গর্ভকালীন যত্নে কী করবেন

Looks like you've blocked notifications!

একটি সুন্দর শিশু এবং একজন সুস্থ মায়ের জন্য অ্যান্টিনেটাল চেকআপ এবং গর্ভকালীন যত্ন খুব জরুরি। আজ ৮ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১১৪ তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন স্কয়ার হাসপাতালের গাইনি, অবস অ্যান্ড ইনফারটিলিটি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট কনসালটেন্ট ডা. রেহনুমা জামান।

urgentPhoto
প্রশ্ন : অ্যান্টিনেটাল চেকআপ বা গর্ভকালীন যত্ন আসলে কী?
 
উত্তর : একটা মেয়ে যখন গর্ভাবস্থায় থাকবে সেই সময় থেকে শুরু করে  ৪০ সপ্তাহ পর্যন্ত- এই সময়টায় কী কী যত্ন হওয়া উচিত, কী ওষুধ খাওয়া উচিত- এই সবগুলো মিলে অ্যান্টিনেটাল চেকআপ।
 
প্রশ্ন : একটা মা কখন এই চেকআপের জন্য আপনাদের কাছে যাবেন? এবং কতদিন পরপর এই চেকআপ করা আদর্শ বলে মনে করেন?

উত্তর : সাধারণত এই সময়কে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করে থাকি। প্রথম তিন মাসকে ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার। এরপর দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার, তৃতীয় ট্রাইমেস্টার- তিন মাস করে ভাগ করে ফেলি। যখন প্রথম গর্ভধারণের পরীক্ষা ইতিবাচক হবে, এরপর অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। আসলে বিষয়টা এ রকম যে গর্ভধারণ করার আগে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ এই সময় আমরা সাধারণত ফলিক এসিড দিয়ে থাকি।  বলা হয়, তিন মাস আগে থেকে ফলিক এসিড শুরু করা ভালো। না হলে নার্ভাস টিস্যুর বৃদ্ধি অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

একজন গর্ভধারণের প্রথম দিকে চিকিৎসকের কাছে যাবে, চিকিৎসক ফলিক এসিডের পরামর্শ দেবে। কিছু ছোট সমস্যা থাকে, অনেক সময় দেখা যায় প্রথম তিন মাসে বমির পরিমাণটা বেশি থাকে, মাথা ঘোরানো থাকে। যেটাকে আমরা মর্নিং সিকনেস বা সকালের ক্লান্তি বলে থাকি। এগুলোর জন্য কিছু পরামর্শ লাগে। অনেক সময় পরামর্শে হয়ে যায়, আবার অনেক সময় ওষুধ লাগে। আমরা পরামর্শ দেই। পরামর্শের মধ্যে বলি, প্রথম তিন মাস এবং শেষের তিন মাস দূরের ভ্রমণ এবং সহবাস নিষেধ। ভারী কাজ করা যাবে না। ভারী জিনিস তুলবেন না। খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে বলি, তেমন কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। তবে প্রথম তিন মাসে যেটা আপনার ভালো লাগবে সেটাই খাবেন।
অনেকে দেখা যায়, প্রথম তিন মাস বমির জন্য খাওয়া-দাওয়া করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে আমরা বলি, এখনই মাছ, মাংস, দুধ ডিম খেতে হবে সে রকম কোনো দরকার নেই। তিন-চার মাসের পর থেকেই এগুলো খাবার বাড়ালেই চলবে। 

প্রশ্ন : তাহলে ওই সময় যে খেতে পারছে না। ওই সময়টায় আসলে কী করণীয়?

উত্তর : সে সময়টায় দেখা যায়, কিছু শুকনো খাবার খেলে ভালো লাগে। যেটাই তার ভালো লাগবে সেটাই খাবে। আর দুপুরে দুই ঘণ্টা এবং রাতে আট ঘণ্টা ঘুম আসুক বা না আসুক শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। সব সময় হালকা কাজ করতে বলি, পুরোপুরি বিশ্রামেই থাকতে হবে এমনটা আসলে বলি না। তবে  এটা বলা হয়- যদি কোনো জটিলতা না থাকে। 

আর বলি, ওজনটা বাড়তে হবে। পুরো নয় মাসে ওজন অন্তত নয় থেকে ১১ কেজি বাড়তে হবে। আর কিছু ওষুধ রয়েছে সেগুলো দেই। প্রথম তিন মাস ফলিক এসিড দেই, বমির ওষুধ দেই। আর ব্যথা হলে কী ওষুধ খাবে সেটাও বলে দেই। এরপর তিন মাস পর আয়রন এবং ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট যোগ করে দেই। আরো কিছু ভ্যাকসিনেশন আছে, স্ক্রিনিং আছে- এগুলোর পরামর্শ দেই। 

প্রশ্ন :  যাদের আর্থসামাজিক অবস্থা ভালো নেই, যারা দরিদ্র তাদের ক্ষেত্রে অন্তত কয়টা সাক্ষাৎ (ভিজিট) জরুরি?

উত্তর : সাক্ষাৎটা হতে হয় এ রকম- প্রথম ২৮ সপ্তাহের মধ্যে আমরা বলি চার সপ্তাহ পরপর আপনারা আমাদের কাছে আসবেন। যদি কোনো জটিলতা না থাকে। আর জটিলতা থাকলে হয়তো এর চেয়েও আগে আসতে হতে পারে। ২৮ সপ্তাহের পর থেকে প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর একবার আসবে। আর ৩৬ সপ্তাহ হয়ে গেলে প্রতি সপ্তাহে একবার করে চেকআপ করাতে বলি।
 
প্রশ্ন : সেই চেকআপটার মধ্যে আপনার কী দেখেন? আস্তে আস্তে যখন গর্ভবতী মা শিশুজন্মের শেষ দিকে চলে যায় তখন আপনা কী দেখেন? 

উত্তর : একটা রোগী যখন আমাদের কাছে আসে  তখন আমরা জিজ্ঞেস করি, কোনো সমস্যা আছে কি না? তার পর শুরুতেই আমরা ইতিহাস নেই। রক্তচাপ, ডায়াবেটিক বা অন্য কিছুর পারিবারি ইতিহাস আছে কি না।রোগীর নিজের কোনো মেডিকেল সমস্যা আছে কি না। ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা বা অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না- এগুলোর ইতিহাস নেই। 

এরপর যদি দেখা যায়, কারো পারিবারিক ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে বা তার আগের সন্তানের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস হয়েছিল তখন সাথে সাথে গ্লুকোজ টলারেন্স পরীক্ষা করে নেই। যদি সে রকম কোনো সমস্যা না থাকে, ২০ সপ্তাহের পর থেকে গ্লুকোজ টলারেন্স পরীক্ষা করি। আবার ৩২ সপ্তাহের পর আরেকবার করি। তারপর আলট্রাসাউন্ডের একটা বিষয় আছে। শুরুতে একটা আল্ট্রাসাউন্ড করি। এরপর ২০ সপ্তাহ পর একটা অ্যানোমেলি স্ক্যান আল্ট্রাসাউন্ড করি। আবার ৩২ সপ্তাহ পর বাচ্চার বৃদ্ধি মনিটর করি। এরপর শেষের দিকে দরকার হলে একটা বায়োফিজিক্যাল প্রোফাইল আলট্রাসাউন্ড করি। 

প্রশ্ন : যখন একজন মা গর্ভবতী হবেন তখন তাঁর আশপাশের মানুষকে কী পরামর্শ দেন আপনারা?

উত্তর : সেক্ষেত্রে আমরা বলি আপনারা মায়ের সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিশ্চিত করবেন। আর ওদের খাবারে যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন এগুলো থাকে। আয়রন সম্বৃদ্ধ খাবারের জন্য আমরা বলি, খুব বেশি শাক-সবজি, কচুর শাক, কচুর লতি, কলিজা -এগুলো খাবেন। ক্যালসিয়ামের জন্য দুধ, ডিম, দুধের তৈরি খাবার এগুলো প্রচুর পরিমাণে খাবেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকা। এটার সুবিধা তাঁকে দিতে হবে। 

প্রশ্ন : ওষুধের ক্ষেত্রে তো কিছু বিষয় রয়েছে। কিছু ওষুধ খেতে  বলা হয়, আর কিছু ওষুধের বিষয়ে নিষেধ করা হয়। তারপরও যদি কোনো সমস্যা হয়ে যায় তাহলে কী পরামর্শ থাকে আপনাদের?

উত্তর : অবশ্যই ওষুধ খেতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ মতে। কারণ সব অ্যান্টিবায়োটিক নিরাপদ নয়।  জ্বর হলে বা বিভিন্ন সমস্যা হলে নিরাপদ অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হবে। গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ বাড়তে পারে। এর সব ওষুধও নিরাপদ নয়। যেগুলো নিরাপদ সেগুলো খেতে হবে। তারপর ডায়াবেটিস হলে মুখে খাওয়ার ওষুধ তো খাওয়া যাবে না। তখন ইনসুলিন দিতে হবে। আসলে সবকিছুই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করতে হবে। 

প্রশ্ন : একটু জানতে চাইব উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ বলে একটি বিষয় আছে। এর  আওতায় আসলে কারা পড়ে?

উত্তর : কিছু কিছু গর্ভধারণে দেখা যায় হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গেল বা রক্তচাপ বাড়ার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। ডায়াবেটিস আছে। এরপর হয়তো কোনো রোগীর হার্টে সমস্যা আছে। আগে রক্তপাত হওয়ার একটা প্রবণতা থাকে, যাকে আমরা প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বলি- এ রকম কিছু অবস্থাকে আমরা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ বলি। 

প্রশ্ন : অনেক সময় আমরা দেখি প্রি একলামসিয়া বা একলামসিয়ার কিছু লক্ষণ দেখা যায়। কী লক্ষণ দেখা দিলে আসলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?

উত্তর :  প্রি-একলামসিয়া হয়তো ১০০ ভাগ প্রতিরোধ করা যায় না। কিন্তু প্রি-একলামসিয়ার পরের পর্যায় হলো একলামসিয়া। প্রি-একলামসিয়ার লক্ষণ হলো রক্তচাপ বাড়তে থাকবে। পায়ে পানি আসবে। আমরা যদি রক্ত পরীক্ষা করি দেখব, প্রোটিন যাচ্ছে। তাহলে ভালো করে চিকিৎসা নিলে প্রি-একলামসিয়া, একলামসিয়ার দিকে যাওয়ার আশঙ্কা কম। নিয়মিত চেকআপ করলে, ভালোভাবে চিকিৎসার মধ্যে থাকলে সমস্যা হয় না। আর একলামসিয়ার লক্ষণ হচ্ছে এগুলো তো থাকবে পাশাপাশি রোগীর প্রচণ্ড খিচুনি হবে। এ রকম কিছু হয় যে রক্তচাপ অনেক বাড়ছে সাথে রোগীর খুব মাথা ব্যথা করছে, রোগী ঝাপসা দেখছে বা পেটে ব্যথা হচ্ছে- তখন অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। আগে থেকেই এ ধরনের জটিল অবস্থার জন্য এ রকম প্রস্তুতি নিতে হবে সবাইকে।