বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস
কর্মক্ষেত্রে পাঁচজনের একজন অসুস্থ
১৯৪৮ সালে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা তৈরি, মানসিক রোগ প্রতিরোধ, এই রোগগুলোর যথাযথ চিকিৎসা, যত্ন নিশ্চিত করা এবং মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে প্রতিবছর একটি স্লোগান বা থিম ঠিক করা হয়। এর ভিত্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ পালিত হয়। এ বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান হলো ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’। বিভিন্ন কারণেই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু পরিসংখ্যান
—কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনের একজন মানুষ মানসিক সমস্যায় পড়েন।
—এতে প্রচুর কর্মঘণ্টার অপচয় হয়। অনেক মানুষ কাজ করতে পারেন না। এতে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সারা বছরে পৃথিবীতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়। এটি ২০৩০ সাল নাগাদ ছয় ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে যাবে।
—বিষণ্ণতার কারণে কর্মজীবী জনগোষ্ঠীর ১০ ভাগ কর্মে অনুপস্থিত থাকেন।
—প্রতিবার বিষণ্ণতা রোগের কারণে গড়ে ছত্রিশ কর্মদিবস নষ্ট হয়।
—৫০ ভাগ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীই কোনো চিকিৎসা পান না।
—বিষণ্ণতার লক্ষণগুলো শতকরা ৯৪ ভাগ ক্ষেত্রেই এ রোগীদের মধ্যে দেখা যায়, যেমন—মনোযোগের সমস্যা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মনে রাখার সমস্যা। এগুলো কর্মক্ষেত্রে ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
—কর্মক্ষেত্রে মানসিক রোগ হলে মানুষ এ বিষয়ে অন্যদের বলতে অস্বস্তিবোধ করে। বাংলাদেশে পরিচালিত এক গবেষণায় ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন, মানসিক রোগীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে বা তাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করলে অন্যরাও মানসিক রোগী হয়ে যান। এতে মানসিক রোগীদের মানুষ এড়িয়ে চলে। অনেকে ভয় পান, বিপজ্জনক মনে করেন। মানসিক রোগ নির্ণিত হলে তার চাকরি চলে যায়। সে যদি রোগী হয়, তবে সে আর চাকরি পায় না। এমনকি মানসিক রোগের কারণে রোগীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকার বা সম্পত্তি তত্ত্বাবধায়ন ও ভোগ করার অধিকারও প্রায়ই বিঘ্নিত হয়। এতে কেউ স্বীকার করতে চায় না। এতে চিকিৎসা ব্যাহত হয় এবং ভোগান্তি বাড়ে।
—মানসিক রোগ কর্মক্ষেত্রে দেখা যায়। ২০১১ সালে চিলির এক গবেষণায় ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ কর্মজীবী ও ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ মালিকপক্ষ তাদের কর্মস্থলে মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতায় ভুগছে বলে পাওয়া গেছে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে মানসিক সমস্যা পাওয়া যায়। মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা ইত্যাদি কারণে উৎপাদনশীলতা কমে ও কর্মস্থলে অনুপস্থিতি বাড়ে। অনেকে বেকার থাকে। এতে দেশের আর্থিক ক্ষতি হয়।
সমাধানের প্রস্তাবনা
এর সমাধানের জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো প্রস্তাব করা হয়েছে :
—কর্মস্থলে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগদান করতে হবে।
—কারো মানসিক রোগ থাকলে শুধু এ কারণে তাকে নিয়োগ দেওয়া থেকে বিরত থাকা যাবে না। যদি মানসিক রোগীদের নিয়োগদানের জন্য কোটা পদ্ধতি থাকে, তবে সেটি প্রশংসনীয়।
—কোনো কর্মীর শারীরিক ও মানসিক কোনো অসুস্থতা থাকলে তার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ও পূর্বঘোষিত নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। নীতিমালা এমন হতে হবে, যাতে সেই কর্মী তার চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুবিধা পায়। এই সুবিধার মধ্যে রয়েছে চিকিৎসার জন্য ছুটি এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা। শুধু রোগের কারণে ও পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে যেন কর্মীর চাকরি চলে না যায়, তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। কর্মীর রোগ ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তা বিধান করতে হবে। মানসিক রোগ নিয়ে কর্মস্থলে সহকর্মীকে কটাক্ষ করার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছ নীতিমালা থাকতে হবে।
—কর্মস্থলে পরিবেশ এমন হতে হবে যেন তা মানসিক স্বাস্থ্য সহায়ক হয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপ থাকলে তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশের কথা
এ তো গেল উন্নত পৃথিবীর কথা। বাংলাদেশ অর্থনীতির দিক থেকে দ্রুত এগোচ্ছে। কিন্তু ‘কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্য’ স্লোগানটি আমাদের জন্য একটু বেশি অগ্রসরই মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে পূর্ণবয়সীদের মধ্যে পরিচালিত জাতীয় পর্যায়ের জরিপে ২০০৫ সালে শতকরা ১৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০১৬ পরিচালিত একটি কমিউনিটি জরিপে ৩২ ভাগের মানসিক রোগ পাওয়া গেছে। শিশুদের মধ্যে শতকরা ১৮ দশমিক ৩৫ ভাগ মানসিকভাবে অসুস্থ। দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির ওপরে। কাজেই মানসিকভাবে অসুস্থ জনসংখ্যা প্রচুর। কারা এই বিপুলসংখ্যক মানুষের চিকিৎসা দেবে?
বাংলাদেশে এখন মানসিক রোগের চিকিৎসক রয়েছেন ২৫০ জন। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট রয়েছেন ৫৭ জন। এ ছাড়া ২০০ জনের মতো অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট রয়েছেন। রয়েছেন বেশ কিছু সংখ্যক কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্কার, সাইকোথেরাপিস্ট ও বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কাউন্সেলররা। এই অল্প সংখ্যক পেশাজীবী কীভাবে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে চিকিৎসা দেবেন? এ তো গেল মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের কথা। কর্মস্থলে বাংলাদেশেও প্রচুর মানসিক চাপ ও মানসিক সমস্যা রয়েছে। সেখানে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা খুবই সাধারণ বিষয় বলেই মনে হয়। মুশকিল হলো, গবেষণা তেমন নেই। তবে ধোঁয়া দেখলে যেমন আগুন টের পাওয়া যায়, বিষয়টি তেমনভাবেই বুঝে নিত হবে। দেশে গার্মেন্টকর্মীদের মধ্যে অশান্ত পরিস্থিতি ও সহিংসতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মনোযোগ টেনেছিল। শ্রমক্ষেত্রে অসন্তোষ খুবই সাধারণ বিষয় ছিল। একসময় পাটশিল্পে বিষয়টি নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশে শ্রম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনাগুলো বেশ চোখে পড়ে। নির্মাণ শ্রমিক, জাহাজ কাটা শিল্পের শ্রমিক, গার্মেন্ট শ্রমিকদের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা প্রায়ই শোনা যায়। এত ঝামেলা যেখানে রয়েছে, ধরে নেওয়া যায়, মানসিক অসুবিধাও সেখানে রয়েছে।
কী করা?
কর্মস্থলে পরিবেশটি মানসিক স্বাস্থ্যবান্ধব হলে, কর্মস্থলে মানসিক চাপ কমানোর পদ্ধতি চালু করা গেলে, কর্মস্থলে মনোবৈজ্ঞানিক সেবা পাওয়া গেলে দেশের শিল্পকারখানা ও করপোরেট অফিসসহ সর্বত্রই উৎপাদনশীলতা তাৎপর্যপূর্ণভাব বাড়ানো যেত। এ জন্য অচিরেই উদ্যোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে অর্গানাইজনাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইকোলজিস্টদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীরাও যার যার মতো করে ভূমিকা পালন করতে পারেন। দেশের অর্থনীতি ক্রমবর্ধমানভাবে উন্নত হচ্ছে। এ সাফল্য আরো এগিয়ে নেওয়া যাবে যদি কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকে।
লেখক : অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অব ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।