গর্ভধারণ করলেই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করুন

Looks like you've blocked notifications!
ডা. তোফায়েল আহমেদ।

গর্ভবতী মায়েদের বেলায় ডায়াবেটিস একটি সমস্যা। দুভাবে এটি হতে পারে। একটি, আগে থেকেই কোনো নারী ডায়াবেটিক রোগী ছিলেন, তিনি সন্তান ধারণ করতে চান বা সন্তান ধারণ করলেন। আরেকটি হচ্ছে আগে থেকে ডায়াবেটিস ছিল না, সন্তান ধারণ করার পর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেন। যেটাই হোক না কেন, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে না রাখলে এটি ঝুঁকির কারণ হতে পারে। আজ ১৩ জুলাই এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৯৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দেশের খ্যাতনামা এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বারডেম হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ।

প্রশ্ন : যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের সন্তান ধারণের জন্য কোনো প্রস্তুতি আছে কি না?

উত্তর : আপনার উত্তরটি দেওয়ার আগে একটু কথা বলতে চাই, আগে যখন ডায়াবেটিস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কম ছিল, ডায়াবেটিসের চিকিৎসা সম্পর্কে জানা ছিল না, তখন বলা হতো কোনো মা যদি গর্ভবতী হোন, এটা তার জীবনের ওপর হুমকিস্বরূপ। কারণ, যদি আমরা ১৮০০ সালের দিকে তাকাই, যত ডাটা আছে দেখব অন্তত শতকরা ৮০ জন মায়ের জীবন শেষ হয়েছে এ ধরনের গর্ভধারণে। তবে এখন বলা হয়, যাদের ডায়াবেটিস থাকে তাদের অন্য গর্ভবতী নারীর তুলনায় ঝুঁকি সমান বা কম থাকে। এটা আসলেই সম্ভব হয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির ফলে এবং সেটার সুব্যবহারের জন্য।

আপনি জানতে চেয়েছেন, যারা মা হতে চায় তাদের যদি ডায়াবেটিস থাকে তবে কী করতে হবে? আসলে তাদের ডায়াবেটিস এতটাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যে পেটে বাচ্চাটি যেন টের না পায় ডায়াবেটিস আছে। সাধারণভাবে আমরা বলি, মাকে অবশ্যই ডায়াবেটিসের মাত্রা ছয় মিলিমোলের নিচে রাখতে হবে। বলা হয় এটা কী সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব।urgentPhoto

প্রশ্ন : কীভাবে?

উত্তর : মায়েদের ঐকান্তিক ইচ্ছা এবং চিকিৎসকদের পরামর্শ—দুটো একত্রে হলে এটা সম্ভব। মায়েরা গর্ভধারণের আগে ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ নেন চিকিৎসকদের কাছে। তাঁরা নিজের ব্লাড সুগার পরীক্ষা করতে পারেন। ডায়েটের সামঞ্জস্য করতে পারেন। তাঁদের এইচবিএওয়ানসি সাড়ে ৬ শতাংশের নিচে আনা হয়, এর পর তাঁরা বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। উনি হয়তো খাওয়ার ওষুধ দিয়ে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে এ সময় তাঁকে আগে থেকে ইনসুলিনে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিতে হবে। মুখে খাওয়ার ওষুধ তখন সাধারণত পরিহার করা হয়।

কারণ, বাচ্চা পেটে এলে খাবারের ওষুধটা যদি চালিয়ে যাই, তাহলে ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রিত থাকবে না। আরেকটি হলো এই ওষুধ মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার শরীরে চলে যাবে। বাচ্চার তো ডায়াবেটিক নাই তাই কী করে এই ওষুধ শরীরে প্রয়োগ করবেন? তাই আমরা ইনসুলিনের ব্যবহার, এর প্রয়োগ, মাকে ও তার পরিবারকে বুঝিয়ে তারপর শুরু করি। এ সময় তাকে পুষ্টিবিদ, গাইনোকোলজিস্ট, এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট সবার সমন্বয়ে মাল্টিডিসিপ্লিনারি ফ্যাক্টরে চিকিৎসা করা হয়। তখন মাতৃত্ব এতটাই নিরাপদ হবে যতটা ডায়াবেটিস না থাকলে করা যায়।

প্রশ্ন :  যদি গুরুত্ব না দিয়ে এর নিয়ন্ত্রণ না করেন তাহলে মা এবং তার গর্ভজাত সন্তানের কী সমস্যা হতে পারে?

উত্তর :  ওই রকমভাবে অনিয়ন্ত্রিত থাকলে মায়ের জীবন তো হুমকির মুখে পড়বে। আর না হলে তার রক্তচাপের সমস্যা হবে, চোখের সমস্যা থাকলে আরো খারাপ হবে। তার চোখের সমস্যা আগে থাকলে সেটা খারাপ হবে। কিডনি সমস্যা আগে থাকলে সেটা খারাপ হবে। একলামশিয়া বাড়বে।

দেখা যাবে বাচ্চা পেটে বেশি বড়  হচ্ছে। তবে অপরিপক্ব বাচ্চা হচ্ছে। সে যদি জীবিতও জন্মায়, অনেক সময় শ্বাসকষ্টের জন্য মারা যায়। কারণ তাদের অঙ্গগুলো পরিপক্ব হয় না। এদের বাঁচাতে হলে বাচ্চাদের আইসিওতে রাখতে হয়। তাদের জন্ডিস, হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়। এগুলো যদি আমরা সুনিয়ন্ত্রিত রাখতে পারি, এই সমস্যাগুলো আর হবে না।

প্রশ্ন : গর্ভবতী মায়েদের ডায়াবেটিসের বেলায় আরেকটি শব্দ খুব পরিচিত, সেটা হলো জেসটেশনাল ডায়াবেটিস। অর্থাৎ গর্ভধারণের পর তিনি ডায়াবেটিক রোগী হয়ে গেলেন। এটি হয় কেন?

উত্তর : আমাদের জানামতে, ডায়াবেটিক হওয়ার যত কারণ রয়েছে, সবচেয়ে বড় কারণ হলো গর্ভধারণ। একজন গর্ভবতী মায়ের শরীরে যে হরমোনের পরিবর্তন আসে, সব প্লাসেন্টা নামক এক ধরনের অস্থায়ী এন্ডোক্রিন অঙ্গ থেকে আসে। এ যতগুলো হরমোন দেয় সব ইনসুলিনের বিপক্ষে এবং ডায়াবেটিস তৈরি করে। তাই প্রতিটি গর্ভধারণে মায়ের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সব মায়েরই উচিত গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়েছে কি না, সেটি চেক করা। এটা পরীক্ষা করারও একটি বিশেষ সময় আছে ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহ। কিন্তু কারো যদি পরিবারেই ইতিহাস ইতিবাচক থাকে, তবে সে আগে থেকে করবে। আগে না ধরা পড়লে আবার করবে।  তখন থেকে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবে যখনই আস্তে আস্তে রক্তে শর্করা বাড়ে, ওই সময় সামান্য হলেও ইনসুলিন লাগে—এটা মেনে চললে বাচ্চা খুব ভালো থাকে। এর দুটো গুরুত্ব রয়েছে—মা এবং শিশুস্বাস্থ্যের গুরুত্ব। আরেকটি হলো যে মায়ের ডায়াবেটিস আছে, তাদের যদি অনিয়ন্ত্রিত থাকে তবে বাচ্চাগুলোর অল্প বয়সে ডায়াবেটিস হয়ে যায়। যদি আমরা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসটা ঠিকমতো ধরতে পারি, তাহলে বাচ্চার ডায়াবেটিক দেরিতে হবে। আর সুনিয়ন্ত্রিত না থাকলে খুব ছোট বয়সে, ১২/১৪ বয়সে  বাচ্চার ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যারা জন্মায় তাদের পেনক্রিয়াসে বিটা সেলের পরিমাণ খুব কম নিয়ে জন্মায়, এ জন্য ডায়াবেটিস হয়ে যায়। এ জন্য গর্ভবতী মা এবং তাঁর সন্তান দুজনের সুস্থতার জন্য ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধে রাখতে হবে।