পিত্তথলির সমস্যা কেন হয়
পিত্তথলি দেহের প্রয়োজনীয় অংশ। বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে পিত্তথলিতে। আজ ৮ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৬০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অ্যাপোলো হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ডা. এস এম জি কিবরিয়া।
প্রশ্ন : গলব্লাডারের সমস্যা অত্যন্ত প্রচলিত। গলব্লাডার জিনিসটি কী এবং এর কাজ কী?
উত্তর : আমাদের যকৃত থেকে প্রতিদিন ৫০০ মিলিলিটারের মতো পিত্ত তৈরি হয়। এই পিত্তের কাজ হচ্ছে চর্বিজাতীয় খাবারকে শরীরে ঢুকতে সাহায্য করা। আপনারা অনেকেই দেখেছেন খাওয়ার পর চর্বি প্লেটের মধ্যে লেগে থাকে। ওখানে সাবান দিলে চর্বিটা ঠান্ডা পানিতেও গলে যায়। ঠিক তেমনি আপনার খাওয়া চর্বি যখন ক্ষুদ্রান্ত্রে আসে, তখন গলব্লাডার বা পিত্তথলিতে যে পিত্তটা জমা ছিল সেটা বের হয়। এটা বেরিয়ে আসার পরে পিত্তের সঙ্গে চর্বির মিশ্রণের ফলে চর্বিটা হজম হতে সাহায্য হয়। এই হচ্ছে পিত্ত এবং গলব্লাডারের কাজ।
প্রশ্ন : পিত্তথলি যদি সঠিকভাবে কাজ না করে সেই ক্ষেত্রে চর্বিজাতীয় খাবার হজমে অসুবিধা হবে। ফলে ওই চর্বি বা ফ্যাটের সঙ্গে ভিটামিন কে বা আরো প্রয়োজনীয় ভিটামিনগুলোও শোষণ হবে না এবং নানা রকম সমস্যা দেখা দেবে।
উত্তর : সমস্যা দেখা দেয় ঠিকই, কিন্তু অনেকেরই আছে পিত্তথলি নেই বা পিত্তথলি কাজ করছে না, দীর্ঘদিন ধরে পিত্তথলির রোগে ভুগছেন, তার মানে এই না যে তাদের ভিটামিন এ ডি ই কে শোষণ হবে না। বা আমাদের শরীরে ঢুকতে পারবে না। যাদের গলব্লাডারে সমস্যা আছে, এটি যখন ফেলে দেওয়া হয় সেই ক্ষেত্রে শরীর এটাকে অবশ্যই সমন্বয় করে নেয়। পিত্তটা প্রতিদিনই আমাদের অন্ত্রের মধ্যে আসে। তবে এত ঘনভাবে আসে না। খাওয়ার সময় আসে না। কিন্তু সার্বক্ষণিকভাবে আসতে থাকে। তাই ওই ভিটামিনগুলো শোষণে সমস্যা হয় না।
প্রশ্ন : একজন মানুষের গলব্লাডারে সাধারণত কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : পিত্তথলির ক্যানসার। অনেক দিন ভোগার পর পিত্তথলি আর কাজ না করা এগুলো হলো পিত্তথলির সবচেয়ে বড় সমস্যা।
প্রশ্ন : অনেক সময় এখানে যক্ষ্মা বা টিউবারকোলোসিসও (টিবি) হতে শোনা যায়...
উত্তর : হ্যাঁ, এটিও হতে পারে। বিশেষ করে তিন দশক ধরে বিদেশে কাজ করার সময় আমি যখন দেশে আসছিলাম, তখন আমাকে একজন বলেছিলেন তুমি কি টিবির কথা মনে রাখবে? আমাদের শিক্ষকরা পড়াতেন, যখনই আর কোনো সমস্যা ধরা পড়বে না তখন ধরে নেবে টিবি হয়েছে। অনেক অসুখই আছে যা টিবির কারণে হয়। সেই জন্য আমরা যখন আর কোনো কিছু ধরতে না পারি, তখন টিবির কথা মনে রাখি।
প্রশ্ন : পিত্তথলিতে পাথর সাধারণত হয় কেন? কাদের ঝুঁকি বেশি?
উত্তর : আমরা মায়েদের দেখেছি চিনির সিরা করতে। সিরা করতে করতে একসময় এর মধ্যে দানা তৈরি হতে দেখা যায়। ঠিক তেমনি গলব্লাডারের কাজ পিত্তকে ঘন করা। আর এই পিত্তের মধ্যে কোলেস্টেরল বড় উপাদান। ঘন করতে করতে একসময় কোলেস্টেলের দানা তৈরি হয়। আর একটা দানার ওপরই আরেকটা দানা হতে থাকে। এবং আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। অনেকগুলো হতে থাকে। যাঁরা একটু মোটা, বেশি কাজ করেন না, যাঁদের কোলেস্টেরল বেশি, যাঁদের ডায়াবেটিস তাঁদের গলব্লাডারের মধ্যে পাথর হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
প্রশ্ন : পিত্তথলিতে পাথর হলে কী ধরনের লক্ষণ দেখা দেবে?
উত্তর : দেখুন আমি ৫০ ঊর্ধ্বে। আমার যদি স্ক্যান করেন, তাহলে দেখবেন হয়তো পাথর আছে। বিষয়টি হচ্ছে, আমরা প্রায় সবাই পাথর তৈরি করি। প্রায় ৯০ ভাগ মানুষের কোনো উপসর্গ থাকে না। এদের আমরা হঠাৎ বিভিন্ন কারণে ধরতে পারি।
আর যাদের উপসর্গ হয়, তাদের দুই ধরনের উপসর্গ হয়। হঠাৎ হয়তো পেটের ওপরের দিকে ভীষণ ব্যথা হলো, এই ব্যথাটি পেছনের দিকে যায়, এবং এত ব্যথা হয় যে কোনো অবস্থাতেই ব্যথাটি চলে যায় না। সঙ্গে বুকে জ্বালা হয়, বমি হয়। খুব শক্তিশালী ব্যথানাশক ওষুধ না দিলে ব্যথাটি যায় না। পাথর ব্যথা করে, সঙ্গে যদি ইনফেকশন হয়, তখন ব্যথা করতে পারে।
প্রশ্ন : এ ধরনের রোগে কী ধরনের চিকিৎসা করে থাকেন?
উত্তর : চিকিৎসা নির্ভর করে একজনের শারীরিক অবস্থা কী রকম তার ওপর। হয়তো এমন একজন রোগী এসেছেন যাঁর ৯৫ বছর বয়স, তাঁর এ রকম সমস্যা হয়েছে, আবার তাঁর শরীরে আরো বিভিন্ন ধরনের সমস্যা আছে যার জন্য অস্ত্রোপচার করাটা মারাত্মক হবে। সেই সমস্ত রোগীর ক্ষেত্রে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে এবং ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করি। আর এ ধরনের রোগী যদি এরপরও ভালো না হয় তখন বাধ্য হয়ে অস্ত্রোপচার করতে হয়।
এ ছাড়া অন্যান্য দিক থেকে সুস্থ রোগীর যদি এই ধরনের সমস্যা হয় তখন গলব্লাডারটা ফেলে দেওয়াই উচিত হবে।
প্রশ্ন : সার্জারির ক্ষেত্রে ইদানীং ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে ল্যাপারোস্কপিক সার্জারি বিশেষ করে গলব্লাডারের ক্ষেত্রে। আগে ওপেন করে সার্জারি করা হতো, এখন ল্যাপারোস্কপি করা হয়। এই ল্যাপারোস্কপি সার্জারির সুবিধা কোথায়?
উত্তর : দেখুন ১৯৮৬ সালে যখন ফ্রান্সে এই চিকিৎসাটি প্রথম করা হয়, তখন অনেক লোকেই এটাকে টিটকারি মেরেছিল। অথচ আজকে বিশ্বব্যাপী এর বিপ্লব হয়েছে বলতে পারেন। বলতে পারেন গলব্লাডারের সার্জারিটায় ল্যাপারোস্কপি পথিকৃত। এটা সবচেয়ে সুবিধা হচ্ছে বিরাট করে কাটতে হয় না। আগে ১৪ দিন হাসপাতালে থাকতে হতো, এখন সেটি হয় না। একদিনের মধ্যেই বাসায় চলে যেতে পারছেন।
একটি ঘটনা বলি, আটদিন আগে আমার কাছে একজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন, ৪৪ বছর বয়স, জটিল কোলেসিসটাইটিস। ওনাকে বুঝিয়ে ল্যাপারোস্কপি করলাম। পরের দিন বেলা ১২টা নাগাদ উনি হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেলেন। এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সুবিধা। রোগীর পেট কাটা হয় না, ব্যথা হয় না, বাড়িতে বসেও সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। অস্ত্রোপচারের সঙ্গে আনুষঙ্গিক যে সমস্যাগুলো থাকে যেমন রক্তপাত, সংক্রমণ এগুলোর আশঙ্কা কম থাকে। সবচেয়ে বড় কথা রোগী বাড়িতে আপন পরিবেশে ফিরে যেতে পারে। কাজ করতে পারে। এ জন্যই ল্যাপারোস্কপি সার্জারি দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।