ছাড়তে হলে, অভিনয় ছেড়ে দেব : ডা. এজাজুল
তিনি একাধারে অভিনেতা ও চিকিৎসক। ছোট পর্দা ও বড় পর্দা দুটোতেই সমান জনপ্রিয়তা তাঁর। ‘তারকাঁটা’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-অভিনেতা হিসেবে ৩৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারি, চন্দ্রকথা, আমার আছে জল ইত্যাদি চমৎকার কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।
অভিনয়ের পাশাপাশি চিকিৎসা পেশাতেও সফল তিনি।এমবিবিএস করেছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে। ডিএনএম করেছেন আইপিজিএমআর (বর্তমানে যেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)থেকে। বর্তমানে চিকিৎসা পেশায় আরেকটি সফলতা অর্জন করেছেন তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। যার কথা বলছি তাঁকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তিনি ডা. এজাজুল ইসলাম।
এনটিভি অনলাইনের একান্ত এক সাক্ষাৎকারে কথা হয় তাঁর কর্ম ও অভিনয় জীবন নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শাশ্বতী মাথিন।
এনটিভি অনলাইন : নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগ ঢাকা মেডিকেল কলেজে এই প্রথম চালু করা হলো। প্রয়োজনীয়তা অনেক দিন ধরেই ছিল। কবে থেকে আপনি দায়িত্ব গ্রহণ করলেন? বিভাগটি শুরুর প্রেক্ষাপট একটু বলুন।
ডা. এজাজুল ইসলাম : আমি এখানে যোগ দিয়েছি প্রায় এক বছর ধরে। আর বিভাগীয় প্রধান হয়েছি প্রায় এক মাস। যেহেতু স্বাস্থ্য বিভাগে এর কোনো পদ ছিল না, তাই এই বিভাগে পাস করলে পরামাণু কমিশনে যোগ দিতে হয়। তবে এখন পদ সৃষ্টি হলো।
আমরা যদি হার্টের রোগীদের কথা বলি, প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজে হৃদরোগ বিভাগ রয়েছে। তেমনি অন্যান্য বিভাগ রয়েছে। যেকোনো একটি বিভাগ প্রসারিত হলে রোগীদের জন্য সুবিধা হয়।
নিউক্লিয়ার মেডিসিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে শুরু হলো। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে এই বিভাগে যতক্ষণ আছি ততক্ষণ প্রসার ও সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর। এই চেষ্টাটুকুই করে যাব। কেবল শুরু, অনেক দায়িত্ব, অনেক কাজ।
এখনো কিন্তু দেশে রোগীর চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসকের কমতি রয়েছে। আপনি যদি ভালো সার্ভিস দিতে যান দেখবেন কুলোতে পারছেন না। আমরা তো শ্রেষ্ঠ সার্ভিসটুকুই দেওয়ার চেষ্টা করছি। সেই ক্ষেত্রে সুন্দর সার্ভিস, শ্রেষ্ঠ সার্ভিস যত বেশি প্রসারিত হবে, তত ভালো। এটা কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজে শুরু হলো। আমি আশা করব ধীরে ধীরে প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজে শুরু হবে। এতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্ররাই লাভবান হবে।
এনটিভি অনলাইন : নিউক্লিয়ার মেডিসিন তো সাধারণত আনবিক কমিশনের অধীনে ছিল। ঢাকা মেডিকেল কেন একে নতুন করে শুরু করেছে?
ডা. এজাজ : নিউক্লিয়ার মেডিসিন আনবিক কমিশনের অধীনে ছিল। এখনো রয়েছে। ঢাকা মেডিকেলে নিউক্লিয়ার মেডিসিন শুরু হলো নতুন করে। ঢাকা মেডিকেলের বিভাগটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আন্ডারে করা হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে, যত বেশি প্রসারিত হবে, তত বেশি রোগীদের সুবিধা হবে।
এনটিভি অনলাইন : নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিষয়টি কী? এটি দিয়ে কোন কোন রোগ সারানো যায়?
ডা. এজাজ : তেজস্ক্রিয় পরামাণু দিয়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা হলো নিউক্লিয়ার মেডিসিন। এটি দিয়ে মস্তিষ্ক, থাইরয়েড গ্রন্থি, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, লিভার, কিডনি, হাড়ের বিভিন্ন রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্ভব।
এনটিভি অনলাইন : মানুষের সুচিকিৎসার জন্য এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
ডা. এজাজ : অনেক। একটি থাইরয়েড ক্যানসার হলো প্যাপিলারি কারসিনোমা। এর টিউমার অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপরও যদি ক্যানসারের কোষগুলো রয়ে যায় সেগুলোকে ধ্বংস করার জন্য নিউক্লিয়ার মেডিসিন ব্যবহার করা হয়।
এনটিভি অনলাইন : ঢাকা মেডিকেলের নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগটিকে কীভাবে সাজাচ্ছেন?
ডা. এজাজ : বিভাগটি কলেজের। আমাদের কাজ হচ্ছে কলেজে পড়ানো। আমাদের চিন্তা পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু সার্ভিস দেওয়া। মানুষকে কিছুটা সার্ভিস দেওয়ার জন্য হাসপাতালে কিছু চিকিৎসা চালু করা।
এনটিভি অনলাইন : কতজন শিক্ষক বর্তমানে এই বিভাগে কাজ করছেন?
ডা. এজাজ : তিনজন শিক্ষক বর্তমানে এই বিভাগে কাজ করছেন। একজন সহকারী অধ্যাপক, একজন সহযোগী অধ্যাপক, আরেকজন অধ্যাপক।
এনটিভি অনলাইন : এই বিভাগের কাজ কীভাবে করা হবে সেই বিষয়ে কী পরিকল্পনা গ্রহণ শুরু করেছেন?
ডা. এজাজ : যেহেতু আমাদের এখন তিনজন শিক্ষক রয়েছেন, ক্লাস ও পড়ানোর পাশাপাশি হাসপাতালে কিছু দায়িত্ব পালনের পরিকল্পনা করছি আমরা। হাসপাতালে রোগীদের কিছুটা সময় দিতে চাই।
ঢাকা মেডিকেলে এখন এমন এমন বিভাগ রয়েছে যেটা কেউ জানেই না। সব বিভাগই মোটামুটি ভালো কাজ করছে।
এনটিভি অনলাইন : অভিনয়ের পাশাপাশি এত বড় দায়িত্ব কীভাবে সামলাবেন ভাবছেন?
ডা. এজাজ : অভিনয় একটু কমে আসছে। তবে আন্তরিকতা থাকলে সব হয়। সবাই আমাকে এখন সহায়তা করে। তাই অভিনয় ও মেডিকেলের কাজ দুটোই করতে পারি। সহায়তা করার মানুষ এখন অনেক হয়ে গেছে। আমি সবাইকে বলে নিই, ‘ভাই আমার সময় কিন্তু কম। আমাকে নিলে আপনার এই ঝামেলা পোহাতে হবে। আমার ফ্রি সময়ের মধ্যে আপনার কাজটুকু শেষ করে ফেলতে হবে। আমার সময়কে আগে প্রায়োরিটি দিতে হবে।’ তারা আমার প্রতি এই মমতাটুকু দেখায়। আবার দেখা যায়, শুটিং চট্টগ্রাম, বরিশালে করতে হবে। তখন আগেই ‘না’ বলি। সবসময় বলি, উত্তরা, পুবাইল, এমন জায়গায় শুটিং করতে।
এনটিভি অনলাইন : আপনার অভিনয়ে আসা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরেই। সেই সময়ের কিছু ঘটনা বলুন...
ডা. এজাজ : অনেকে ডাক্তারদের কসাই বলে। এমনকি সিনেমাতেও অনেক সময় এভাবে উপস্থাপন করা হয়। হুমায়ূন স্যার ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি সবসময় চিকিৎসকদের ইতিবাচক দিক তুলে ধরতেন। বিষয়টি দুঃখজনক যে খুব সহজেই ডাক্তারদের অনেকে চামাড় বলে ফেলে, কসাই বলে ফেলে। তবে বাংলাদেশে যে টাকায় চিকিৎসা হয়, পৃথিবীর কোনো দেশে সেটি হয় না। আর আমরা খুব নাজুক অবস্থায় চিকিৎসকদের কাছে যাই। তখন হয়তো আর কিছু করার থাকে না। সবাই তো বাঁচতে চায়। ডাক্তাররা তো সবাইকে বাঁচাতে পারে না। সে কারণে ডাক্তারদের কথা বেশি বলা হয়।
হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আমি কাজ করতে পেরেছি এই জন্য যে আমার হাসপাতাল, আমার কাজকে হিসাবে রেখে এরপর আমার শুটিং ফেলতেন। সামান্য যেটুকু অভিনেতা হয়েছি, সেটি করতে পারতাম না যদি স্যারের এখানে কাজ না করতাম।
এনটিভি অনলাইন : ‘তারকাঁটা’ চলচ্চিত্রের জন্য তো আপনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন। ছবিটির কোন বিষয়টি আপনাকে অনেক বেশি স্পর্শ করেছিল?
ডা. এজাজ : আমার চরিত্রটি আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার চরিত্রটি করে শান্তি পেয়েছি। যেটুকু জায়গা আমি করেছি, সংলাপগুলো ও স্টাইল সেগুলো আমার ভালো লেগেছে।
করার পর আমার মনে হয়েছিল অ্যাওয়ার্ড বোধ হয় একটি পেতে পারি। তবে আমার একটি বিরাট দুঃখ রয়েছে। যেই অ্যাওয়ার্ডটি আমি এখন পেয়েছি, আমার মতে পাওয়া উচিত ছিল ‘শ্রাবণ মেঘের দিনে’ চলচ্চিত্রে। শ্রাবণ মেঘের দিনে আমি স্বপ্ন দেখতাম অ্যাওয়ার্ডটা পাব। আমার এই আফসোসটা কাজ করে। কিংবা ‘শ্যামল ছায়া’য় আমি যে অভিনয় করেছি এর জন্য হয়তো পেতে পারতাম। ‘তারকাঁটা’য় অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর আমার আফসোস হয়েছে কেন আমি ‘শ্রাবণ মেঘের দিনে’ পাইনি। কেন আমি ‘শ্যামল ছায়া’য় পাইনি? এই দুঃখটা আমরা সারাজীবন থাকবে।
এনটিভি অনলাইন: আপনার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কিছু বলুন…
ডা. এজাজ : আমার চার সন্তান। আমার দুই মেয়ে দুই ছেলে। সবাই ডাক্তারি পড়েছে। কেবল ছোট ছেলে ছাড়া। ছোট ছেলের আগ্রহ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। আমার স্ত্রীর নাম লুৎফর নাহার। আমি তার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। সে না থাকলে কাজ করতে পারতাম না।
এনটিভি অনলাইন : আপনি রোগীদের কাছ থেকে ভিজিট অনেক কম রাখেন, সেজন্য আপনাকে গরীবের ডাক্তার বলা হয়…
ডা. এজাজ: গরিবদের জন্য করার ইচ্ছেটা একেবারে ভেতর থেকে আসে। সরকারি চাকরি শুরু করি ৯০/ ৯২ সালে। তখন ২০ টাকা নিতাম। দূর থেকে রোগীরা আসত, টাঙ্গাইল, ভালুকা থেকে রোগী আসত। এমবিবিএস একজন ডাক্তারের ফিস ৩০০ টাকা। আমি সেটিই এখনো নেই।
আসলে এ রকম ডাক্তার বাংলাদেশে অনেক রয়েছেন যারা মানুষের জন্য কাজ করেন। অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ স্যার, ডা. গোলাম মহিউদ্দিন স্যার- এঁরা অনেক কাজ করেন। তাই কম ভিজিট নেওয়া ডাক্তার আমি কেবল একা নই।
এনটিভি অনলাইন : আপনার শিক্ষা জীবন নিয়ে একটু বলুন…
ডা. এজাজ : আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তার নাম শাহ ইয়াসিন। চার ভাই দুই বোন আমরা। আমার জন্ম ময়মনসিংহে। প্রাথমিকে বিভিন্ন জায়গায় পড়েছি। মাধ্যমিক পড়েছি কুড়িগ্রাম সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। উচ্চ মাধ্যমিক রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে। এমবিবিএস করেছি রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে। ডিএনএম আইপিজিএমআর থেকে (বর্তমানে যেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)।
এনটিভি অনলাইন : ছোটবেলা কীভাবে কেটেছে?
ডা. এজাজ : ছোটবেলা থেকে নাটক করতাম। আমার বাবা খুব কড়া ছিলেন। সন্ধ্যা হলে আমাদের পড়তে বসতে হতো। আমার বাবা মাগরিবের নামাজ পরতেন। নামাজের সময় সালাম ফেরানোর সময় তিনি দেখতে চাইতেন সব ছেলেমেয়া পড়তে বসেছে। একবার আমি বাসায় যাইনি। নাটক করছিলাম স্টেজে। আব্বা দর্শকদের সামনে আমাকে দুই থাপ্পর দিয়ে পড়তে নিয়ে গিয়েছিলেন।
আরেকটি ঘটনা। ক্লাস নাইনে পড়ি তখন। আব্বা একটি নতুন শেরোয়ানি কিনেছেন। আমি বাড়ির কাউকে না বলে সেটি পরে নাটক করতে গিয়েছিলাম। আপা দেখে চিনে ফেলেছিলেন। বড় আপাও অনেক কড়া ছিলেন। তখন আর থাপ্পর দেননি। তবে বাসায় এসে অনেক বকেছিলেন।
এনটিভি অনলাইন : বর্তমানে কোন কোন নাটকে অভিনয় করছেন?
ডা. এজাজ : মাসুম সেজানের একটি সিরিয়াল, সনজিৎ সরকারের দুটো সিরিয়াল, রহমতুল্লাহ তুহিনের দুটি সিরিয়ালসহ মোট ১১টি সিরিয়ালে অভিনয় করছি। দুটো ছবিতে অভিনয়ের কাজ চলছে।
এনটিভি অনলাইন : চিকিৎসা ও অভিনেতা – কোন জায়গাটি বেশি পছন্দের?
ডা. এজাজ : দুটোই। তবে যদি কোনোটিকে ছাড়তে বলা হয় তাহলে বোধ হয় অভিনয় ছেড়ে দেব। একবার ১৫দিন অসুস্থ হয়ে ছিলাম।রোগীরা অনেক দোয়া করেছিল। তাদের ভালোবাসাটা অন্যরকম।
‘শ্যামল ছায়া’র শুটিং যখন করতাম, প্রতিদিন রোগীরা খাবার নিয়ে আসত। একবার হুমায়ুন স্যার বললেন ‘ও এত খাবার পায় কোথা থেকে।’ তখন অন্যরা বলেছিলেন, ‘তার রোগীরা খাবার দিয়ে যায়।’
এনটিভি অনলাইন : ভবিষৎ পরিকল্পনা কী?
ডা. এজাজ : আগামী দুই বছরে ঢাকা মেডিকেলের নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগটিকে আরো উন্নত করতে চাই। আরো প্রসারিত করতে চাই।