রোজায় মুখ ও দাঁতের যত্ন
রোজার সময় মুখ ও দাঁতের যত্ন নিয়ে অনেকের মনেই কিছু প্রশ্ন জাগে। এ বিষয়ে আজ ১৯ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৭১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্ট এন্ডোডনটিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসারভেরটিভ ডেনট্রিসট্রি এবং এন্ডোডনট্রিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ কে এম বাশার।
প্রশ্ন: মুখ ও দাঁতের যেসব রোগ হয় তার বেশিরভাগই প্রতিরোধযোগ্য। রোজার সময়ে এর যত্নের বিষয়ে কিছু প্রশ্ন মানুষের মনে জাগে । মুখ ও দাঁতের রোগ প্রতিরোধে যত্ন বা পরিচর্যা গুরুত্বপূর্ণ কেন?
উত্তর: দাঁতের বেশিরভাগ রোগই মুখ ও দাঁতের ঠিকমতো যত্ন না হওয়ার জন্য হয়ে থাকে। দাঁতের অধিকাংশ রোগই হয় ক্ষয় বা ক্যারিজ থেকে। আর বাকি অর্ধেকের বেশিরভাগ হচ্ছে মাড়ি জনিত রোগ। এই সমস্ত রোগগুলো মূলত জমে থাকা খাবার থেকে হয়। তার মানে যদি যত্নের অভাব ঘটে তাহলেই দাঁতের রোগগুলো বিস্তার লাভ করে। সেই হিসাবে দাঁত ও মুখের রোগ প্রতিরোধে যত্নের বিকল্প আসলেই কিছু নেই।
প্রশ্ন: অনেকেই বলে থাকেন আমাদের আগের প্রজন্ম হাত দিয়ে, কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতেন- তখন এতো রোগ হতো না। এখন নানা রকমের পেস্ট ব্যবহার করছি। ব্রাশ করছি তারপরও দাঁতের রোগ হচ্ছে।
উত্তর: আসলে এখানে একটা বিষয় জেনে নেওয়া জরুরি। সেটা হলো, আমি পরিষ্কারের জন্য কোনো কিছু ব্যবহার করছি আর আমি ঠিকমত পরিষ্কার করছি। এই দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। নিয়ম মেনে সঠিকভাবে করছি কি না এটা জরুরি। আর আগেকার দিনের সঙ্গে যে তুলনা সেটা হলো, খাদ্যাভাসের সঙ্গে কিছু বিষয় রয়ে গেছে। এখনকার সময় আমরা বেশিরভাগ সময় রিফাইন খাবার ব্যবহার করি। বাচ্চারা বা তরুণ সমাজ সুগারি ফুড বা ফাস্ট ফুড বেশি খায়। এগুলো দ্রুত খাওয়া হয় তবে পরিষ্কারটা ঠিকভাবে হয় না। যার ফলে এখন দাঁতের এবং মুখের রোগের প্রার্দুভাব বেশি। পাশ্চাত্যেও এখন একই সমস্যা। ফাস্ট ফুড, সুগারি ফুড এগুলো দাঁতের এসিড নিঃস্বরণ বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে দাঁতে ক্ষয় হয় এবং অন্যান্য রোগগুলোও বৃদ্ধি পায়।
প্রশ্ন: দাঁত এবং মুখের যত্ন বা পরিচর্যা কীভাবে করবে?
উত্তর: যত্ন বা পরিচর্যার ক্ষেত্রে একটি বিষয় হলো ব্রাশিং। দাঁতকে ব্রাশের মাধ্যমে পরিষ্কার করা। অথবা কেউ যদি মেসওয়াক ব্যবহার করে থাকে তবে সঠিকভাবে, সঠিক ধরণের মেসওয়াক ব্যবহার করা। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন দুটোকেই কার্যকরভাবে অনুমোদন দিয়েছে। এরপর দাঁতের মাঝখানের জায়গাগুলোকে পরিষ্কার করার জন্য বিশেষ ধরনের জীবানুমুক্ত সুতা, যার মাধ্যমে দাঁতের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাগুলোতে খাবার জমে থাকলে পরিষ্কার করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে ইন্টার ডেন্টাল ব্রাশ রয়ে গেছে যেখানে মাঝখানের ফাঁকাটা অনেক বেশি, একটি সুতার মাধ্যমে সঠিকভাবে পরিষ্কার হয় না। তখন ওই জায়গার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশিত ব্রাশ ব্যবহার করতে হবে। এই সবগুলো ব্রাশ সঠিক নিয়মে এবং সঠিক সময়ে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: সঠিক নিয়ম মানে কী?
উত্তর: আমরা বেশিরভাগ সময়ে এখন বিজ্ঞাপনগুলোতেও দেখে থাকি, উপরের দাঁতের জন্য উপর থেকে নিচে এবং নীচের দাঁতের জন্য নীচ থেকে উপরের দিকে ব্রাশ করতে হবে। তবে একটু পার্থক্য রয়ে গেছে যেটা আমরা অনেক সময় বিজ্ঞাপনের ভেতর বুঝতে পারি না। সেটা হচ্ছে ব্রাশটাকে আসলে মাড়ির সঙ্গে আড়াআড়িভাবে ধরতে হয়। একটু হালকা চাপ দিয়ে ওই জায়গাতে একটু কম্পন করে নিতে হবে। ফলে জমে থাকা খাবার গুলো প্রথমে আলগা হবে। এরপর যখন উপর থেকে নিচের দিকে ব্রাশটা টেনে নিয়ে আসা হয় তখন এটা পুরোপুরিভাবে আলাদা হয়ে যায়।
প্রশ্ন: এটাতো বাহিরের দিকটা গেল, দাঁতের উপরে যেখান দিয়ে আমরা চাবাই ওই অংশ কীভাবে পরিষ্কার করতে হবে?
উত্তর: দাঁতের উপরে রেখে এটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ব্রাশ করতে হবে।
প্রশ্ন: সময়টা কখন হলে ভালো হয়?
উত্তর: সবসময় খাবারের পরে। কোনো কোনো খাবারের পরে যদি আমরা ব্রাশটা করি তাহলে খাবারটা জমে থাকতে পারে না। দাঁতের রোগের ক্ষেত্রে মূলত খাবার এবং সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খাবারটা জমে থাকলেই রোগটা হয়। এক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষ রাখতে হবে কিছু রোগীরা আছেন যাদের বেশি এসিডিটি হয়। দাঁতের একটি বড় রোগ হচ্ছে এসিডিক ক্ষয় হয়ে যাওয়া। এই ধরনের রোগীদের খাবার পরে ব্রাশ করতে হবে। তবে কিছু সময়ের ব্যবধানে করতে হবে।
প্রশ্ন: কেমন ব্যবধানে করলে ভালো?
উত্তর: কমপক্ষে আধা ঘণ্টা বিরতি দিয়ে। এর কারণ হচ্ছে মুখের ভেতরে জমে থাকা যে স্যালাইভা, থুথু বা লালা রয়ে গেছে এর মাধ্যমে এসিড নিউট্রালাইজড হয়ে যায়।
প্রশ্ন: দাঁত ও মুখের রোগ প্রতিরোধে মাউথ ওয়াশের কোনো ভূমিকা আছে কী?
উত্তর: চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা মূলত মাউথ ওয়াশ দিয়ে থাকি। যেমন, পোস্ট সার্জিক্যাল। কোনো অস্ত্রোপচার, সার্জারি হয়ে থাকলে রক্তপাত ঘটলে এটি ব্যবহার করতে দিই। তবে নিয়মিত ব্যবহারের জন্য আলাদা মাউথ ওয়াশ রয়েছে। কারণ সাধারণভাবে মাউথ ওয়াশের মধ্যে জীবাণুনাশক ওষুধ দেওয়া হয়। যেটা দীর্ঘ মেয়াদী ব্যবহারের ফলে মুখের ভেতর থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো দূর হয়ে যায়। ফলে যেই সমস্ত ব্যকটেরিয়াগুলো সুযোগ সন্ধানী থাকে সেগুলোর সংখ্যা আবার বেড়ে যায়। অন্যভাবে সংক্রমণ হয়।
প্রশ্ন: পেস্টের ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী? অনেকেই জিজ্ঞেস করেন কী ধরনের পেস্ট ব্যবহার করা ভালো?
উত্তর: সাধারণভাবে আমরা ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্টের কথা বলি। কারণ ফ্লোরাইড যখন আমরা কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় ব্যবহার করি তখন এটার একটা কার্যকারিতা প্রমাণিত। ফলে দেখা যায় দাঁতের গঠন আপেক্ষিকভাবে শক্ত হয়, যেটা এসিডের বিরুদ্ধে কাজ করে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের উপাদান পেস্টের মধ্যে দেয়। চিকিৎসক যদি বিশেষ কোনো নির্দেশনা না দিয়ে থাকে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট বদল করে ব্যবহার করাটাই সবচেয়ে ভালো। এতে বিভিন্ন উপাদান মুখের ভেতর পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: এবার একটু রোজার প্রসঙ্গে যাই, রোজার সময় অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে রোজা রাখা অবস্থায় তিনি দাঁত ব্রাশ করবেন কি না?
উত্তর: একটা বিষয় হচ্ছে, রোজার মধ্যে আমরা ইফতার, সেহেরি এবং সন্ধ্যারাতে খাই। এই সময়ে যেমন ইফতারের পরেই ব্রাশ করা খুব সহজে সম্ভব, সেহেরির পরেও যদি একটু সময়ের দিকে লক্ষ রাখা হয় তাহলে ব্রাশ করে নেওয়া সম্ভব। আর রাতের খাবারের পরেতো সম্ভবই। সুতরাং ব্রাশের যে নির্দিষ্ট সময় পালন করা এটা আসলে রোজার মধ্যে তেমন পার্থক্য হয় না। এরপরে যদি কেউ দিনের বেলায় ব্রাশ করতে চায়, সেক্ষেত্রে সাধারণভাবে মুফতি সাহেবরা বলে থাকেন পেস্ট স্বাদযুক্ত ব্যাপার এবং এটি রোজার মধ্যে ব্যবহার করাটা মাকরুহ। সুতরাং এই সময় পেস্ট ছাড়া ব্রাশ করা যেতে পারে। লক্ষণীয় বিষয় হলো সঠিক নিয়মে ব্রাশটা গুরুত্বপূর্ণ। আর পেস্টটা হলো এর সঙ্গে বাড়তি একটা বিষয়। সুতরাং পেস্ট না ব্যবহার করেও যদি কেউ সঠিক নিয়মে ব্রাশ করতে পারে তাহলে সেটাও দাঁতের যত্নের জন্য যথেষ্ট। অথবা মেসওয়াক ব্যবহার করতে পারেন।
প্রশ্ন: আরেকটি বিষয়, মুখ ও দাঁতের পরিচর্যায় এসব জিনিস মানার পরেও ডেন্টিস্টরা বলে থাকেন প্রতি ছয় মাস পর পর একবার তাদের কাছে যেতে, চেকআপ করতে। এটা কী দাঁত ও মুখের রোগ প্রতিরোধে কোনো ভূমিকা রাখে?
উত্তর: এটা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে এইভাবে, আসলে অনেকের দাঁতেই এরকম থাকে। রোগীরা যে বলে আমরা এতবার ব্রাশ করছি তারপরও সমস্যা হচ্ছে এর একটা কারণ, অনেক রোগীর দাঁত আঁকা বাকা থাকে। দাঁতের সংখ্যা কারো বেশি থাকে, আক্কেল দাঁত উঠে থাকে, যেগুলো আঁকা বাকা হয়ে থাকে। ফলে রোগী চাইলেও সেইভাবে এটাকে পরিষ্কার করতে পারে না। যেভাবে করলে ঠিক হতো। এছাড়া যা স্বাভাবিক গঠনের দাঁত সেখানেও এটি হওয়াটা কিছু না।
সামান্য একটু সরিষার দানার মতো খাবারের অংশও যদি দুই দাঁতের মাঝখানে লেগে থাকে, এটা চারদিন লেগে থাকলেও, দাঁতের পাথরে পরিণত হয়। সুতরাং খুব ভালো করে ব্রাশ করার পরেও এরকম হতেই পারে। তাই এটা যদি সময়ের আগেই দূর করে দেওয়া যায় তাহলে পরবর্তী রোগগুলো হয় না। এই চেকআপে পরবর্তী জটিলতাগুলো এড়ানো যায়। এছাড়া শুরুতে ধরা পড়লে খাদ্যাভাস পরিবর্তন বা ব্রাশিং পদ্ধতি পরিবর্তন করার মাধ্যমেও শুরু হওয়া পাথর অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়।
প্রশ্ন: বেশি সচেতন হতে গিয়ে অনেককে দেখা যায় অনেক সময় ধরে দাঁত ব্রাশ করেন, আবার অনেকে শক্ত ব্রাশ ব্যবহার করেন-এসব কারণে কী সমস্যা হতে পারে?
উত্তর: আমরা সবসময় নরম ব্রাশ ব্যবহার করার পরার্মশ দিই। কারণ শক্ত ব্রাশ ব্যবহার করলে দাঁতের ক্ষয় হয়। আবার একইভাবে সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ না করা হলেও সমস্যা হয়। আর যদি অতিরিক্ত সময় ধরে করা হয় তবে দেখা যায় একই জায়গাতে বার বার একটি জিনিস ঘর্ষণের ফলে দাঁতের ক্ষয় হয়। সুতরাং সঠিক সময়ে, সঠিক নিয়মে, অল্প সময়ের মধ্যেও ব্রাশ করা জরুরি।