মণিপুরি থিয়েটারের ‘লেইমা’, মুগ্ধ দর্শক
একটা নাটক ঘিরে হয়ে গেল তিনদিনের উৎসব। নারীর মনস্তাত্ত্বিক সংকট, পাওয়া না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব নিয়ে যে গল্প এগিয়ে চলে দৃশ্যের পর দৃশ্যজুড়ে। তিন বছর পর নতুন নাটক মঞ্চে এনেছে মণিপুরি থিয়েটার। ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকার ইয়ের্মা অবলম্বনে রচিত নাটকটির নাম ‘লেইমা’। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিতে এর ভাষান্তর ও নির্দেশনা দিয়েছেন শুভাশিস সিনহা। গত ১০ এপ্রিল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানার ঘোড়ামারা গ্রামে বাংলাদেশের একমাত্র গ্রামীণ থিয়েটার-স্টুডিও মণিপুরি থিয়েটারের নটমণ্ডপে ‘লেইমা’ নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়েছে। এ নাটক নিয়েই মণিপুরি থিয়েটার উপস্থিত হয়েছিল ঢাকায়। গত ২১, ২২ ও ২৩ মে ‘এক নাটকের উৎসব’ শিরোনামে টানা তিন সন্ধ্যায় নাটকটির তিনটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল ঢাকার শিল্পকলা আর নাটমণ্ডলের মঞ্চজুড়ে।
বিপর্যস্ত লেইমা সন্তানের আকুতিতে বিভোর, এই মনস্তাত্ত্বিক সংকটকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে ‘লেইমা’র কাহিনী। কিন্তু স্বামী জয় এ বিষয়ে একেবারে উদাসীন। এদিকে নাটকের দৃশ্যপটে তখন প্রবেশ ঘটে লেইমার পুরোনো প্রেমিক ব্রজের। একদিন ত্রিমুখী সংকট দেখা দিলে ব্রজ বিদায় নেয়। দিন দিন বন্ধ্যাত্বের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া লেইমা নিজেকে মাতৃত্বের দায় থেকে মুক্তি দিতে জয়কে হত্যা করে। আর্তনাদে ভেঙে পড়ে বলে, ‘আমি আমার সন্তানকে হত্যা করে ফেলেছি!’
নির্দেশকের ভাষায়-‘এই নাটক বিশ্বজনীন। একটি সন্তানের আকাঙ্ক্ষা মনে হয়েছে একটি নতুন শুভসময়ের আগমনের প্রতীক। লোরকা অসাধারণ কাব্যিক। আমি কবিতার মানুষ। নাটক আর কবিতাকে মেলাতে পেরেছি। প্রায় দুই মাস, প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে কাজ করেছি। কিন্তু পাঠ, বিশ্লেষণ মাসতিনেক। ব্যাপক সাড়া পেয়েছি, তবে শেষ শো সবচেয়ে ভালো হয়েছে। এর আগে টেকনিক্যাল ঝামেলা হয়েছিল দুটো শো-তে। দর্শকদের উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা, টান মনে থাকবে।’
মণিপুরি নাট্য আঙ্গিক ও পাশ্চাত্য অভিনয়রীতির রসায়নে পরিবেশিত হয় দেড় ঘণ্টার ‘লেইমা’। এতে লেইমার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জ্যোতি সিনহা। অন্য অভিনয়শিল্পীরা হলেন বিধান সিংহ, সুরজিৎ সিংহ, সঞ্জিত সিংহ, শুক্লা সিনহা, উজ্জ্বল সিংহ, সমরজিৎ, দীপু, শুক্লা, সুস্মিতা, অনামিকা, সমরজিত ও সুকান্ত। সংগীত আয়োজনে ছিলেন শর্মিলা সিনহা ও কৃষ্ণকুমারী সিনহা। বাদ্যে বাবুচান সিংহ, অঞ্জনা ও শুক্লা। পোশাক পরিকল্পনায় জ্যোতি সিনহা এবং দৃশ্য ও আলোক পরিকল্পনায় শুভাশিস সিনহা।
নাট্যব্যক্তিত্ব রুবাইয়াৎ আহমেদ ‘লেইমা’ প্রসঙ্গে বলেন, “লোরকার একটি সৃষ্টিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় রূপান্তর করে মঞ্চে নিয়ে আসা সাহসী কাজই বটে। তরুণ মেধাবী নির্দেশক শুভাশিষ সিনহা সেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটিই করেছেন। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষী এই অঞ্চলে মণিপুরি ভাষার একটি নাটক ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারার কথা নয়। কিন্তু থিয়েটারের নিজস্ব ভাষার গুণেই শব্দ-বাক্য তেমন একটা প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেনি। শুভাশিষের দক্ষতা এই যে, নিরাভরণ একটি মঞ্চে শুধুমাত্র অভিনয়ের জোরেই তিনি দর্শকের মধ্যে ‘লেইমা’র সংকট, যন্ত্রণা এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক রূপান্তরের গল্প মেলে ধরতে পেরেছেন। তবে সংগীতের সঙ্গে দৃশ্যের সাযুজ্য নির্মাণে আরেকটু দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে। আর সবকিছুতে অকুণ্ঠ অভিবাদনযোগ্য মণিপুরি থিয়েটারের এই প্রযোজনা।”