এনার্জি ড্রিংকস পান করলে শরীরে যা ঘটে

Looks like you've blocked notifications!

মাঝেমধ্যে ঠান্ডা এনার্জি ড্রিংকস না খেলে অনেকের শরীর যেন আর চলতেই চায় না। মফস্বল শহর এমনকি বড় শহরগুলোতেও এনার্জি ড্রিংকস পান করা বলতে গেলে তারুণ্যের ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, এনার্জি ড্রিংকস আসলে আমাদের শরীরে কী ঘটায়!

চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে কোকাকোলা ও ডায়েট কোক খাওয়ার পর শারীরিক প্রতিক্রিয়ার রেখাচিত্র তুলে ধরা হয়েছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলে। এ ছাড়া পার্সোনালাইজ ডট সিও ডট ইউকেতেও এনার্জি ড্রিংকস পানের পর শারীরিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এক বোতল এনার্জি ড্রিংকস পানের ২৪ ঘণ্টা পর মানবদেহে রক্তচাপ বৃদ্ধি, ক্লান্ত অনুভব করা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য, অন্তত এই তিনটি লক্ষণ প্রবলভাবে দেখা দেয়।

চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে পার্সোনালাইজ ইউকে জানায়, এনার্জি ড্রিংকস পানের প্রথম ১০ মিনিটে হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ বেড়ে যায়। আর ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর মানবদেহ এনার্জি ড্রিংকস গ্রহণের প্রাথমিক প্রভাবগুলো প্রত্যাহার করতে শুরু করে। প্রত্যাহারের সময় মাথাব্যথা, বিরক্তিভাব প্রকাশ ও কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ প্রকাশ পায়। পরের ১২ দিন পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়াগুলো থাকে।

ফিমেইল ম্যাগাজিন জানিয়েছে, মানবদেহে এনার্জি ড্রিংকসের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত খাদ্য গবেষক ড. স্টুয়ার্ট ফ্যারিমন্ডের সঙ্গে কথা বলেছে তারা। ফ্যারিমন্ড জানান, শরীরে ক্যাফেইন গ্রহণের একটি খারাপ উপায় হলো এনার্জি ড্রিংকস পান করা।

শরীরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ ক্ষতিকর উল্লেখ করে ফ্যারিমন্ড জানান, এনার্জি ড্রিংকসে উচ্চমাত্রার চিনি থাকে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এই পরিমাণ চিনি সরাসরি গ্রহণ করলে যে কারো বমি হবে। তবে পানীয়তে থাকা ফসফরিক এসিড ও কার্বনেটের কারণে তা পান করতে পারে মানুষ। উচ্চমাত্রার এসিড ও কার্বনেটের গ্রহণও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।
 
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এলেনা জিমসন বলেন, ‘এনার্জি ড্রিংকস প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, তেমনি তাদের প্রচারকৌশলও খুব সূক্ষ্ম। ফলে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিকর দিকের প্রচারটি খুব সহজেই ঢাকা পড়ে যায়।’

ড. ফ্যারিমন্ড জানান, যেসব পানীয়ের বোতল খুলতে সাঁ সাঁ শব্দ করে সেগুলোর সবই অম্ল উৎপাদনকারী (এসিডিক)। এই পানীয়গুলো তৈরিতে কার্বনেটেড এবং অতিরিক্ত এসিড ব্যবহার করা হয়, যা শরীরে সাময়িক চনমনে ভাব এনে দেয়।

ফ্যারিমন্ড ফিমেইল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় উদাহরণ হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত এনার্জি ড্রিংকস রেড বুলের উদাহরণ টানেন। রেডবুলে ক্ষারের মাত্রা থাকে পিএইচ স্কেলে ৩ দশমিক ৩, যা ভিনেগারের কাছাকাছি। এই মাত্রার ক্ষার দাঁতের এনামেল গলিয়ে ফেলে দাঁতের স্থায়ী ক্ষতি করার জন্য যথেষ্ট।

এ ছাড়া এনার্জি ড্রিংকসে থাকা রাসায়নিক উপাদানের কারণে বোতলে কোনো ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাশ জন্মাতে পারে না। পানিতে থাকা জুওপ্লাংকটন ও ফাইটোপ্লাংকটনও জন্মাতে পারে না। 

এসব পানীয় খেলে কী হয়? পুষ্টিবিজ্ঞানী ড. ফ্যারিমন্ড জানান, দীর্ঘদিন ধরে এসব এনার্জি ড্রিংকস পানে খাদ্যনালির ভেতরের মিউকাস মেমব্রেন নষ্ট হয়ে যায়। নাড়ির সংকোচন ও সম্প্রসারণ ক্ষমতা কমে খাদ্য থেকে পুষ্টি শুষে নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। এ ছাড়া হজমক্ষমতা কমে, বদহজম, খাদ্যে বিষক্রিয়া, গ্যাস্ট্রিক, ক্ষুধামান্দ্যসহ নানা অসুখ-বিসুখ দেখা দিতে পারে। হতে পারে স্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যও। অতিরিক্ত চিনির কারণে অনেকের শরীরের ওজন বেড়ে স্থুলস্বাস্থ্যে পরিণত হয়। বাড়ে শরীরের চর্বি বা কোলেস্টেরলের পরিমাণও। শরীরের ক্যালসিয়াম মলিউকুল গঠন প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। হাড় দুর্বল ও নরম হয়ে যায়। এ ছাড়া জনন প্রক্রিয়ায় স্থায়ী ক্ষতিও হতে পারে। 

আসুন দেখে নিই আপনার শরীরে কী পরিবর্তন ঘটে এক ক্যান এনার্জি ড্রিংকস পানের পর : 

প্রথম ১০ মিনিট : এ সময় এনার্জি ড্রিংকসে থাকা ক্যাফেইন রক্তে মিশে যেতে শুরু করে। মানবদেহও সঙ্গে সঙ্গে হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়ে এই পরিবর্তনে সাড়া দেয়।

১৫ থেকে ৪৫ মিনিট : আপনি কত দ্রুত পান করেছেন, তার ওপর ১৫ থেকে ৪৫ মিনিটের মধ্যের শারীরিক প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে। এই সময়ের মধ্যে এনার্জি ড্রিংকসে থাকা ক্যাফেইন ও অন্যান্য উপাদান আপনার শরীরে অনেকটাই মিশে গেছে। ক্যাফেইন একটি উদ্দীপক ওষুধ হওয়ায় এই সময় আপনি নিজেকে যেকোনো কাজে আরো বেশি কর্মতৎপর অনুভব করবেন। 

ড. ফ্যারিমন্ড বলেন, ‘পানীয়গুলো পানের কিছুক্ষণ পর থেকে রক্তের সঙ্গে শরীর ও মস্তিষ্ক উদ্দীপ্ত হয়।’

৩০ থেকে ৫০ মিনিট : পানীয় পানের পরবর্তী ৫০ মিনিটের মধ্যে ক্যাফেইন পুরোপুরি আপনার শরীরে মিশে যায়। এ সময় যকৃত উদ্দীপ্ত হয়ে অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করতে শুরু করে। এই সময়ের মধ্যে শরীরের অন্যান্য প্রত্যঙ্গ মিলে চিনি শোষণ করতে শুরু করে। ফলে যকৃতে চর্বি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। তবে ক্যাফেইনের প্রতিক্রিয়া থাকায় শরীর তখনো উদ্দীপ্ত থাকে।

এক ঘণ্টা পর : এক ঘণ্টা পর থেকে যকৃত রক্তে থাকা চিনির অনেকখানিই টেনে নেয়। ফলে রক্তে চিনির মাত্রা ও উদ্দীপক ক্যাফেইনের মাত্রা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। ফলে শরীরে শক্তির স্তরও কমতে থাকে। দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর অবসাদ ও ক্লান্তি লাগা শুরু হয়। এই সময়ে অন্ত্রে থাকা চিনি রেচন প্রক্রিয়া বাড়িয়ে দেয়। মূত্রের সঙ্গে অতিরিক্ত চিনি, ক্যালসিয়ামসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ ও ইলেকট্রোলাইট শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।

পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা পর : ড. ফ্যারিমন্ড জানান, শরীরে সাধারণত ক্যাফেইনের কার্যপ্রক্রিয়া থাকে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। তবে সাধারণত পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে ক্যাফেইনের উদ্দীপক প্রভাবটি কমে যায়। ফলে এ সময়ে শরীরে ক্যাফেইনের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় অবসাদ দেখা দেয়।

১২ ঘণ্টা পর : এ সময় শরীরে ক্যাফেইনের উদ্দীপক প্রভাব একেবারেই চলে যায়। তবে যেসব নারী জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ খান তাঁদের ক্ষেত্রে এই মাত্রা আরো ছয় ঘণ্টা বেশি হতে পারে। তবে এই সময়ের মধ্যে শরীরে ক্যাফেইন প্রত্যাহারের প্রভাব শুরু হয়।

১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা : নিয়মিত এনার্জি ড্রিংকস সেবনকারীদের সাধারণত ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আবার ওই পানীয় পানের তুমুল আগ্রহ দেখা দেয়। কারণ শরীর ততক্ষণে কোমল পানীয় পানে যে পদার্থগুলো শরীরে ঢুকেছে তা প্রত্যাহার করতে শুরু করেছে। এই সময়ে মাথাব্যথা, মেজাজ খারাপ এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের উপসর্গও দেখা যায়।

সাত থেকে ১২ দিন : গবেষণায় দেখা গেছে, টানা সাত থেকে ১২ দিন এনার্জি ড্রিংকস গ্রহণের ফলে শরীর নিয়মিত ক্যাফেইন গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। 

আরেকটি গবেষণার সূত্র উল্লেখ করে ফিমেইল ম্যাগাজিন জানায়, আলঝেইমারসহ বিভিন্ন স্নায়ুরোগে ক্যাফেইন গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় খিটখিটে মেজাজ, কর্মক্ষমতা হ্রাসসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়। তেমনি টানা এনার্জি ড্রিংকস পানে শরীরে একই উপসর্গ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বিশ্বের অনেক দেশেই এনার্জি ড্রিংকস নিষিদ্ধ 
২০০৮ সালে ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকস বিক্রির মেশিন বাধ্যতামূলকভাবে অপসারণ করা হয়। এ ছাড়া চীন, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকস বিক্রিও নিষিদ্ধ।
 
ভারতে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় কয়েকটি বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানির কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকসে অত্যধিক মাত্রায় কীটনাশক পাওয়ায় মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট ও কেরালায় এসব পানীয় বিক্রি নিষিদ্ধও করা হয়। ভারতে কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকসের ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। এসব পানীয় যে ক্ষতিকর নয়, তা ওই সব উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে প্রমাণ করতে বলা হয়েছে।