নিশ্বাসে নাই সুখ!

Looks like you've blocked notifications!
বায়ুদূষণ যেন নগরজীবনের একটি স্থায়ী সমস্যার নাম।
ছবি : সংগৃহীত

‘চোখে দেখা যায় না, না থাকলে চলে না’—সেটা কী? সেটা বাতাস বা বায়ু। বিশুদ্ধ বায়ু পরিবেশের আত্মা।

বায়ুতে সাধারণত ২১ শতাংশ অক্সিজেন, ৭৮ শতাংশ নাইট্রোজেন, দশমিক ৩১ শতাংশ ভাগ কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং নির্দিষ্ট অনুপাতে ওজন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি থাকে। যদি কোনো কারণে বাতাসে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে অন্যান্য গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যায় কিংবা বালুকণার হার বেড়ে যায়, তখন সেটি দূষিত হয়ে পড়ে।

বায়ুদূষণ যেন নগরজীবনের একটি স্থায়ী সমস্যার নাম। চলতি বছরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। বাসা থেকে বেরোলেই এ বায়ুদূষণ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারেন রাজধানীবাসী। ধুলায় আচ্ছন্ন শহরটি যেন কুয়াশার মতো ঢেকে থাকে সারাক্ষণ।

বায়ুদূষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। গত বছর রাজধানীর ছয়টি স্কুলের শিশুদের ফুসফুসের কার্যকারিতার ওপর এক গবেষণা চালানো হয়। গবেষকরা বলছেন, ২৫ শতাংশ শিশুর ফুসফুস পূর্ণমাত্রায় কাজ করছে না এবং এদের বেশিরভাগেরই বয়স ৯ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। বায়ুদূষণের ফলেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান গবেষকরা।

বাতাসে ভাসছে বিষ। রাজধানীবাসীর প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়ার কোনো সুযোগ আসলে নেই। কারণ, নিশ্বাসের সঙ্গে বিষ ঢুকে যায়! বর্তমানে ঢাকার বাতাসে বিষই উড়ে বেড়াচ্ছে। এ বিষের উৎস হলো গাড়ি, আশপাশের শিল্পাঞ্চল, ইটভাটা ও নাগরিক বর্জ্য।

সিএনজিচালিত যানবাহন থেকে বের হয় ক্ষতিকারক বেনজিন। এই বেনজিনের কারণে ঢাকায় ক্যানসারের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে বহুলাংশে। এ ছাড়া সালফার ও সিসাযুক্ত পেট্রল, জ্বালানি তেলে ভেজাল ও ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে গাড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, অ্যালডিহাইডসহ সিসার নিঃসরণ বাতাসকে দূষিত করছে।

নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বালু, সিমেন্ট ফেলে রাখা হচ্ছে রাস্তার পাশে। আবার নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও অনেক নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় ধুলা-বালুর পরিমাণ বাড়ছে অনেক গুণ। বিশাল অঞ্চলজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলে দীর্ঘদিন ধরে এবং তা বিভিন্নভাবে চারদিকে ছড়িয়ে সৃষ্টি করছে প্রকট ধুলাদূষণ।

মারাত্মক বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরের মানুষ প্রতিনিয়ত অ্যাজমা (হাঁপানি), ক্রনিক অবসট্রাক্টিভ পালমোনারি রোগ (সিওপিডি) ও ফুসফুসের ক্যানসারসহ মারাত্মক সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

কীভাবে বায়ুদূষণের জন্য হাঁপানি হয়?

হাঁপানি ফুসফুসে বারবার হয়ে চলা একটি প্রদাহজনিত অবস্থা, যাতে কিছু উদ্দীপক প্রদাহ তৈরি সাময়িকভাবে শ্বাসনালি সরু করে দেয়। এতে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। রাস্তাঘাটে প্রতিনিয়ত যে ধুলা উড়ছে, তা হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের প্রধান কারণ। ধুলা-বালু মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসযন্ত্রে ঢুকে শ্বাসকষ্টের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

শহরে দূষিত বায়ুর কারণে এ রোগের রোগীর সংখ্যা আরো বাড়ছে। ফ্রি র‍্যাডিক্যাল দেহকোষগুলোর ক্ষতি করে। দূষিত বায়ু ফুসফুসে ঢোকার পর সেখানে ফ্রি রেডিক্যালের সৃষ্টি হতে পারে। দেখা গেছে, শ্বাসতন্ত্রের অসুখ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এসব ফ্রি র‍্যাডিক্যাল।

কীভাবে সিওপিডি হয়?

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান পরিবেশদূষণ এবং মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অসংক্রামক ব্যাধি। ফুসফুসের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ রোগ, যাতে ভুগছে এ দেশের লাখো মানুষ, তা থেকে যাচ্ছে পর্দার অন্তরালে। ইংরেজিতে রোগটির নাম সিওপিডি। বাংলা করলে দাঁড়ায় ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরোধক রোগ। এটি ফুসফুসের এমন একটি রোগ, যার কারণে শ্বাসপ্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হয় এবং রোগী শ্বাসকষ্টে ভোগেন। এটি ক্রনিক অবসট্রাক্টিভ লাং ডিজিজ (সিওএলডি), ক্রনিক অবসট্রাক্টিভ এয়ারওয়ে ডিজিজ (সিওএডি), ক্রনিক এয়ারফ্লো লিমিটেশন (সিএএল) ও ক্রনিক অবসট্রাক্টিভ রেসপিরেটরি ডিজিজ (সিওআরডি) নামেও পরিচিত।

ফুসফুসের শ্বাসরোধক প্রক্রিয়াটি ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং তা মূলত হয়ে থাকে দূষিত বাতাস গ্রহণের কারণে, ফুসফুসে সৃষ্ট প্রদাহের জন্য। এই প্রদাহের জন্য ফুসফুস দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় :

এক. ফুসফুসের ছোট ছোট শ্বাসনালির ভেতরের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, স্থায়ীভাবে সংকুচিত হয় এবং সেখানে অতিরিক্ত শ্লেষা তৈরি হয়ে বায়ুরোধক প্রক্রিয়াটি বাড়িয়ে দেয়।

দুই. ফুসফুসের বায়ুকুঠুরির অস্বাভাবিক প্রদাহের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এর সংকোচন-প্রসারণক্ষমতা নষ্ট হয় এবং রক্তে অক্সিজেনের প্রবাহ কমে যায়।

কীভাবে বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের ক্যানসার হয়?

বাতাসে কার্বন মনোক্সাইড ও সালফার ডাইঅক্সাইডের প্রাবল্য দিনে দিনে মানুষের ফুসফুসের প্রদাহ বাড়াচ্ছে। দূষিত বায়ু ফুসফুসে ঢোকার পর সেখানে ফ্রি রেডিক্যালের সৃষ্টি হতে পারে। দেখা গেছে, ফুসফুসের ক্যানসার সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এসব ফ্রি র‍্যাডিক্যাল।

বায়ুদূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে কি করণীয়?

বাজারে বিভিন্ন প্রকার মাস্ক কিনতে পাওয়া যায়। তবে দূষিত বায়ুর হাত থেকে ফুসফুসকে বাঁচাতে সব ধরনের মাস্ক সমান কার্যকরী নয়। আমরা বেশিরভাগ সময়ই সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করি। কারণ, সার্জিক্যাল মাস্ক সবচেয়ে সহজলভ্য। প্রায় সব ওষুধের দোকানেই এ মাস্ক কিনতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া গেঞ্জির কাপড়ের কিছু মাস্ক পথে, ঘাটে, বাসে হকারদের কাছে পাওয়া যায়। কিন্তু বায়ুদূষণ প্রতিরোধে সার্জিক্যাল/ গেঞ্জির কাপড়ের মাস্ক সবচেয়ে কম কার্যকরী। ফিল্টার যুক্ত মাস্কের মধ্যে বা প্যাকেটের গায়ে এক কার্যকারিতার মাত্রা লেখা থাকে। ফিল্টারের কার্যকারিতা বোঝাতে ৯৫, ৯৯, ১০০ ইত্যাদি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। ৯৫ সংখ্যা দিয়ে নির্দেশ করা হচ্ছে, এ মাস্ক বায়ু থেকে ৯৫ শতাংশ দূষিত উপাদান ফিল্টার করতে সক্ষম। ৯৯ শতাংশ কার্যকারিতা সম্পন্ন এন(N) ক্যাটাগরির মাস্ক N 99 হতে পারে একটি ভালো বিকল্প। এটা একই সঙ্গে সাশ্রয়ী ও বায়ুর দূষিত উপাদান পরিশোধনে কার্যকর।

ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ ফলমূল বা শাকসবজি খেলে বায়ুদূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানো যায়। যাঁরা ফুসফুসের জটিল রোগে ভুগছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। লন্ডন হাসপাতালের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে। গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, হাঁপানি এবং সিওপিডি রোগে যাঁরা ভুগছেন তাঁদের রক্তে ভিটামিন ‘সি’-এর মাত্রা কমে গেলে বায়ুতে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সময় শ্বাসকষ্টে ভোগার ঝুঁকি বাড়ে।

লেবু, আমলকী, পেয়ারা, জাম্বুরা, আনারস, আমড়া, আম, আঙুর, কাঁচামরিচ, জলপাই, বরই, কামরাঙা, টমেটো, বাঁধাকপি, কমলালেবু ইত্যাদি ভিটামিন ‘সি’-এর গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এসবই সহজলভ্য। এ ছাড়া ভিটামিন সি আমাদের দেহে লোহা বা আয়রন শোষণে সাহায্য করে। মাছ বা মাংস, অর্থাৎ আমিষজাতীয় খাবার খাওয়ার সময় সঙ্গে লেবু খেলে দেহের লৌহ শোষণক্ষমতা বাড়ে।

লেখক : বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার, লালবাগ, ঢাকা।