শিশুর অলস চোখ : কী করবেন?

Looks like you've blocked notifications!
অনেক শিশুই অলস চোখের সমস্যায় ভোগে। ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি আপনি খেয়াল করলেন যে, আপনার শিশু তার পাশের কোনো জিনিস দেখার সময় একটি চোখ সোজা রাখছে, তবে তার অন্য চোখটি ইতস্তত ঘুরছে। নবজাতকের ক্ষেত্রে দুচোখের ইতস্তত ঘুরতে থাকাটা স্বাভাবিক। তবে শিশু যখন বড় হয়, তখন কোনো কিছু দেখার জন্য তার চোখ দুটোকে সে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে নিবদ্ধ করে এবং দুটো চোখ দিয়ে এক সঙ্গেই জিনিসটাকে দেখে-চার মাস বয়সের আগেই স্বাভাবিক ক্ষেত্রে এটা হয়। তাহলে এখন যেটা আপনি আপনার শিশুার ক্ষেত্রে খেয়াল করলেন সেটা কী? 
যদি শিশুর এক চোখ এ রকম ইতস্তত ঘুরতে থাকে তাহলে বুঝতে হবে তার অ্যামব্লাইওপিয়া রয়েছে। এটাকে বলে ‘লেজি আই’ বা ‘অলস চোখ’। এটা একটি দৃষ্টিজনিত সমস্যা। প্রতি ১০০ জনের মধ্যে তিনজনের এ সমস্যাটি হয়ে থাকে। যখন আপনি দেখলেন, আপনার শিশুর একটি চোখ অস্বাভাবিকভাবে ইতস্তত ঘুরছে, আপনি সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক হয়ে যাবেন। অ্যামব্লাইওপিয়াজনিত চোখ সত্যিকার অর্থে একটি দুর্বল চোখ, যার মধ্যে স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি গড়ে ওঠেনি। 

অ্যামব্লাইওপিয়া অবশ্যই চোখের ডাক্তার দেখিয়ে নির্ণয় করতে হবে। চোখের ডাক্তার কর্তৃক নির্দিষ্ট সময়ের আগে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া বেশ সংকটপূর্ণ কাজ। এ ব্যাপারে মা-বাবাই বেশি সাহায্য করবেন।

অ্যামব্লাইওপিয়ার চিকিৎসার জন্য চক্ষুবিশেষজ্ঞরা সচরাচর যে পদ্ধতি ব্যবহার করেন সে পদ্ধতির নাম অক্লুশন। এ ক্ষেত্রে শিশুর ভালো চোখটির ওপর প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পটি বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে সে দুর্বল চোখটির ওপর বেশি নির্ভর করতে শেখে। যত বেশি আগে থেকে এ পটি ব্যবহার করা যায় ততই ভালো। একটি দুই বছর বয়সের শিশুর চোখে পটি বেঁধে রাখতে বাবা-মার জন্য নিরানন্দের ব্যাপার হলেও এ বয়সে এ কাজটি যত সহজে করা যাবে- একটি বেশি বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে তত সহজে করা যাবে না। একটি ছয় বছর বয়সী শিশুর চোখে পটি বাঁধতে গেলে সে এটা কিছুতেই মানতে চাইবে না। তা ছাড়া শিশুর বয়স বেশি হয়ে গেলে দৃষ্টি ক্ষেত্রের সঠিক পরিবর্তন ফিরিয়ে আনাও কঠিন হয়ে পড়ে।

চোখে পটি বাঁধার কাজ অবশ্যই একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশ মতো চালিয়ে যেতে হবে। যদি আপনার চিকিৎসক শিশুর চোখে পটি বাঁধার সুপারিশ করেন তাহলে আপনার নিজের এবং শিশুর জন্য ব্যাপারটা সহজতর করতে নিচের পরামর্শগুলো মেনে চলবেন।

শিশুকে বুঝিয়ে বলুন
এক চোখে পটি বেঁধে রাখা কোনো মজার বিষয় নয়,তাই আপনার শিশুকে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলুন যে, কেন এটা তার জন্য এত প্রয়োজনীয়। যদি আপনার শিশু বোঝার মতো বড় হয় তাহলে তার ভালো চোখটা আপনার হাত দিয়ে ঢেকে তাকে জিজ্ঞেস করুন অন্য চোখটা দিয়ে সে কেমন দেখছে। তাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলুন যে,এ চোখটি দুর্বল এবং ভালো চোখে পটি বেঁধে রাখলে এই দুর্বল চোখটি একসময় ওরকম ভালো হয়ে যাবে।

নির্দিষ্ট সময়ে পটি বাঁধুন
আপনার শিশুর চোখে পটি বাঁধার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে রাখুন। প্রতিদিন ওই একই সময়ে পটি বেঁধে দেবেন। এভাবে একই সময়ে পটি বেঁধে দিলে সেটা রুটিন কাজ হয়ে যাবে এবং শিশুও জানবে তাকে কি করতে হবে। যদি দিনে তার তিন ঘণ্টা পটি বেঁধে রাখার প্রয়োজন হয়, তাহলে সে ওই তিন ঘণ্টা চোখে পটি রাখবে।
শিশুর বাড়িতে থাকার সময়টাকে পটি বাঁধার সময় হিসেবে ঠিক করুন

দিনের যে সময়টাতে শিশু বাড়িতে থাকে, সে সময় পটি বাঁধলে উপকার পাওয়া যেতে পারে। যখন সে স্কুলে বা ডেকেয়ারে না থাকে সে সময়টাকে বেছে নিন। সবচেয়ে ভালো হয় বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সময়টা। শিশুকে এ সময়টাতে পটি বাঁধতে উৎসাহিত করুন। রোগের ব্যাপারে শিশুর সচেতনতা কম থাকে, সে কারণে সে তার সহপাঠীদের সামনে লজ্জায় পটি বাঁধতে চাইবে না। তবে তাকে যদি বাড়িতে থাকার সময় পটি বাঁধা হয় তা হলে সে সঙ্কোচ বোধ তার থাকবে না। বাড়িতে থাকার সময় পটি বাঁধার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো এতে আপনি পটি বাঁধার প্রক্রিয়াটি খেয়াল রাখতে পারবেন। আপনার শিশুর দেখাশোনা করে এমন কেউ যেন আপনার অনুপস্থিতিতে তার চোখে পটি না বাঁধে সেটাও খেয়াল রাখবেন।

উঁকি মারা প্রতিরোধ করুন
অ্যামব্লাইওপিয়ার চিকিৎসায় শুধু আপনার চক্ষু বিশেষজ্ঞের দেওয়া পটি ব্যবহার করবেন। এ পটি দু’ধরনের পাওয়া যায়- একটি বড় আকৃতির, অন্যটি ছোট আকৃতির। দুই ধরনের পটিরই চার দিকে আঁঠা লাগানো থাকে যাতে চোখের চার দিকে পটিটা ভালোভাবে লাগতে পারে এবং কোনো ফাঁক না থাকে। পাঁচ বছর বা তার কাছাকাছি বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে ছোট আকৃতির পটি যথেষ্ট। বয়স্ক শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত স্বাভাবিক আকারের পটি ব্যবহার করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো শিশুর চোখে পটিটা ভালো করে লাগিয়ে দেয়া- চশমাতে লাগানো নয়। যদি চশমাতে পটি লাগান তাহলে শিশু চশমার আশপাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করবে। এতে দুর্বল চোখটিকে সে পর্যাপ্ত কাজে লাগাতে পারবে না। তবে আপনি যদি তার ভালো চোখটিতে পটি লাগিয়ে চোখের চারপাশটা ভালো করে এঁটে দেন তাহলে সে বাধ্য হয়ে খারাপ চোখটা দিয়ে দেখবে এবং এতে তার খারাপ চোখের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে।

নিজের অবস্থানে দৃঢ় থাকুন
পটি বাঁধার ব্যাপারে যদি আপনাকে জোর প্রয়োগ করতে হয় তবু নমনীয় হবেন না। বাবা-মা হিসেবে আপনি কঠোরভাবে আপনার দায়িত্ব পালন করবেন। কখনোই নির্দিষ্ট সময়ের আগে পটি খুলবেন না। যদি একবার এর ব্যতিক্রম ঘটান তাহলে শিশু সুযোগ পেয়ে যাবে এবং যখনই আপনি তাকে পটি পরাবেন তখনই সে তা খুলে দেওয়ার জন্য অনুনয় বিনয় করবে।

শিশুর অশোভন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করুন
যদি শিশু চোখে পটি বাঁধতে না চায় এবং অশোভন আচরণ করে তাহলে তাকে তিনটি পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে পারেন। প্রথমত, একই রকম নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখবেন অর্থাৎ শিশুর অন্য অশোভন আচরণের জন্য তাকে যে ধরনের শাস্তি প্রদান করেন, এ ক্ষেত্রেও সে রকম শাস্তি দেবেন। যদি অন্য দুষ্টমির জন্য তাকে অতিরিক্ত পড়তে বলেন, এ ক্ষেত্রেও তাই করবেন।

দ্বিতীয়ত, শিশু পটি না বাঁধার জন্য দুষ্টমি করে যতটা সময় ব্যয় করবে, সেই অতিরিক্ত সময়টুকুও তার চোখে পটি বেঁধে রাখবেন। এতে শিশু দ্রুত উপলব্ধি করবে যে, তাকে দুষ্টমি বন্ধ করতে হবে। 

তৃতীয়ত, যদি শিশু কোনো কাজ করার ছলে পটি খুলে ফেলে তাহলে তাকে সেই কাজটি করতে দেবেন না। উদাহরণস্বরূপ শিশু যদি পটি খুলে টিভি দেখে, তাহলে তা টিভি দেখতে দেবেন না।

সময়টাকে কমাবে না
পটি বেঁধে রাখার সময়ের ব্যাপারে কার্পণ্য করবেন না। যদি শিশু তার অন্য কাজের জন্য নিয়োজিত সময়ের সামান্য আগেও পটি খুলে ফেলে তাহলে কাজ শেষ হয়ে গেলে আবার তাকে পটি বাঁধতে বলবেন। আপনি যদি নিশ্চিত না হোন যে কতটা সময়ে সে পটি খুলে রেখেছিল তাহলে প্রথম থেকে আবার শুরু করবেন। যদি পটি বেঁধে রাখার সময়টুকু একদিনে সম্পূর্ণ না হয় তাহলে পর দিন ওই অতিরিক্ত সময় পটি বেঁধে রাখবেন।

স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করুন
শিশু চোখে পটি বেঁধে স্কুলে গেলে সেখানে সে সহপাঠীদের কৌতুকের পাত্র হতে পারে। তাই যদি স্কুলের সময় তার পটি বাঁধার সময়টা নির্দিষ্ট করে দেন তাহলে অবশ্যই আপনার শিশুর শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে নেবেন। শিক্ষক অন্য ছাত্রদের বুঝিয়ে দেবেন যে, আমরা প্রত্যেকেই একজন থেকে আরেকজন কতটা ভিন্ন প্রকৃতির। কোনো মানুষ খাটো আবার কোনো মানুষ লম্বা, কেউ মোটা আবার কেউ চিকন। ঠিক সেরকম কেউ চশমা পরে অথবা চোখে পটি বাঁধে। এতে হাসি ঠাট্টার কিছু নেই।

স্কুলের আয়াকে সতর্ক করুন
শিশু ঠিকমতো পটি বেঁধে রেখেছে কি না সেটা যাতে লক্ষ রাখে সে ব্যাপারে স্কুলের আয়াকে সতর্ক করে দিতে হবে। শিশুর দৃষ্টিশক্তির সমস্যাটা আয়াকে বুঝিয়ে বলতে হবে যাতে সে লক্ষ রাখতে পারে যে, শিশু নির্দিষ্ট সময় ধরে চোখে পটি বেঁধে রেখেছে। শুধু আয়া নয়, শিক্ষকের সহকারীকেও বলবেন। এতে তারা শিশুর চোখের পটি দেখে রাখতে পারবে।

টেরা চোখের ব্যাপারে সতর্ক হোন
টেরা চোখের একটা খেলনা ভালুককে দেখতে মজাই লাগে, কিন্তু বাস্তব জীবনে একটা শিশুর এ সমস্যাটি থাকলে সেটা মোটেই হাসির কোনো বিষয় নয়। দু ’চোখের নড়াচড়ার মধ্যে ছন্দপতন ঘটলে চোখ টেরা হয় এবং এই ছন্দপতন ঘটে দুচোখের পেশিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে। যদি দীর্ঘদিন এটার চিকিৎসা করা না হয় তাহলে চোখ কখনোই পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে না।

প্রাথমিক অবস্থায় টেরা চোখ ধরাপড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করালে অধিকাংশ ক্ষেত্রে টেরা চোখ ভালো হয়ে যায়। যদি আপনার শিশু টেরা চোখ নিয়ে জন্ম নেয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসককে দেখাবেন। যদি চক্ষু বিশেষজ্ঞ অপারেশনের প্রয়োজন মনে করেন তাহলে তাই করাতে হবে। অনেক সময় পারিবারিক ফটোগ্রাফ বা ছবি দেখেও আপনি আপনার শিশুর টেরা চোখ শনাক্ত করতে পারেন।

কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন
আপনার শিশুর লেজি আই বা অলস চোখ থাকলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। আপনি যত তাড়াতাড়ি শিশুর চিকিৎসা শুরু করবেন, সমস্যাটা প্রকট হওয়ার তত কম সম্ভাবনা থাকে। যদি শিশুর চোখে কোনো সমস্যা নাও থাকে তবু তিন থেকে চার বছর বয়সী প্রতিটা শিশুর চোখ সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। আর যদি অ্যামব্লাইওপিয়া বা অলস চোখের পারিবারিক ইতিহাস থাকে অথবা টেরা চোখ থাকে তাহলে খুব দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

অলস চোখের প্রধান চিকিৎসা হলো ভালো চোখে পটি বেঁধে দুর্বল চোখটি দিয়ে দেখা এবং প্রয়োজন হলে চশমা ব্যবহার করা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যদি চোখের অন্য কোনো সমস্যার কারণে অ্যামব্লাইওপিয়া হয় তাহলে কিছু কিছু চিকিৎসক পটির মাধ্যমে আগে দৃষ্টিশক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে পরে অপারেশন করে থাকেন। যেসব শিশু চোখে একেবারেই পটি বাঁধতে চায় না, তাদের ভালো চোখটাতে বিশেষ চোখের ড্রপ ব্যবহার করে সাময়িকভাবে ওই চোখের দৃষ্টি ঝাপসা করে দিয়ে শিশুকে দেখার কাজে অলস চোখটা ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়।

লেখক : স্বাস্থ্য নিবন্ধকার, কথা সাহিত্যিক ও সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমা বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।  :