ১৯৫০ সালে ‘অল অ্যাবাউট ইভ’ বনাম ‘সানসেট বুলেভার্দ’, ২০০৭ এ ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান’ বনাম ‘দেয়ার উইল বি ব্লাড’, ১৯৭৭ সালে ‘অ্যানি হল’ বনাম ‘স্টার ওয়ারস’। মনোনয়ন তালিকায় থাকা ছবিগুলোর বৈচিত্র্য আর শিল্পের অপূর্ব সমন্বয়ের কারণে অস্কার ইতিহাসের এ রকম কয়েকটি বছরকে বলা হয় ‘ক্ল্যাসিক ইয়ার’। সম্প্রতি তেমনি পাঁচ সেরা বছর এর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা।
১৯৩৯
সেরা ছবি মনোনয়ন : ডার্ক ভিক্টোরি, গন উইথ দ্য উইন্ড, গুডবাই মিস্টার চিপস, লাভ অ্যাফেয়ার, মিস্টার স্মিথ গোজ টু ওয়াশিংটন, নিনোচকা, অব মাইস অ্যান্ড মেন, স্টেজকোচ, দি উইজার্ড অব ওজ, ওয়াদারিং হাইটস।
জয়ী : গন উইথ দ্য উইন্ড
শুধু অস্কারই নয়, সমগ্র হলিউড ইতিহাসেই ১৯৩৯ সাল একটি অবিস্বরণীয় বছর, সেরা ছবি বাছাই করতে গিয়ে যে বছরটিতে রীতিমতো ঘাম ছুটে গিয়েছিল অ্যাকাডেমি কমিটির। হলিউড অভিনেত্রীদের অনেকের জন্যই বছরটা ছিল ক্যারিয়ারের সেরা। ভিভিয়েন লেইর ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ থেকে বেট ডেভিসের অসাধারণ ‘ডার্ক ভিক্টোরি’, কিংবা গার্বোর স্বচরিত্রের প্যারোডি ‘নিনোচকা’ অথবা জুডি গার্ল্যান্ডের সপ্রতিভ ‘উইজার্ড অব ওজ’—সবই ছিল অসাধারণ। মজা করে অনেকেই এই বছরকে ‘হলিউড ফেমিনিজমের বছর’ বলেও ডাকেন। অস্কারের এই আসরের সেরা অভিনেত্রীর জন্য মনোনয়ন পাওয়া সব ছবিই আবার মনোনয়ন পায় সেরা ছবির জন্য।
১৯৭২
সেরা ছবি মনোনয়ন : কার্বেট, ডেলিভারেন্স, দ্য এমিগ্র্যান্টস, দ্য গডফাদার, সাউন্ডার।
জয়ী : দ্য গডফাদার
শুধু ‘দ্য গডফাদার’-এর জন্যই সিনেমাপ্রেমীদের মনে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই বছর। ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পর সেরা ছবির পুরস্কারসহ তিনটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জিতে যখন অস্কারে রাজত্ব করছিল ‘দ্য গডফাদার’, ঠিক তখনই আটটি ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতে মাত করে দেয় ‘কার্বেট’। এই বছরকে ক্ল্যাসিক তকমা দেওয়ার কারণ বুঝতে হলে দেখতে হয় রানার্স আপের তালিকা। যেখানে ছিল জন বুরম্যানের ‘ডেলিভারেন্স’ কিংবা মার্টিন রিটের ‘সাউন্ডার’-এর মতো ছবিগুলো। তালিকায় ছিল ইতিহাসের একমাত্র ‘সুইডিশ ফার্মিং সাগা’ হয়ে অস্কারে সেরা ছবির মনোনয়ন পাওয়া ‘দ্য এমিগ্র্যান্টস’। সুইডিশ বলেই অনেকেই ভেবেছিলেন, এই অসাধারণ ছবিটি ইঙ্গমার বার্গম্যানের কোনো নির্মাণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন তাঁরই স্বদেশি জ্যান ট্রোয়েল।
১৯৭৫
সেরা ছবি মনোনয়ন : ব্যারি লিন্ডন, ডগ ডে আফটারনুন, জস, ন্যাশভিল, ওয়ান ফ্লিউ ওভার দ্য কাকু’স নেস্ট।
জয়ী : ওয়ান ফ্লিউ ওভার দ্য কাকু’স নেস্ট
কুব্রিক, লুমেট, স্পিলবার্গ আর অল্টম্যান। নাম চারটিই জড়িয়ে আছে একটি অস্কারের সাথে। বিশ্বখ্যাত এই চার পরিচালক অস্কারে সেরা ছবির জন্য প্রতিযোগিতা করেছেন এই ১৯৭৫ সালেই। আমেরিকার ক্ল্যাসিক সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত চারটি ক্ল্যাসিক তো এই বছরেই নির্মিত হয়েছিল! ‘ব্যারি লিন্ডন’-এর মতো যুগান্তকারী নির্মাণ আর ‘ডগ ডে আফটারনুন’ এ রায়ান ও’নেল এর অভিনয়, সাথে ‘জস’-এর অসাধারণ গল্প— সব মিলিয়ে সিনেমাপ্রেমীদের জন্য বছরটি ছিল একটি ‘দুর্লভ’ উপহার স্বরূপ। দর্শক হৃদয় জয় করেছিল সবকয়টি ছবিই, কিন্তু একাডেমির মন জিতে নিয়েছিল ‘ওয়ান ফ্লিউ ওভার দ্য কাকু’স নেস্ট’। সেরা ছবির অস্কার জেতার জোরালো আবেদন ছিল সব সিনেমারই, তালিকার যেকোনো একটি সিনেমার বিদায়ই ছিল হতাশাজনক।
১৯৯৩
সেরা সিনেমা মনোনয়ন : দ্য ফিউজিটিভ, ইন দ্য নেম অব দ্য ফাদার, দ্য পিয়ানো, দ্য রিমেইনস অব দ্য ডে, শিন্ডলার’স লিস্ট।
জয়ী : শিন্ডলার’স লিস্ট
তালিকায় থাকা অন্যান্য সিনেমাগুলোর সাথে ‘দ্য ফিউজিটিভ’-এর মতো এমন বাণিজ্যিক ধাঁচের ছবির অবস্থান একটু দৃষ্টিকটুই বটে। স্পিলবার্গের হলোকাস্ট এপিক ‘শিন্ডলারস’স লিস্ট’ যে সেরার মুকুট ছিনিয়ে নিবে তা তো জানাই ছিল! জেন চ্যাম্পিয়ন, হলি হান্টার, পিট পোস্টলেথওয়েট, লিয়াম নেসন, জিম শেরিডান এবং অতি অবশ্যই পরিচালক অ্যান্ড্রু ডেভিসের জন্য এই বছর ছিল ক্যারিয়ারের সেরা এক সময়। নিজ নিজ মেধার সফল প্রতিফলন আর অর্জন, দুটোই বছরজুড়ে পেয়েছেন তাঁরা। ১৯৯৩ সালের অস্কারের এই মনোনয়ন তালিকাটি অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় একটু আলাদা এবং প্রাণবন্ত ছিল। কারণ তালিকাটি ছিল বৈচিত্র্য আর শিল্পের এক অনন্য সমন্বয়, সচরাচর যার দেখা মেলা ভার।
১৯৯৬
সেরা সিনেমা মনোনয়ন : দ্য ইংলিশ পেশেন্ট, ফার্গো, জেরি ম্যাগুয়ার, সিক্রেটস অ্যান্ড লাইজ, শাইন।
জয়ী : দ্য ইংলিশ পেশেন্ট
অস্কারে এই বছরটি পরিচিত ‘দ্য ইয়ার অব দি ইনডিপেনডেন্টস’ হিসেবে। বছরজুড়ে হলিউডে ছিল মিলিয়ন ডলারের ছড়াছড়ি। যার মধ্যে অন্যতম ‘জেরি ম্যাগুয়ার’-এর ৫০ মিলিয়ন ডলারের আয়। টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সের পর বড় আয়ের খাতায় নাম লেখায় অনেকেই, যার একটা বড় অংশ যোগ হয় এই সালেই। মিরাম্যাক্সের ‘দ্য ইংলিশ পেশেন্ট’ আয় করে ২৭ মিলিয়ন, এ ছাড়া ‘শাইন’ ৬ মিলিয়ন, ‘সিক্রেটস অ্যান্ড লাইজ’ ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন এবং ‘ফার্গো’ ৭ মিলিয়ন ডলার। সমসাময়িক হলিউডের অন্যতম ব্যবসাসফল বছর ছিল ১৯৯৬। যে কারণে সব হিসাব মিলিয়ে বছরটিকে বলা হয় অস্কারের সবচেয়ে ‘কস্ট-ইফেক্টিভ’ বছর।
ছবির বৈচিত্র্য আছে ২০১৫ সালের মনোনয়ন তালিকায়ও, আছে বড় বড় নির্মাতার নাম। কিন্তু তারপরও এই বছর ‘ক্ল্যাসিক ইয়ারের সম্মান যদি না পায় তবে তার কারণ অকাডেমি কমিটিকে ঘিরে সাম্প্রতিক নানা বিতর্ক । এই ২৮ তারিখেই বসছে পৃথিবীজোড়া সিনেমাপ্রেমীদের প্রত্যাশা আর প্রতীক্ষার এই আসর। দেখা যাক নিজের কালজয়ী গৌরব আর মর্যাদার কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে একাডেমি আর তাঁর মেম্বাররা।