মানসিক চাপ কমান, নিয়ন্ত্রণ হবে উচ্চ রক্তচাপ

Looks like you've blocked notifications!
ডা. মো. ফারহাদ হোসেন।

উচ্চ রক্তচাপ দেহে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করে। জীবনযাপনের পরিবর্তন এবং মানসিক চাপ কমাতে পারলে উচ্চ রক্তচাপকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আজ ১৬ জুলাই এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৯৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্যবিষয়ক টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কনসালটেন্ট কার্ডিওলজিস্ট ডা. মো. ফারহাদ হোসেন।

প্রশ্ন : দেহে তো রক্তচাপ সব সময় থাকে, তাহলে কখন একে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়?

উত্তর : আমরা সবাই সচেতন। কোনো কোনো সময় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি রকমের সচেতনতা তৈরি হয়ে যায়।

রক্ত চলাচল মানুষের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কাজ। এর একটা স্বাভাবিক মাত্রা রয়েছে। যখনই একটি মাত্রার বাইরে রক্তচাপ উঠে যায়, তখনই আমরা একে বলি উচ্চ রক্তচাপ। সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের বেলায় সিস্টোলিক বা ওপরের রক্তচাপটি ১৪০ এর ওপরে উঠে আর ডায়াস্টোলিক যদি ৯০-এর ওপরে ওঠে তাকে আমরা বলি উচ্চ রক্তচাপ। দুটোর মধ্যে যেকোনো একটা বাড়লেও উচ্চ রক্তচাপ।

প্রশ্ন : সাধারণত মানুষের শরীরে রক্তচাপ থাকে। তবে উচ্চ রক্তচাপ একটা রোগ হিসেবে দেখা দিচ্ছে এটা হয় কেন?urgentPhoto

উত্তর : মজার বিষয় হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ সবার বেলাতেই পাওয়া যায়। যাদের বেলায় এটা পাওয়া যায় না, তাদের বেলায় একে বলে প্রাই্মারি বা এসেনশিয়াল হাইপার টেনশন এবং এমন মানুষের সংখ্যাই হচ্ছে শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ। তবে কিছু ঝুঁকির কারণকে নির্ধারণ করা হয়েছে।

যেমন, কারো যদি ওজন বেশি থাকে, কেউ যদি অলস জীবনযাপন করে। ধূমপান করে, অ্যালকোহোল অতিরিক্ত মাত্রায় খায় কিংবা খাদ্যাভ্যাসে যদি তার সুষম খাদ্যাভ্যাস না থাকে, চাপ যদি থাকে ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে তার উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।

পাশাপাশি কিছু রোগ রয়েছে যার জন্য উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপকে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপার টেনশন।

যেমন প্রেগনেন্সি। পেটে বাচ্চা আছে সেখান থেকে কোনো কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়ে গেল। কিংবা হরমোনাল কোনো সমস্যা। যেমন, থাইরয়েড কার্যক্রম যদি অস্বাভাবিক থাকে সেখান থেকে এই সমস্যা হতে পারে। কিডনিজনিত রোগের কারণে হতে পারে। হার্টের কিছু জটিল রোগ রয়েছে যেমন, কোয়ার্কটেশন অব অ্যায়োটা এসব থেকে হতে পারে।

প্রশ্ন : অনেক রোগীর মধ্যে ধারণা জন্মায় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ একবার শুরু করলে আর ছাড়া যাবে না। বিষয়টি কী ঠিক?

উত্তর : উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় কয়েকটি বিষয় রয়েছে। শুধু ওষুধ দিয়েই যে তার চিকিৎসা করা হয় বিষয়টি তা নয়। আরো বেশ কিছু ভাগ আছে। সেগুলো নিয়মিত মেনে চললে অনেক ক্ষেত্রে না হলেও কিছু ক্ষেত্রে ওষুধটা ছাড়া যায়। তবে এটা সত্যি যে বেশির ভাগ মানুষের বেলায় যখন উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেওয়া হয় দেখা যায় উনি ওষুধটা ছাড়তে পারছেন না বা ছাড়া যাচ্ছে না। সেটা খেয়েই তার রক্তচাপটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

প্রশ্ন : অনেক সময় দেখা যায় ওষুধ খাওয়ার পরও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এই ক্ষেত্রে করণীয় কী?

উত্তর : খুবই জরুরি প্রশ্ন। ব্যাপারটা হলো একটা ওষুধেই যে সারা জীবন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে বিষয়টি তা নয়। মাঝেমধ্যেই রক্তচাপ পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যদি সেই ওষুধে নিয়ন্ত্রণ না হয় তবে ডোজ বাড়ানো যেতে পারে। কিংবা আরো ওষুধ যোগ করা যেতে পারে। অথবা সেটাকে বদলে অন্য ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। আর এত ওষুধ বদলানোর পরও যদি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে না আসে তবে শরীরে অন্য কোনো অসুখ আছে কি না দেখা যেতে পারে। যেমন কিডনির কোনো দুর্বলতা রয়েছে কি না, যার কারণে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

আবার অনেক সময় হয় যে আপনি হয়তো কেবল ওষুধ খাচ্ছেন। ওজন নিয়ন্ত্রণ করছেন না, নিয়মিত ব্যায়াম করছেন না, খাবার দাবারে যে নিয়ম সেগুলো মানছেন না- শুধু ওষুধের ওপর ভর করে উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছেন সে ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণে থাকে না।

প্রশ্ন : অনেকেই বাসায় নিজে রক্তচাপ মাপেন বা বাসার কাউকে দিয়ে মাপান। কেউ কেউ ডিজিটাল পদ্ধতিতেও মাপে। আবার আপনার চিকিৎসকরাও মাপছেন। কোনটিকে আপনি পছন্দ করবেন? এবং এই যে রক্তচাপ যারা নিজেরা বাসায় দেখছেন তাদের কতদিন পরপর বা কীভাবে দেখা উচিত? অনেক সময় তারা উচ্চ রক্তচাপ দেখে আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?

উত্তর : প্রথম কথা হচ্ছে বাসায় যদি একটা ব্লাডপ্রেসার মাপার মেশিন কিনে নিয়ে আসেন তাহলে উচ্চ রক্তচাপ মাপতে পারবেন। এই ধারণাটি আজ কাল বলা হচ্ছে, হোম ব্লাডপ্রেসার মনিটরিং। এবং এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আপনি চাইলে রক্তচাপ বাসায় মাপতে পারেন। চিকিৎসকরা তো মাপছেনই।

তবে আপনি নিয়মিত মাপবেন না। কেউ কেউ আছেন যে প্রতিদিনই মাপেন। আপনি এক সপ্তাহে একবার বা দুই সপ্তাহে একবার বা মাসে একবার মাপেন। এর বেশি মাপার দরকার পড়ে না। এটা হচ্ছে এক।

দুই নম্বর হচ্ছে কোনো ধরনের মাপার যন্ত্র কিনবেন। সবচেয়ে ভালো হতে যদি মার্কারি রক্তচাপ মাপার যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। তবে এগুলো চিকিৎসকের বাইরে সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করতে মানা করা হয়। সেই ক্ষেত্রে এনারয়েড ব্লাডপ্রেসার মেশিন, দামে সস্তা সেটি ব্যবহার করতে পারেন।

এ ছাড়া আপনি চাইলে ডিজিটাল ব্লাডপ্রেসার মেশিন ব্যবহার করতে পারেন এবং সেটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তবে রেডিয়াল ব্লাডপ্রেসার মেশিন যেটা পালস বা আর্টারির মাধ্যমে মাপি কিংবা ফিঙ্গার টিপসে ব্লাডপ্রেসার মাপার যে পদ্ধতি বা মেশিনগুলো, সেগুলো দিয়ে মাপতে উৎসাহিত করা হয় না। এগুলো দিয়ে ভালোভাবে রক্তচাপ মাপা যায় না।

 তবে যে মেশিন দিয়ে মাপবেন না কেন, সঠিকভাবে মাপুন। চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করে নিন বা ইন্টারনেটে অনেক উপায় আছে এর সঠিক পদ্ধতি দেখে নেওয়ার।

প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে কি অনেক সমস্যা হয়?

উত্তর : অনেক সমস্যা হয়। যিনি এই সমস্যাটা চিকিৎসা করছেন না তিনি নীরবে-নিভৃতে তুষের আগুনকে বয়ে বেড়াচ্ছেন। হয়তো প্রথম দিকে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে একটা সময় কিছু জটিলতা দেখা দেবে। ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে। প্যারালাইসিস হতে পারে। রেটিনোপ্যাথি হয়ে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। হয়তো হার্ট অ্যাটাক হলো, যার কারণ ছিল উচ্চ রক্তচাপ। কিংবা হার্ট ফেইলিউর, কার্ডিওমায়োপ্যাথি, হার্টের সব জটিল অসুখ হতে পারে। পরিফেরাল ভাসকুলার রোগ হতে পারে কিংবা কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এসব জটিলতা হতে পারে যদি উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ না করেন।

প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ওষুধের পাশাপাশি জীবনযাপনে কী কী ধরনের পরিবর্তন কতটা জরুরি এবং কী কী করবে?

উত্তর : জীবনযাত্রার পরিবর্তন খুব জরুরি। মনে রাখতে হবে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা শুধু ওষুধের কাজ নয়। ওষুধের পাশাপাশি জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। কী সেই পরিবর্তন? যেমন ধরুন কারো ওজন বেশি, একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। খাবারের অভ্যাস বদলে ফেলতে হবে। ওজন বেশি হলে উচ্চ ক্যালরির ডায়েট কমিয়ে নিম্ন ক্যালরিতে চলে আসতে হবে। খাবারে কিছু গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। শাকসবজি ফলমূল তুলনামূলকভাবে বেশি খাবেন। তেল, চর্বিজাতীয় খাবার কম খাবেন। পাশাপাশি অতিরিক্ত লবণ খাবেন না। সেটা কাঁচা হোক বা ভাজা হোক, কোনো লবণই অতিরিক্ত খাবেন না। তরকারিতে যেটুকু লবণ দেওয়া হোক সেটুকুই খাবেন। ধূমপান করলে বন্ধ করতে হবে। অ্যালকোহল খেলে বন্ধ করতে হবে। শারীরিক ব্যায়ামের পাশাপাশি মানসিক ব্যায়াম করতে হবে। যেন মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

মেডিটেশন, নামাজে যে দোয়া করি বা পূজায় যে প্রার্থনা করি সেখানেই মেডিটেশন আছে। তার পাশাপাশি যোগ ব্যায়াম রয়েছে। নানা রকম মেডিটেশন, সিলভা মেথড আছে – যেকোনো নিয়মই পালন করুন না কেন মনকে শান্ত করতে হবে। মন শান্ত করলে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সহজ হবে।