গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের প্রতিকার
গর্ভাবস্থায় অনেকেরই ডায়াবেটিস হতে দেখা যায়। আবার অনেকে গর্ভধারণের আগেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। যেটাই হোক না কেন গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এটা মা ও শিশু উভয়ের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আজ ৭ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১১৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের প্রসূতি ও ধাত্রী বিভাগের গাইনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নাইমা শারমিন হক।
urgentPhoto
প্রশ্ন : গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে দুভাবে ডায়াবেটিস হতে পারে। একটি হচ্ছে, মা সন্তান ধারণ করার সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেন। আরেকটি হলো, আগে থেকে যদি ডায়াবেটিস থাকে। যাঁরা আগে থেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাঁরা যদি সন্তান নিতে চান সে ক্ষেত্রে সচেতনতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে কি?
উত্তর : হ্যাঁ, প্রয়োজন আছে। কারণ যে মা জানেন ওনার আগে থেকে ডায়াবেটিক রয়েছে, উনি অবশ্যই কিছু ওষুধ গ্রহণ করেন। যাঁরা আগে থেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাঁদের আমরা বলি প্রি জেসটেশনাল ডায়াবেটিক মাদার। তাঁদের জন্য পরামর্শ থাকে, গর্ভধারণের আগে একজন ডায়াবেটোলজিস্ট, একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট এবং একজন অবসটিশিয়ানের তত্ত্বাবধানে থাকা। যে মায়েদের ডায়াবেটিস থাকে, তাঁদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে সে ক্ষেত্রে বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। আর একজন মা যিনি গর্ভধারণের পরবর্তী সময়ে জানতে পারলেন যে তাঁর রক্তে শর্করার পরিমাণটা বেড়ে যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে তাঁর জন্য সতর্কতামূলক কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার থাকে। যেমন, গর্ভধারণ হলেই ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকে। এখানে সবারই রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়তে পারে।
প্রশ্ন : আপনি যদি একটু বলেন, একজন মা যাঁর ডায়াবেটিস আছে তাঁর কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে। এবং এর কারণে তাঁর গভর্জাত সন্তানের কী ক্ষতি হতে পারে?
উত্তর : ডায়াবেটিসের কারণে মায়ের থেকে সন্তানের ক্ষতিটা বেশি হয়। ধরেন, যেই মা আগে থেকে ডায়াবেটিক, তাঁর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকে এ সময় যদি তার গর্ভধারণ হয় ওই সময় বাচ্চার দেখা যায় যে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বা কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেম অথবা রেনাল পদ্ধতির অনেকে অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়। যে কারণে তাঁর বারবার গর্ভপাত হওয়ার ইতিহাস থাকতে পারে। দেখা যায় বাচ্চা পেটে ধারণ করতে পারছে কিন্তু শেষের দিকে গিয়ে অজানা কারণে তাঁর সন্তানটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পেটের ভেতরই মারা যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল ওনার ডায়াবেটিস আছে, যেটা হয়তো উনি জানতেন না। তার মানে এই ডায়াবেটিসের কারণে তাঁর আগের শিশুটি গর্ভে মারা গেলেন। সেটা প্রথমবার না জানার কারণে তাঁর বাচ্চাটা নষ্ট হলো।
কিন্তু যখন আমি এই রোগীকে দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের জন্য পরামর্শ দেব, তখন তাঁকে অবশ্যই রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে গর্ভধারণ করতে হবে। যদি রক্তের শর্করার কমার পর গর্ভধারণ করেন, তখন বাচ্চার বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা সব দিক থেকে কমে যায়। পরবর্তীকালে শর্করা বেশি থাকার কারণে মায়ের যে জটিলতাগুলো হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেটা আর হয় না।
প্রশ্ন : কী ধরনের জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখে?
উত্তর : নিয়ন্ত্রণে না রাখলে ওজন বেড়ে যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক ওজনের মায়ের শেষের দিকে ১০ থেকে ১১ কেজি ওজন বাড়ে। কিন্তু যে মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত দেখা যাবে তাঁর ওজন আরো বেড়ে যাবে। বাচ্চাও বেশি বড় হয়ে যাবে। যেহেতু একটি ভারী শিশুকে মা বহন করছে তাই পানি ভেঙে যেতে পারে। যদি কোনো কারণে পানি ভেঙে যায় তবে শিশুর ক্ষতি হওয়ার একটি আশঙ্কা থাকে। এ জন্য গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।
প্রশ্ন : আর যে মায়ের আগে থেকে ডায়াবেটিস ছিল না, গর্ভধারণের পর দেখা গেল তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কেন হয় এবং কাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা বেশি থাকে?
উত্তর : আমি একটা কথা বললাম, প্রেগনেন্সি ইটসেল্ফ এ ডায়াবেটোজোনিক কন্ডিশন (গর্ভধারণ ডায়াবেটিকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়)। গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা থেকে যে হরমোনগুলো আসে, প্রতিটা হরমোনই রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, এটা একটা কারণ।
দ্বিতীয় হচ্ছে পরিবারে বাবা-মা অথবা আত্মীয়স্বজন যারা তাদের যদি ডায়াবেটিস থাকে। বাবা-মায়ের যদি থাকে, সন্তানের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ফলে সে ঝুঁকিতে পড়ে যায়। আবার কিছুক্ষণ আগে যেটা বললাম, যদি কারো অনেকগুলো বাচ্চা আগে নষ্ট হয়ে যায়, অথবা কোনো কারণ ছাড়াই বাচ্চা পেটের ভেতরে মারা যায়- এই কারণগুলোকে আসলে আমরা ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করি। এবং তাঁদের আমরা শুরুতেই গ্লুকোজ লোড দিয়ে তাঁর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কত থাকে সেটা দেখি। এটাকে আমরা বলি গ্লুকোজ চ্যালেঞ্জ টেস্ট। ৫০ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ানোর এক ঘণ্টা পর ব্লাড সুগারটা দেখি। যদি এটা ৭.৮ মিলিমোল পার মিটারের বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা তাঁকে ধরি সে হয়তো ডায়াবেটিসের রোগী। কারণ তার রক্তে গ্লুকোজের সহ্যক্ষমতা (ইনটলারেন্সি) নেই। এটা নিশ্চিত করার জন্য আমরা ওজিটি টেস্ট করি। যেটাকে বলি, ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট এবং সে অনুসারে ব্যবস্থা নিই।
প্রশ্ন : এই সমস্যায় পড়া শিশুটার পরবর্তীকালে কি কোনো জটিলতা হতে পারে?
উত্তর : বাচ্চা যখন মায়ের গর্ভে থাকবে, তখনো জটিলতা হতে পারে। জন্মের পরে জটিলতা হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও জটিলতা হতে পারে।
প্রশ্ন : কী ধরনের জটিলতা?
উত্তর : যেমন জন্মের পরপরই বাচ্চার রক্তের শর্করা হঠাৎ কমে যেতে পারে। কারণ তার ওজন বেশি থাকে। এবং মায়ের পেটে থাকার সময় বাচ্চাটা মায়ের গ্লুকোজের সামঞ্জস্যতায় যেই ইনসুলিনটা তার শরীরে তৈরি হয় তার রক্তের শর্করাটা ওই ইনসুলিনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। পরর্ব্তীকালে যখন তার জন্ম হয়, তখন মায়ের রক্তের শর্করার প্রভাবটা তার রক্তে থাকে না। যে কারণে ইনসুলিনের ক্রিয়াটা তার সুগারে বেশি হয়ে যায় এবং ইনসুলিন অতিরিক্ত মাত্রায় কাজ করে তার রক্তের শর্করার মাত্রাটা কমিয়ে দেয়।
এ ছাড়া আরো কিছু সমস্যা হয়। যেমন বাচ্চার জন্মের পরে হাইপার বিলিরুবিনেমিয়া হয়, যেটাকে আমরা জন্ডিস বলি। আর ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্সও হতে পারে। এবং এই বাচ্চাটার বড় হওয়ার পরও ডায়াবেটিস হতে পারে, যেটাকে আমরা টাইপ টু ডায়াবেটিস বলি।
প্রশ্ন : একজন মা যাঁর গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়, তাঁর কি শিশু জন্মের পর ভালো হয়ে যেতে পারে, না কি রয়ে যেতে পারে?
উত্তর : ডায়াবেটিস সাধারণত যে মায়েদের থাকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় তাঁদের সেটা ভালো হয়ে স্বাভাবিক মাত্রার হয়ে আসে। তবে ৫ থেকে ১০ শতাংশের ক্ষেত্রে দেখা য়ায় এটা রয়ে যায়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এমন হয় বাচ্চা যখন পেটে থাকে তখন এটা থাকে আবার যখন সে এই সময়টা পার করে তখন আর রক্তে এই শর্করার মাত্রা বেশি থাকে না। তবে আবার যখন সে গর্ভধারণ করে, তখন সে এই সমস্যায় পড়তে পারে। প্রথমবার গর্ভধারণের সময় যদি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকে দ্বিতীয়বার ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে।
প্রশ্ন : গর্ভবস্থায় চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু বলুন।
উত্তর : আসলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ভালো ওষুধ হলো ইনসুলিন। যদি কেউ আগে থেকে ইনসুলিন নিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে ডোজ সমন্বয়ের বিষয় হতে পারে। তবে যদি কেউ ওরাল হাইপোগ্লাইসোমিক এজেন্ট, মানে ট্যাবলেট খেয়ে যদি কেউ শর্করা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাহলে গর্ভধারণের সঙ্গে সঙ্গে যদি তাঁর শর্করা বাড়তে থাকে সে ক্ষেত্রে তাঁর ইনসুলিনে পরিবর্তন করতে হবে। এবং অবশ্যই এটা একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্টের পরামর্শে হতে হবে।