চড়া সুর, কড়া গান
মেটাল-রাজ মেটালিকা! (পর্ব-১)
রক-মেটাল ব্যান্ডগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড মেটালিকা। জনপ্রিয়তার দৌড়ে এ সময়ে ব্যান্ডটি কেবল সবাইকে হারিয়েই দেয়নি, সেই জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে আজ পর্যন্ত। কেবল জনপ্রিয়তার বিচারেই নয়, প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক দিয়েও ব্যান্ডটি নিতান্ত কম নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যান্ড জগতে মেটালিকার প্রভাব অপরিসীম। দেশের প্রায় সব রক-মেটাল ব্যান্ডেরই আদর্শস্থানীয় গুটি কয়েক ব্যান্ডের তালিকায় আছে এই ব্যান্ডটির নাম। আর কেবল থ্র্যাশ মেটালের হিসাব করলে, মেটালিকা এই ধারার কেবল পাইওনিয়ারই নয়, সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ডও বটে। থ্র্যাশ মেটাল ঘরানাটি যে চার কুতুব ব্যান্ডের হাত ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিল, তারই এক কুতুব এই মেটালিকা। শুধু তাই না, আরেক কুতুব মেগাডেথ-এর জন্মের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে মেটালিকার নাম।
ব্যান্ডটির ঝুলিতে আছে আরো অনেক স্বীকৃতি, অ্যাওয়ার্ড আর সম্মাননা। মেটালিকা এই পর্যন্ত গ্র্যামি জিতেছে আটবার। তাদের টানা পাঁচটি অ্যালবাম মুক্তির প্রথম সপ্তাহে ছিল বিলবোর্ডের শীর্ষে। এর মধ্যে মেটালিকা নামের অ্যালবামটিকে ধরা হয় ইতিহাসের অন্যতম ব্যবসাসফল অ্যালবাম হিসেবে। ১৯৯১ সাল থেকে সাউন্ডস্ক্যানের রাখা হিসেবে এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া অ্যালবাম। সব অ্যালবাম মিলিয়ে বিক্রির হারে তারা আছে তৃতীয় অবস্থানে। ২০০৯ সালে তাদের নাম উঠেছে রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেম-এও।
এই মেটালিকার জন্ম হয় ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে। সে উদ্যোগ নেন ড্রামার লার্স উলরিচ। তিনি দ্য রিসাইক্লার নামের স্থানীয় একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন, জ্যামিংয়ের জন্য একজন ড্রামার কিছু মেটাল মিউজিশিয়ান খুঁজছেন, যারা টাইগার্স অব প্যান ট্যাং, ডায়মন্ড হেড এবং আয়রন মেইডেন কাভার করতে ইচ্ছুক। সাড়া দিলেন দুজন। লেদার চার্ম-এর জেমস হেটফিল্ড ও হিউ টানার।
তখনই অবশ্য তাঁরা ব্যান্ড গঠন করেননি। তবে শুরুটা হয় ওখান থেকেই। ব্যান্ড ছাড়াই তাঁরা একটা গান কম্পোজ করে ফেলেন। সে সময় মেটাল ব্লেড রেকর্ডস-এর মালিক ব্রায়ান স্লাগেল পরিকল্পনা করছিলেন, আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ডগুলোকে নিয়ে একটা মিক্সড অ্যালবাম বের করবেন। নাম ঠিক করেন ‘মেটাল ম্যাসাকার’। সেই অ্যালবামের জন্য তাঁরা গানটি পাঠিয়েও দেন। ব্যান্ড গঠন করেন তারও পরে।
উলরিচ ব্যান্ডের নাম ঠিক করার দায়িত্ব দেন তাঁর বন্ধু রন কোয়ান্টানাকে। কোয়ান্টানা দুটো নাম ঠিক করে দেন—মেটালম্যানিয়া, আর মেটালিকা। উলরিচ বেছে নেন পরেরটা। ১৯৮১ সালের অক্টোবরে উলরিচ-হেটফিল্ডের হাত ধরে মেটালিকা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে।
ব্যান্ড গঠনের পর তাঁরা লিড গিটারিস্ট চেয়ে আবার বিজ্ঞাপন ছাপলেন দ্য রিসাইক্লার-এ। যোগাযোগ করলেন ডেভ মাস্টেইন। তিনিও যুক্ত হলেন মেটালিকাতে। অবশ্য পরে তিনি দাবি করেছিলেন, উলরিচ আর হেটফিল্ড নাকি তাঁর দামি দামি গিটার আর আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম দেখেই তাঁকে দলে ভিড়িয়েছিলেন!
১৯৮২ সালের ১৪ জুন বের হয় ‘মেটাল ম্যাসাকার ১’। তাতে জায়গা করে নিল মেটালিকার প্রথম কম্পোজিশন হিট ‘দ্য লাইটস’। অ্যালবামটির প্রথম কপিতে অবশ্য মেটালিকার নামের বানানে ভুল হয়েছিল। তাই নিয়ে ব্যান্ডের সবাই খানিকটা মন খারাপও করেছিল। তবে অ্যালবামটা বের হয়ে তাঁদের ভালোই লাভ হয়; তাঁদের ট্র্যাকটা বেশ আলোচিত হয়। ট্র্যাকটাতে হেটফিল্ড বেইস বাজিয়েছিলেন। তবে অ্যালবামটা বের হতে হতে মেটালিকায় বেসিস্টও নেওয়া হয়। যোগ দেন রন ম্যাকগভনি। মেটালিকার পূর্ণাঙ্গ লাইনআপও দাঁড়িয়ে যায়। সেই লাইনআপ নিয়েই তাঁরা প্রথমবারের মতো মঞ্চে ওঠে। ১৯৮২ সালের স্যাক্সনের ইউএস ট্যুরের ওপেনিং ব্যান্ড হিসেবে পারফর্ম করে মেটালিকা।
তখনো থ্র্যাশ মেটাল টার্মটির প্রচলন হয়নি। টার্মটির প্রচলন করেন ‘কেরাং!’ পত্রিকার সাংবাদিক ম্যালকম ডোম, ১৯৮৪ সালে। সে বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটির ৬২তম সংখ্যা বেরোয়। সে সংখ্যায় ডোম অ্যানথ্যাক্স-এর ‘ফিস্টফুল অব মেটাল’ অ্যালবাম নিয়ে তাঁর আলোচনা ছাপা হয়। সে অ্যালবামের মেটাল ‘থ্র্যাশিং ম্যাড’ গানটি নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে তিনি প্রথম টার্মটি ব্যবহার করেন। পরে টার্মটি জনপ্রিয় হয়ে উঠলে মেটালিকাও নিজেদের থ্র্যাশ মেটাল ব্যান্ড বলে পরিচয় দিতে শুরু করে।
এর আগ পর্যন্ত তারা নিজেদের বলত পাওয়ার মেটাল ব্যান্ড। তাদের প্রথম ডেমোটিও তারা বের করে একই নামে—পাওয়ার মেটাল। ডেমোটিতে ট্র্যাক ছিল চারটি। নতুন তিনটি ট্র্যাকের দুটিরই কম্পোজিশন করেন মাস্টেইন, অন্যটির হেটফিল্ড।
তবে মেটালিকার এই লাইনআপে বদল এলো দ্রুতই, ১৯৮২ সালের শেষ দিকে। এক রাতে ওয়েস্ট হলিউডের ‘হুইস্কি এ গো গো’ নামের একটি নাইটক্লাবে এক শো দেখতে গিয়েছিলেন উলরিচ আর হেটফিল্ড। সেই শোতে বেসিস্ট ক্লিফ বার্টনের বাজানো দেখে তাঁরা রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে যান। বিশেষ করে বার্টনের ওয়া-ওয়া প্যাডেলের ব্যবহার ছিল দুর্দান্ত। এমনিতেই ম্যাকগভনিকে নিয়ে আপত্তি ছিল হেটফিল্ড আর মাস্টেইনের। সব মিলিয়ে উলরিচ আর হেটফিল্ড তখনই বার্টনকে মেটালিকায় আমন্ত্রণ জানান। তখন বার্টন বাজাতেন ট্রমা নামের একটা ব্যান্ডে। প্রথমদিকে যোগ দিতে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত মেটালিকায় নাম লেখান তিনি।
এবার মেটালিকা তাদের প্রথম অ্যালবামের কাজে হাত দিল। কিন্তু তাদের পুরোনো পৃষ্ঠপোষক ‘মেটাল ব্লেড’-এ যাত্রায় তাদের পাশে দাঁড়াতে পারল না। তাদের পক্ষে এত খরচ বহন করা সম্ভব নয়। এগিয়ে এলেন জনি জেড জাজুলা। তিনি ছিলেন মূলত কনসার্ট প্রমোটর। মেটালিকার ডেমো রেকর্ডিং তিনি শুনেছিলেন। তিনিই দায়িত্ব নিলেন, মেটালিকার সঙ্গে নিউইয়র্কভিত্তিক বড় বড় রেকর্ড লেবেলের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার।
নিউইয়র্কে এসে মেটালিকা তাদের প্রথম অ্যালবামের কাজ শুরু করল। নাম ঠিক করা হলো—মেটাল আপ ইয়োর অ্যাস। রেকর্ডিং শুরু হলো ১৯৮৩ সালের ১১ এপ্রিল। এর আগেই ব্যান্ড থেকে বের করে দেওয়া হলো ডেভ মাস্টেইনকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ—মদ ও নেশায় মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি এবং ব্যান্ডের অন্য সদস্যদের প্রতি দুর্ব্যবহার। ব্যান্ডের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নাকি রীতিমতো সহিংস হয়ে উঠছিলেন তিনি তখন। ফলাফল, তাঁর বদলে মেটালিকায় যোগ দিলেন এক্সোডাস-এর গিটারিস্ট কার্ক হ্যামেট।
ডেভ মাস্টেইন অবশ্য ঘটনাটাকে খুব একটা সহজভাবে গ্রহণ করেননি। এ নিয়ে দুপক্ষে দীর্ঘদিন চাপান-উতোর চলে। মেটালিকা থেকে বের হয়ে মাস্টেইন আরেকটা ব্যান্ড গঠন করেন। সেই ব্যান্ডটিও থ্র্যাশ মেটালের চার কুতুবের একটি—মেগাডেথ।
১৯৮৩ সালের ২৫ জুলাই বাজারে আসে মেটালিকার প্রথম অ্যালবাম। বের করে মেগাফোর্স রেকর্ডস। তবে নামটা বদলে যায়। কারণ, রেকর্ড লেবেল আর পরিবেশকদের আপত্তি। ‘মেটাল আপ ইয়োর অ্যাস’ নাম বদলে রাখা হয় ‘কিল এম অল’। অ্যালবামটি খুব একটা ব্যবসা না করলেও আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড হিসেবে মেটালিকার একটা ভক্তশ্রেণি ঠিকই তৈরি করে দেয়।
পরের বছর বের হয় তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘রাইড দ্য লাইটনিং’। অ্যালবামটির কাভার ছাপার কাজ পেয়েছিল একটা ফরাসি প্রিন্টিং প্রেস। তারা কাভার ছাপতে ভুল করে। তাদের ভুলের বদৌলতে, প্রথম এডিশনে অ্যালবামটির কালো রঙের কাভার হয়ে যায় সবুজ। এখন অবশ্য সংগ্রহ হিসেবে ওই সবুজ কাভারটিই অমূল্য হয়ে উঠেছে। অ্যালবামটির দুটো গানের লিরিসিস্ট হিসেবে মাস্টেইনের নাম দেওয়া হয় (রাইড দ্য লাইটনিং, দ্য কল অব তুলু)।
১৯৮৬ সালের মার্চে বের হয় মেটালিকার তৃতীয় অ্যালবাম ‘মাস্টার অব পাপেট’। অনেক ভক্ত-সমালোচকের মতে, এটাই মেটালিকার সেরা অ্যালবাম। অ্যালবামটা বের করে মিউজিক লেবেল ইলেকট্রা। এই ইলেকট্রার সঙ্গে মেটালিকার গাঁটছড়া বাঁধার ঘটনাটাও বেশ মজার। ১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইলেকট্রার ডিরেক্টর মাইকেল অ্যালাগো এবং কো-ফাউন্ডার ক্লিফ বার্নস্টাইন গিয়েছিলেন একটা কনসার্ট দেখতে। সেই কনসার্টে পারফর্ম করেছিল মেটালিকাও। সেই কনসার্ট দেখেই তাঁরা মেটালিকার সঙ্গে চুক্তি করেন।
একদিকে মেটালিকা ইলেকট্রার সঙ্গে চুক্তি করল। অন্যদিকে তাদের জনপ্রিয়তাও হু-হু করে বাড়তে লাগল। তাদের জনপ্রিয়তা দেখে ইলেকট্রা তাদের ‘ক্রিপিং ডেথ’ গানের একটা লিমিটেড এডিশন সিঙ্গেলও বের করে। সিঙ্গেলটার ৪০ হাজার কপি কেবল আমেরিকাতেই বিক্রি হয়। আর পরে ‘মাস্টার অব পাপেট’ বিক্রির তালিকায় একদম ওপরের দিকে উঠে আসে। সেরা ২০০ অ্যালবামের বিলবোর্ডে থাকে ৭২ সপ্তাহ।
‘মাস্টার অব পাপেট’ মুক্তির পর মেটালিকা ইউরোপ ট্যুরে বের হয়। নাম ড্যামেজ ইনকরপোরেশন ট্যুর। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬। সেই ট্যুরে মেটালিকা তখন সুইডেনে। রাতে তাঁরা ঠিক করলেন, ঘুমানোর জায়গা অদলবদল করবেন। তাস টেনে ঠিক করলেন, কে কোথায় ঘুমাবেন। বার্টনের জায়গা হলো কার্ক হ্যামেটের বাঙ্কে (বাসের বিছানা)। সকালে যখন সূর্য উঠি-উঠি করছে, মেটালিকার বাসটা তখন দোরার্পে। হঠাৎই কী হলো, ড্রাইভার বাসের নিয়ন্ত্রণ হারালেন। বাস বারকয়েক পাক খেয়ে তারপর থামল। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর সবাই নড়েচড়ে দেখলেন, কারোরই তেমন কিছু হয়নি। উলরিচ, হেটফিল্ড, হ্যামেট, এমনকি ড্রাইভারেরও তেমন কিছু হয়নি। কেবল নিথর হয়ে পড়ে আছেন ক্লিফ বার্টন, বাসের নিচে।
বার্টনের এই মৃত্যুতে মেটালিকার বাকি তিন সদস্যই ভীষণ মুষড়ে পরেন। এমনকি তাঁরা এমনও ভাবতে থাকেন, মেটালিকা ভেঙে দেবেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁরা বুঝতে পারেন, বার্টন থাকলে তিনি নিশ্চয়ই চাইতেন না মেটালিকা ভেঙে যাক। কাজেই, তাঁরা নতুন উদ্যমে মেটালিকাকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বার্টনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বার্টনের বদলি নেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। মেটালিকার বেজিস্ট হওয়ার জন্য অডিশন দিলেন জনা চল্লিশেক। তাঁদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত হলেন জ্যাসন নিউস্টেড।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)