নিজেকে কি স্বার্থপর মনে হয়?

Looks like you've blocked notifications!
খুব বেশি স্বার্থপরতা কি ঠিক? ছবি : প্রফেশনাল এইচআর কনসালট্যান্ট

প্রবাদে বলে মানুষ মাত্রই স্বার্থপর। তবে কোন বিষয়টিকে আসলে স্বার্থপরতা বলে? খুব বেশি স্বার্থপরতা কি নিজেকে একাও করে তোলে না?  চলুন দেখি বিশেষজ্ঞরা কী বলেন।  

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান শাহীনূর রহমান বলেন, ‘আমরা সবাই কম বেশি নিজেকে নিয়েই ভাবতে পছন্দ করি। নিজের সুযোগ সুবিধা, আরাম আয়েশ, ভালোমন্দ সবার আগে হিসেব করে নিই। তবে সেটা যদি জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় এবং অন্যর কথা না ভেবে শুধু নিজেরটাই বেশি বেশি ভাবতে থাকি তাহলে তা বেশি স্বার্থপরতায় রূপ নেয়। বেঁচে থাকার তাগিদে এবং কাজে সফলতার জন্য কিছু মাত্রায় স্বার্থপরতা ভালো। তবে বেশি মাত্রায় স্বার্থপরতা অন্যের জন্য সরাসরি এবং নিজের জন্য পরোক্ষভাবে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
 
ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমীন রহমান বলেন, ‘স্বার্থপরতা খুব প্রচলিত একটি শব্দ। কখনো আমরা কাউকে স্বার্থপর বলি। কখনো কেউ আমাদের বলে। এই শব্দটিকে আমরা নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করি। 

মূলত নিজের সুবিধার জন্য অন্য কারো ক্ষতি করছি এটাই আসলে স্বার্থপরতা। অনেক সময় মানুষ নিজেরটা এতটাই ভাবে যে অন্যের কথা ভাবতে চায় না। ব্যক্তি নিজেকে আগে বাঁচানোর চেষ্টা করে। নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য সহকর্মী বা পাশের মানুষটিকে অন্যের কাছে ছোট করে। এগুলো স্বার্থপরতার পর্যায়ে পড়ে। তবে নিজেকে ভালো করার জন্য অন্যের ক্ষতি না করে নিজের কাজটা ঠিকঠাক মতো করে যাওয়া কিন্তু স্বার্থপরতা নয়।’  

ইশরাত শারমীন আরো বলেন, ‘বেশির ভাগ মানুষ যে স্বার্থপর সেটা স্বীকার করতে চায় না। স্বার্থপরতা আবার একদিক থেকে ভালো। নিজেকে এগিয়ে নেওয়া যায়। তবে সব ক্ষেত্রে নয়। বিশেষ করে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। অন্যের ক্ষতি না করে নিজের ভালো করা ভালো। কেবল নিজের সুবিধা দেখা তা নয়, অন্যের ক্ষতিটা এখানে বুঝতে হবে।’

মানুষের স্বার্থপরতার কিছু কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকারের কথা জানিয়েছেন শাহীনূর রহমান। তাঁর মতে, ‘জন্মগত ভাবেই আমরা স্বার্থপর। তবে সাধারণত নিজের দুর্বলতা ঢাকতে, আত্মবিশ্বাসের অভাবে এবং নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে ব্যক্তি বেশি স্বার্থপরতা প্রকাশ করে।’  

স্বার্থপরতার কারণ 

দুর্বলতা
স্বার্থপর ব্যক্তিরা অন্যকে সময় দিতে ও সহযোগিতা করতে ভয় পায় এই ভেবে যে, সে অযথা সময় নষ্ট করছে এবং তার সফল হওয়ার পথ এতেই হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। এ রকম একটি অনিশ্চয়তাবোধ ব্যক্তিকে স্বার্থপর করে তোলে। তা ছাড়া নিজের দুর্বলতাকে পুষিয়ে নিতে ব্যক্তি নিজের দিকে বেশি মনোযোগী হয়। অথচ চাইলেই সে ছাড় দিতে পারে। কিন্তু নিজের দুর্বলতা সবার সামনে প্রকাশ পেয়ে যাবে এই ভয়ে অন্যের কথা না ভেবে নিজেকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে।  

হারানোর ভীতি
ব্যক্তি তার নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে স্বার্থপর আচরণ করে। ব্যক্তির জীবনে অনেক চাহিদা ও লক্ষ্য থাকতে পারে। স্বার্থপর ব্যক্তিরা বিশ্বাস করে, জীবনের সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর সামর্থ তার নেই। কিংবা লক্ষ্যে পৌঁছাতে সে অক্ষম। তাই সবটুকু সময় এবং সামর্থ্য লক্ষ্য অর্জনের পিছনেই ব্যয় করার জন্য সংরক্ষণ করে রাখে এবং ওই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলেই তার মনে হয় সে তার জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। এর ফলে মানুষ স্বার্থপর আচরণ শুরু করে। 

নিজের ওপর আত্মবিশ্বাসের অভাব
এরা নিজেদের ওপরই আস্থা রাখতে অক্ষম। এরা নিজেদের ভালোভাবে চিনতে পারে না। নিজের দুর্বলতা, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে এরা অজ্ঞাত থাকে। যার কারণে বেশির ভাগ সময়ই এরা ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, আর স্বার্থপর আচরণ করে। 

মানসিক অসুস্থতা
অতি মাত্রায় স্বার্থপরতা অনেক সময় মানসিক স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিত্বের গোলোযোগ থেকেও জন্ম লাভ করে। বিশেষ করে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, হতাশা, ইনফেরিউরিটি কমপ্লেক্স, সুপ্ত প্রতিবন্ধিতা, সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ব এবং নারসিসটিক ব্যক্তিত্বের গোলোযোগ ব্যক্তিকে স্বার্থপর করে তোলে। 

স্বার্থপরতার লক্ষণ
• স্বার্থপর ব্যক্তি সাধারণত কারো সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে নিজেরটাই ভেবে যায়। অন্যের দরকারটা দেখে কম। 

• অন্যের প্রসংশা হয়তো করছে তবে সেটিও নিজের স্বার্থের জন্য। 

• অন্যের সমস্যা নিয়ে গালগল্প বেশি করে।

• কম্প্রোমাইজ বা সেক্রিফাইস বিষয়গুলো থাকে না। কেবল নিজেরটা ভাবে। 

এই ধরনের ব্যক্তির সঙ্গে মেশার ক্ষেত্রে যা করতে পারেন

• যেকোনো সম্পর্কে দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি থাকে। যদি কাউকে স্বার্থপর মনে হয়, সেই ব্যক্তির কাছ থেকেও মাঝেমধ্যে সাহায্য চাইতে হবে। তাকে অনুরোধ করতে পারেন আপনার জন্য কোনো কাজ করে দিতে।

• যদি খুব বেশি মিশতে না চান তাহলে যোগাযোগটা ফরমাল করা যেতে পারে। 

• যদি স্বার্থপর ব্যক্তিটির চাওয়াগুলো পূরণ করতে খুব অসুবিধা হয়, তাহলে তাকে ‘না’ বলুন।

• স্বার্থপর লোকটি নিজেরটাই বারবার বলতে চায়। তাই আপনারও যে একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে এটি তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন।

• তার কোনো আচরণে কষ্ট পেলে তার সঙ্গে কথা বলুন। বলুন যে তার আচরণ আপনার খুব খারাপ লেগেছে।

• বাউন্ডারি সেট করা যে, এই মানুষটির জন্য আমি ঠিক কতটুকু করব। 

• যদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন হয় যে অপর ব্যক্তিটি বলার পরও বারবারই স্বার্থপরের মতো আচরণ করে যাচ্ছে তখন সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। 

• স্বার্থপর লোকেরা খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়। সে সবসময় চায় কোনো কিছুর মধ্যমণি হয়ে থাকতে। তবে সবসময় তার মন রক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তাকে বোঝানো কেবল তার মতামতই নয়, অন্যেরও কিছু মতামত আছে। 

স্বার্থপরতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায়

স্বার্থপর হলে কি সবসময় লাভবান হওয়া যায়? স্বার্থপর ব্যক্তিটি তো অন্যের বিরক্তির কারণ হতে হতে মাঝেমধ্যে একাও হয়ে যায়। যদি মনে করেন স্বার্থপরতা অন্যের চোখে আপনাকে বারবার ছোট করে দিচ্ছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন।  

সহকারী অধ্যাপক শাহীনূর রহমানের মতে, স্বার্থপরতা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। কিন্তু কেউ ঐকান্তিভাবে চেষ্টা করলে এই স্বার্থপরতাকে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করা যায়। 

• নিজেকে জানার চেষ্টা করা। নিজের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করা এবং তা মেনে নেওয়া। সম্ভব হলে সেই দুর্বলতাকে কাটানোর জন্য ওই বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করা।

• নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস বাড়ানো। জীবনের সমস্যগুলো সাফল্যের সঙ্গে ইতি বাচকভাবে মোকাবিলা করার কৌশল রপ্ত করা। তাতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভীতি কমে আসবে।

• সাধ ও সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবনের বাস্তব লক্ষ্য নির্ধারণ করা। 

• নিজের জীবনকে বিভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে দেখা এবং অন্যের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে অন্যকে বোঝার চেষ্টা করা।  

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমীন রহমানের মতে,

• অন্যকে কথা বলতে দিতে হবে। অন্যেরও যে নিজস্ব মতামত আছে সেটি ভাবতে হবে। 

• অন্যের অবস্থানে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে হবে। 

• যারা স্বার্থপর তারা সাধারণত নিজের জায়গাটা বড় করে উপস্থাপন করে। আসলে নিজের অহংকার বোধ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। 

• স্বার্থপর হওয়ার কারণে অনেকে খুব বাজে আচরণ করে। এ ক্ষেত্রে নিজেকে সামলে একটু ধৈর্য ধরার চেষ্টা করতে হবে।   

• কেউ খুব বিপদে পড়লে তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করা। তাকে সাহায্য করা। 

• মাঝেমধ্যে কাউকে গিফট করতে পারেন। 

• নিজের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে অন্যকে সুযোগ দেওয়া। অন্যের একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী বা চিন্তার জায়গা আছে- সেটাকে বুঝতে শেখা।

• মানুষকে সহযোগিতা করা।

• অনেকে ভাবে এটা করলে কি স্বার্থপরের মতো আচরণ হবে? আসলে নিজের যতটুকু নেওয়ার ততটুকু নেব। অধিকারের জায়গাটা থাকবে। তবে এটা যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয় সেটা খেয়াল করতে হবে।