চড়া সুর, কড়া গান

আয়রন মেইডেন : নিউ ওয়েভের নেতা-ব্যান্ড

Looks like you've blocked notifications!

সত্তরের দশকের শেষে হেভি মেটাল তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ইউরোপে হেভি মেটালের জোয়ার বয়ে যায়। আর সেই জোয়ার সবচেয়ে ভরাট রূপ নেয় ব্রিটেনে। জোয়ারে নেতৃত্ব দেয় ব্রিটিশ হেভি মেটাল ব্যান্ডগুলো। ঘটনাটাকে বলা হয় নিউ ওয়েভ অব হেভি মেটাল বা নিউ ওয়েভ অব ব্রিটিশ হেভি মেটাল। এই হেভি মেটাল জোয়ারের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যান্ডটির নাম আয়রন মেইডেন।

মেটালহেডদের কাছে তো বটেই, সাধারণ সংগীতানুরাগীদের কাছেও আয়রন মেইডেনকে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। হেভি মেটাল ঘরানার সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলোর নাম বলতে গেলেই আয়রন মেইডেনের আলাপ আসবে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী তাদের প্রায় নয় কোটি অ্যালবাম বিক্রি হয়েছে। ৩৫ বছরের ইতিহাসে তারা লাইভ পারফরম্যান্স করেছে দুই হাজারের বেশি। ২০০২ সালে তারা জিতে নেয় ব্রিটেনের অভিজাত মিউজিক অ্যাওয়ার্ড দ্য আইভর্স। এ ছাড়া তাদের অর্জনের ঝুলিতে আছে ব্রিট অ্যাওয়ার্ডস, ক্ল্যাসিক রক রোল অব অনার অ্যাওয়ার্ড, ব্যান্ডিট রক অ্যাওয়ার্ডস, মেটাল হ্যামার গোল্ডেন গডস অ্যাওয়ার্ড, মেটাল স্টর্ম অ্যাওয়ার্ড, গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস, দ্য রক বিয়ার অ্যাওয়ার্ড, জুনো অ্যাওয়ার্ড প্রভৃতি।

আবার আয়রন মেইডেনের গানের পাশাপাশি তাদের আরো দুটো জিনিস ভক্তদের ভীষণ পছন্দের। প্রথমটি তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বোয়িং ৭৫৭ সিরিজের বিমান এড ফোর্স ওয়ান। বিমানটি চালান আবার ব্যান্ডটির ভোকালিস্ট ব্রুস ডিকিনসন নিজেই। দ্বিতীয়ত, তাদের মাস্কট এডি বা এডি দ্য হেড।

এই কিংবদন্তিতুল্য ব্যান্ডটি গঠিত হয় বেইজিস্ট স্টিভ হ্যারিসের হাত ধরে। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে হ্যারিস স্মাইলার থেকে বের হয়ে যান। সে বছরের ক্রিসমাসেই তার হাত ধরে যাত্রা শুরু করে আয়রন মেইডেন। ব্যান্ডটির নামও রেখেছিলেন তিনিই। এর কিছুদিন আগেই হ্যারিস দ্য ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক সিনেমাটি দেখেন। আলেকজান্ডার দ্যুমা-র ফরাসি উপন্যাস দ্য ভিকোমঁ দে বাজেলোন থেকে নির্মিত সিনেমাটিতে উল্লেখ ছিল আয়রন মেইডেন-এর। এই আয়রন মেইডেন মূলত চতুর্দশ শতকের জার্মানিতে ব্যবহৃত এক ধরনের টর্চার ডিভাইস। জার্মানির ন্যুরেমবার্গে এই যন্ত্রটি আবিষ্কৃত হয়। যন্ত্রটির মূল অংশটা একটা লোহার তৈরি মানুষের আকারের খুপরির মতোন। এর ভেতরের দিকে চোখা চোখা লোহার শিক বসানো থাকে। এই আয়রন মেইডেন থেকেই স্টিভ হ্যারিস ব্যান্ডের নামকরণ করেন।

ব্যান্ডটি প্রথম পারফর্ম করে পরের বছরের ১ মে। এর পর দ্রুতই আরো কয়েকটা। আর ব্যান্ডটির সেই প্রথম লাইনআপে ভাঙনও ধরে দ্রুতই। প্রথম বাদ পড়েন ভোকালিস্ট পল ডে। কারণ, স্টেজে তার পারফরম্যান্স ‘প্রাণবন্ত’ নয়। তার বদলে যোগ দেন ডেনিস উইলকক। উইলকক আবার ছিলেন কিস-এর বেজায় ভক্ত। কিস-এর মতোই জবরজং পোশাক পরে মঞ্চে উঠতেন। এমনকি ব্লাড স্পিটিংও করতেন। পরে উইলককের হাত ধরে ব্যান্ডে যোগ দেন তার বন্ধু ডেভ মারে। মারের পারফরম্যান্স ব্যান্ডের অন্য দুই গিটারিস্ট ডেভ সুলিভান ও টেরি র‍্যান্সকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তোলে। সে জটিলতার জেরে সে বছরেরই শেষ দিকে বিরক্ত হয়ে ব্যান্ড ভেঙেই দেন হ্যারিস।

অবশ্য দ্রুতই আবার যাত্রা শুরু করে আয়রন মেইডেন। এবার একজন মাত্র গিটারিস্ট নিয়ে—ডেভ মারে। পরের বছর দ্বিতীয় গিটারিস্ট যোগ দেন দলে—বব সয়্যার। তবে সেও বেশিদিন টেকেনি। তার অপরাধ, ‘স্টেজে দাঁত দিয়ে গিটার বাজানোর চেষ্টা করে ব্যান্ডের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা।’

এর মধ্যেই আবার দুই বন্ধু উইলকক আর মারের মধ্যে খিটিমিটি লেগে যায়। তার জেরে উইলকক হ্যারিসকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মারেকে মেইডেন থেকে বের করে দেন। সঙ্গে কাটা পড়েন ব্যান্ডের প্রথম লাইনআপের ড্রামার রন ম্যাথুস। মেইডেনও এক নতুন লাইনআপ নিয়ে হাজির হয়—হ্যারিস-উইলককের সঙ্গে যোগ দেয় গিটারে টেরি ওয়াপরাম, কিবোর্ডে টনি মুর এবং ড্রামসে বেরি পার্কিস। ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে এই নতুন লাইনআপ প্রথমবারের মতো মঞ্চে ওঠে, আর সেটাই হয়ে থাকে এই লাইনআপের শেষ পারফরম্যান্স।

বাজে পারফরম্যান্সের জন্য কনসার্টের পরপরেই বাদ পড়েন পার্কিস। নতুন ড্রামার হিসেবে যোগ দেন ডগ স্যাম্পসন। ব্যান্ডের ঘরানার সঙ্গে কিবোর্ড যাচ্ছে না বলে বাদ পড়েন টনি ‍মুরও। মাস কয়েক পরে চলে যান উইলককও। ভি১ নামে নিজে নতুন একটা ব্যান্ড গড়েন। উইলককের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই ডেভ মারে আবার মেইডেনে ফিরে আসেন। মারের হাতে সলো ছাড়তে রাজি না হওয়ায় বাদ পড়েন ওয়াপরামও।

ঝামেলা শেষে আয়রন মেইডেনের নতুন একটা লাইনআপ মোটামুটি দাঁড়িয়ে যায়। হ্যারিস-মারে-স্যাম্পসন জমিয়ে প্র্যাকটিসও চালাতে লাগলেন। কেবল একটাই সমস্যা, ভোকালে কেউ নেই। অবশেষে সেই লোকও পাওয়া গেল। ১৯৭৮-এর নভেম্বরে লেটোনস্টোনের রেড লায়ন পাবে তাদের সঙ্গে পরিচয় হলো পল ডি’অ্যানোর সঙ্গে। ভোকালিস্ট হিসেবে পলকে তাদের ভীষণ পছন্দও হয়ে গেল। আয়রন মেইডেনে যোগ দিতেও রাজি হলেন পল।

এই লাইনআপেই প্রথম রেকর্ডিং করল মেইডেন। চারটি গানের ডেমো রেকর্ড করে তারা তুলে দেন নিয়াল কে-র হাতে। নিয়াল ছিলেন ব্যান্ডওয়াগন হেভি মেটাল সাউন্ডহাউস ক্লাবের ম্যানেজার। এই হেভি মেটাল ক্লাবে বাজানো গানের রেকর্ড থেকে একটা টপচার্টও বানানো হতো। সেটা আবার ছাপা হতো সাউন্ডস নামের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায়। নিয়ালের গানগুলো পছন্দ হয়। সাউন্ডহাউসে গানগুলো বাজানো হয়। একটা গান আবার টপচার্টের শীর্ষেও উঠে আসে। সেই সূত্রেই রড স্মলউড মেইডেনের প্রথম ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে মেইডেন চারটা থেকে একটা বাদ দিয়ে তিনটা গানের রেকর্ড প্রকাশ করে। নাম দেয় দ্য সাউন্ডহাউস টেপস। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পাঁচ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়।

১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরেই মেইডেন ব্রিটেনের অন্যতম সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইএমআই-এর সঙ্গে চুক্তি সেরে ফেলে। এই সময়েই তারা ব্যান্ডে আরেকজন গিটারিস্ট নেওয়ার সিদ্ধান্তও নেয়। প্রথমে সে জন্য পছন্দ করা হয় মারের ছোটবেলার বন্ধু আড্রিয়ান স্মিথকে। কিন্তু স্মিথ তার পুরোনো ব্যান্ড আর্চিন ছাড়তে রাজি না হলে দ্বিতীয় গিটারিস্ট হিসেবে মেইডেনে যোগ দেন ডেনিস স্ট্র্যাটন। কাছাকাছি সময়ে শারীরিক অসুস্থতার কারণে ব্যান্ড ছাড়েন ডগ স্যাম্পসন। তার বদলে যোগ দেন স্যামসন-এর সাবেক ড্রামার ক্লাইভ বার।

পল-হ্যারিস-মারে-স্ট্র্যাটন-বার, এই লাইনআপ নিয়েই আয়রন মেইডেন প্রথম কোনো পূর্ণাঙ্গ অ্যালবামে কাজ করে। ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ নিউ ওয়েভ ব্যান্ডগুলোর গান নিয়ে একটা মিক্সড অ্যালবাম বের হয়—মেটাল ফর মাদেস। তাতে জায়গা করে নেয় মেইডেনের স্যাংকচুয়ারি আর র‍্যাথচাইল্ড।

সে বছরই বের হয় ব্যান্ডটির প্রথম অ্যালবাম—আয়রন মেইডেন। প্রথম অ্যালবামই উঠে আসে ইউকে টপচার্টের ৪ নম্বরে। সে বছরের শেষে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ট্যুরও করে দলটি। তার মধ্যে কিস ও জুডাস প্রিস্টের দুটো ওয়ার্ল্ড ট্যুরের ইউরোপ লেগও ছিল। এ দুই ট্যুরের মাঝেই অবশ্য ব্যান্ডটিতে আরেক দফা রদবদল হয়। মতের মিল না হওয়ায় বাদ পড়েন স্ট্র্যাটন। তাঁর বদলে অক্টোবরে যোগ দেন আড্রিয়ান স্মিথ।

১৯৮১ সালে বের হয় মেইডেনের দ্বিতীয় অ্যালবাম কিলার্স। এই অ্যালবাম মুক্তির পরই ব্যান্ডটি তাদের প্রথম ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বের হয়। আর সেই ট্যুরেই লাইনআপে আরেক দফা পরিবর্তন ঘটে। তত দিনে পল একটু বেশিই কোকেনে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরে ব্যাপারটা পল নিজেও স্বীকার করেন, ‘আমি আসলে তখন কোকেন সেবনের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম। অনবরত কোকেন নিতাম, দিনে ২৪ ঘণ্টাই। প্রতিদিন। ব্যান্ডের তখন বছরব্যাপী পরিকল্পনা, সব জায়গায় কথা পাকাপাকি হয়ে আছে। ওদিকে আমি নেশার ঘোর থেকে বেরই হতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম, আমার পক্ষে ট্যুরটা শেষ করা সম্ভব হবে না।’

তাকে অবশ্য ট্যুর শেষ করেই ছাঁটাই করা হয়। বিলম্বের কারণ, তাঁর বদলি খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। রিডিং ফেস্টিভ্যালে ব্যান্ডটির ম্যানেজার রড স্মলউডের সঙ্গে কথা হয় স্যামসন-এর ভোকালিস্টের। ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে সে মেইডেনের জন্য অডিশন দেয়। অডিশন শেষেই তাঁকে সবুজসংকেত দেখানো হয় মেইডেনের পক্ষ থেকে। আয়রন মেইডেনের নতুন ভোকালিস্ট হিসেবে যোগ দেন ব্রুস ডিকিনসন।

১৯৮২ সালে মুক্তি পায় মেইডেনের তৃতীয় একক অ্যালবাম দ্য নাম্বার অব দ্য বিস্ট। তাদের এই অ্যালবামটাই প্রথমবারের মতো তাদের টপচার্টের শীর্ষে তুলে আনে। শুধু তা-ই নয়, অ্যালবামটি মেইডেনের ভবিষ্যৎকেও পোক্ত করে তোলে। অ্যালবাম-পরবর্তী ওয়ার্ল্ড ট্যুরে মেইডেন ইউরোপ-আমেরিকার বাইরেও কনসার্ট করে দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এমনকি জাপানেও। পারফর্ম করে রিডিং ফেস্টিভ্যালের হেডলাইন ব্যান্ড হিসেবেও। অবশ্য ট্যুরের আমেরিকা লেগে তাদের এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। তাদের অ্যালবামের নাম দেখে মার্কিন রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলোর একটা অংশ দাবি করে বসে, আয়রন মেইডেন শয়তানের উপাসক। তখন প্রতিক্রিয়ায় তেমন কিছু না বললেন, সম্প্রতি ডিকিনসন এক সাক্ষাৎকারে জানান, তারা নাকি ব্যাপারটাতে বেশ মজাই পেয়েছিলেন। কারণ, এহেন দাবি তাদের মুফতে কিছু প্রচারণা এনে দিয়েছিল।

পরের বছর আবার রদবদল ঘটে মেইডেনে। ড্রামার ক্লাইভ বার বাদ পড়েন, তাঁর বদলে যোগ দেন ফরাসি ব্যান্ড ট্রাস্ট-এর ড্রামার নিকো ম্যাকব্রায়ান।

১৯৮৩ সালে মুক্তি পায় পিস অব মাইন্ড। ১৯৮৪ সালে পাওয়ারস্লেভ। অ্যালবামগুলোর দ্য ট্রুপার, ফ্লাইট অব ইকারুস, ২ মিনিটস টু মিডনাইট, অ্যাসেস হাই, রাইম অব দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনার গানগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

পরের অ্যালবামগুলোতে গানের ঢঙে খানিকটা পরিবর্তন আনে মেইডেন। সামহোয়্যার ইন টাইম-এ তারা প্রথমবারের মতো সিনথেসাইসড বেইজ ও গিটার ব্যবহার করে। আর সেভেন্থ সন অব আ সেভেন্থ সন-এ তারা প্রথমবারের মতো ব্যবহার করে কিবোর্ড। এই অ্যালবামটা পুরোটাই আবার একটা কনসেপ্ট নিয়ে করা। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত অরসন স্কট কার্ড-এর সেভেন্থ সন উপন্যাসের ভিত্তিতে এই অ্যালবামের গানগুলো কম্পোজ করে মেইডেন।

সেভেন্থ সন অব আ সেভেন্থ সন-এ কিবোর্ড বাজান হ্যারিস আর স্মিথ। আর এই অ্যালবাম-পরবর্তী ট্যুর থেকেই ব্যান্ডটির লাইভ পারফরম্যান্সে কিবোর্ড বাজাতে শুরু করেন মাইকেল কেনি। এই কেনি মূলত হ্যারিসের বেইস টেকনিশিয়ান। এখনো কনসার্টে-পারফরম্যান্সে কিবোর্ড বাজান তিনিই। তবে মাঝে চারটি অ্যালবামে কেনি কিবোর্ড বাজানোর পর, এখন ব্যান্ডটির স্টুডিও কিবোর্ডিস্ট হিসেবে কাজ করছেন হ্যারিসই।

দীর্ঘ ৭ বছর একই লাইনআপ অটুট থাকার পর, আবার ভাঙনের সুর বাজতে শুরু করে মেইডেন পরিবারে। আড্রিয়ান স্মিথ তার নিজের ব্যান্ড অ্যাসাপ-এর অ্যালবাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ডিকিনসনও জেনিক গার্সকে সঙ্গে নিয়ে তার সলো অ্যালবাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ডিকিনসন আরো বেশ কিছুদিন থাকলেও, আড্রিয়ান স্মিথ ১৯৯০ সালেই স্টিভ হ্যারিসের সঙ্গে গানের ধরন নিয়ে খিটিমিটি পাকিয়ে দল ছাড়েন। স্মিথের জায়গায় যোগ দেন ডিকিনসনের সলো প্রজেক্টের গিটারিস্ট জেনিক গার্স।

১৯৯০ ও ’৯২-এ মুক্তি পায় নো প্রেয়ার ফর ডাইং এবং ফিয়ার অব দ্য ডার্ক। প্রথম অ্যালবামে জায়গা করে নেয় এ নাইটমেয়ার অন এল্ম স্ট্রিট ৫-এর জন্য করা ডিকিনসনের সাউন্ডট্র্যাক- ব্রিং ইয়োর ডটার ... টু দ্য স্লটার। গানটি মেইডেনের প্রথম গান হিসেবে ইউকে টপচার্টের শীর্ষে উঠে আসে। আর ফিয়ার অব দ্য ডার্ক অ্যালবামটাই উঠে আসে টপচার্টের শীর্ষে। ফিয়ার অব দ্য ডার্ক তো বটেই, তুমুল জনপ্রিয় হয় অ্যালবামটির বি কুইক অর বি ডেড, ফ্রম হেয়ার টু এটার্নিটি গানগুলোও।

এরপর ১৯৯৩ সালে ডিকিনসনও মেইডেন ছেড়ে যান সলো ক্যারিয়ারে মনোযোগ দিতে। তাঁর বদলে পরের বছর যোগ দেন নতুন ভোকাল ব্লেজ বেইলি। বেইলিকে নিয়ে মেইডেন তিনটি অ্যালবাম মুক্তি দেয়। তার মধ্যে একটি অবশ্য পুরোনো গানের সংকলন। বেস্ট অব দ্য বিস্ট নামের সংকলনে একটিই নতুন গান ছিল ভাইরাস। সে সময়ে মেইডেনকে প্রচুর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। ‘ভাইরাস’ দিয়ে দলটি সব সমালোচকেরই এক হাত নেয়। অন্য দুটি অ্যালবামই মেইডেনের মাপকাঠিতে ব্যর্থই হয় বলা চলে। অবশ্য প্রথমটি দ্য এক্স ফ্যাক্টর ফ্রান্স ও জার্মানিতে অ্যালবাম অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হয়।

শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে বেইলিকে মেইডেন থেকে বাদ দেওয়া হয়। বেইলির বদলি হিসেবে শুরুতে নতুন কাউকে নেওয়ারই ভাবনা ছিল হ্যারিসের। তবে স্মলউড তাকে ডিকিনসনকে ফেরানোর ব্যাপারে রাজি করান। প্রথম প্রথম রাজি না থাকলেও, শেষ পর্যন্ত হ্যারিসও ডিকিনসনকে ফেরাতে রাজি হন। রাজি হয় মেইডেনের বাকিরাও। সেই মাসেই ব্রাইটনে ডিকিনসনের সঙ্গে ব্যান্ডের মিটিং হয়। মিটিংও সফল হয়। মেইডেনে ফিরে আসেন তিনি।

এর কিছুক্ষণ পরে, টেলিফোনে আলাপ সারা হয় আড্রিয়ান স্মিথের সঙ্গেও। মেইডেনে ফিরে আসেন তিনিও। তবে তার বদলি জেনিক গার্সকে বাদ দেওয়া হয় না। মেইডেন তখন থেকেই তিন গিটারিস্টের ব্যান্ড। এরপর ব্যান্ডটির লাইনআপে আর কোনো পরিবর্তন আসেনি। ব্যান্ডটির জনপ্রিয়তায় আর সাফল্যেও আর ভাটা পড়েনি। এর পর থেকেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে হেভি মেটাল জগতে ছড়ি ঘুরিয়ে যাচ্ছে আয়রন মেইডেন। এখনো তাদের অ্যালবামগুলো দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা কুড়োচ্ছে নিয়মিত।

আয়রন মেইডেনের এই নতুন পর্বের প্রথম অ্যালবাম ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড। এর পর একের পর এক এসেছে ড্যান্স অব ডেথ, এ ম্যাটার অব লাইফ অ্যান্ড ডেথ, দ্য ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার, দ্য বুক অব সোলস। কোনোটাতেই শ্রোতাদের হতাশ করেনি দলটি।

হতাশ না করলেও, নাটক ঠিকই হয়েছে। ২০১০ সালে দ্য ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার মুক্তির সময় দলের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, এটাই হতে যাচ্ছে শেষ অ্যালবাম। কিন্তু ২০১৩ সালে আবার ডিকিনসন জানান, মেইডেনের আরেকটি অ্যালবাম আসছে। পরে ম্যাকব্রায়ানও নতুন অ্যালবামের খবর জানান। তখন আবার ডিকিনসনের টিউমারের চিকিৎসা চলছে। মানে হলো, ট্যুর করতে পারবে না দলটি। কাজেই, অ্যালবামটির মুক্তি পিছিয়ে দেওয়া হলো। পরে ডিকিনসন সুস্থ হলে, ২০১৫ সালের ১৫ মে বের হয় দ্য বুক অব সোলস।

আয়রন মেইডেনের এই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠার যাত্রায় একটি বিষয় বলে রাখা যায়—মিডিয়ার তেমন কোনো সাহায্যই বলা যায় পায়নি অনবরত ভাঙাগড়ার খেলায় গড়া এই দলটি। মিডিয়ার আনুকূল্যের চেয়ে বরং তারা হেঁটেছে দর্শকের আনুকূল্য লাভের পথে। যার জন্য সমসাময়িক অন্যান্য ব্যান্ডের তুলনায় মেইডেন অ্যালবাম সংখ্যায় পিছিয়ে থাকলেও, কনসার্ট সংখ্যায় প্রায় সবার চেয়েই এগিয়ে। একের পর এক কনসার্ট করেছে মেইডেন। একের পর এক কনসার্টে শ্রোতাদের উন্মাতাল করে তুলেছে তারা। তুলছে এখনও। আর এর ফলাফলও তারা পেয়েছে। অ্যালবাম কম হলেও, অ্যালবাম বিক্রির হিসাবে আবার তারাই সবার ওপরে।

রীতি অনুযায়ী প্রায় সব অ্যালবামের পরেই ওয়ার্ল্ড ট্যুর করেছে মেইডেন। এবং তাদের ওয়ার্ল্ড ট্যুরগুলো প্রায়ই অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই বড়। পরে কেবল তাদের জন্যই একটা আস্ত বোয়িং-৭৫৭ বরাদ্দ হলে, তাদের ওয়ার্ল্ড ট্যুর করা আরো সহজ হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় ট্যুরটি তারা করে ২০০৮ সালে। সামহোয়ের ব্যাক ইন টাইম ট্যুরের জন্য তারা ৪৫ দিনে ৫০ হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয়। মেইডেন পৌঁছে যায় ভারত থেকে কোস্টারিকায়, অস্ট্রেলিয়া থেকে আর্জেন্টিনায়, সাও পাওলো থেকে টোকিওতে। সেটাই ছিল আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে বড় কোনো হেভি মেটাল ব্যান্ডের প্রথম কনসার্ট।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেইডেনের দ্য বুক অব সোলস ওয়ার্ল্ড ট্যুর শুরু হয়েছে। বরাবরের মতো এবারও তাদের বহনকারী বিমানের নাম এড ফোর্স ওয়ান। চালক হিসেবে আছেন ব্রুস ডিকিনসন। তবে বদলে গেছে বিমানটি। তাদের নতুন এড ফোর্স ওয়ান বোয়িং ৭৫৭ নয়, বোয়িং ৭৪৭-৪০০ জাম্বো জেট।

লাইনআপ

ভোকাল—ব্রুস ডিকিনসন

গিটার—ডেভ মারে, আড্রিয়ান স্মিথ, জেনিক গার্স

বেইজ—স্টিভ হ্যারিস

ড্রামস—নিকো ম্যাকব্রায়ান

কিবোর্ড—মাইকেল কেনি (লাইভ মেম্বার)

গুরুত্বপূর্ণ সাবেক সদস্য—পল ডি’অ্যানো (ভোকাল), ব্লেজ বেইলি (ভোকাল), ডেনিস স্ট্র্যাটন (গিটার), ডগ স্যাম্পসন (ড্রামস), ক্লাইভ বার (ড্রামস)

স্টুডিও অ্যালবামগুলো

আয়রন মেইডেন (১৯৮০)

কিলার্স (১৯৮১)

দ্য নাম্বার অব দ্য বিস্ট (১৯৮২)

পিস অব মাইন্ড (১৯৮৩)

পাওয়ারস্লেভ (১৯৮৪)

সামহোয়ের ইন টাইম (১৯৮৬)

সেভেন্থ সন অব এ সেভেন্থ সন (১৯৮৮)

নো প্রেয়ার ফর দ্য ডাইং (১৯৯০)

ফিয়ার অব দ্য ডার্ক (১৯৯২)

দ্য এক্স ফ্যাক্টর (১৯৯৫)

ভার্চুয়াল এক্সআই (১৯৯৮)

ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড (২০০০)

ড্যান্স অব ডেথ (২০০৩)

এ ম্যাটার অব লাইফ অ্যান্ড ডেথ (২০০৬)

দ্য ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার (২০১০)

দ্য বুক অব সোলস (২০১৫)

গুরুত্বপূর্ণ ট্যুরগুলো

মেটাল ফর মাদেস ট্যুর (১৯৮০)

আয়রন মেইডেন ট্যুর (১৯৮০)

কিলার্স ওয়ার্ল্ড ট্যুর (১৯৮১)

দ্য বিস্ট অব দ্য রোড (১৯৮২)

ওয়ার্ল্ড স্লেভারি ট্যুর (১৯৮৪-৮৫)

সামহোয়ের অন ট্যুর (১৯৮৬-৮৭)

সেভেন্থ ট্যুর অন এ সেভেন্থ ট্যুর (১৯৮৮)

নো প্রেয়ার অন দ্য রোড (১৯৯০-৯১)

ফিয়ার অব দ্য ডার্ক ট্যুর (১৯৯২)

রিয়েল লাইভ ট্যুর (১৯৯৩)

দ্য এড হান্টার ট্যুর (১৯৯৯)

ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড ট্যুর (২০০০-০১)

গিভ মি এড... ’টিল আ’ম ডেড ট্যুর (২০০৩)

ড্যান্স অব ডেথ ওয়ার্ল্ড ট্যুর (২০০৩-০৪)

এডি রিপস আপ দ্য ওয়ার্ল্ড ট্যুর (২০০৫)

এ ম্যাটার অব লাইফ অ্যান্ড ডেথ ট্যুর (২০০৬-০৭)

সামহোয়ের ব্যাক ইন টাইম ওয়ার্ল্ড ট্যুর (২০০৮-০৯)

দ্য ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার ওয়ার্ল্ড ট্যুর (২০১০-১১)

মেইডেন ইংল্যান্ড ওয়ার্ল্ড ট্যুর (২০১২-১৪)

দ্য বুক অব সোলস ওয়ার্ল্ড ট্যুর (২০১৬)