সঞ্জীবনী
কম খরচে চিকিৎসা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে
ভেতরে ঢুকতেই অনেক গাছগাছালি। একটু সামনে এগোতেই ডান দিকে হাসপাতালের বহির্বিভাগ আর বাঁ দিকে অ্যাজমা সেন্টার। ডান পাশের বহির্বিভাগ পার হয়ে ভেতরে যেতে লম্বা এক করিডোর। করিডোরে দুই পাশেই গ্রিল লাগানো। ভেতরে ইনডোরে ভর্তি থাকেন রোগীরা। এভাবেই ঢাকার মহাখালীতে ৫২ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এখানে একসময় কেবল যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা করা হলেও এখন অ্যাজমা, সিওপিডি, ফুসফুসে প্রদাহজনিত রোগ, বুকের টিউমার, ক্যানসারের সার্জারি ইত্যাদি চিকিৎসা করা হয়। এটাই একমাত্র হাসপাতাল, যেখানে বুকের জটিল অস্ত্রোপচারগুলোও করা হয়।
শুরুর কথা
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কীভাবে শুরু হলো, এ নিয়ে কথা হয় পরিচালক অধ্যাপক রাশিদুল হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৯৫০-এর দশকে বলা হতো—যার হয় যক্ষ্মা তার নাই রক্ষা। যক্ষ্মার চিকিৎসার জন্য বলা হতো, রোগীকে ভালো হাওয়া-বাতাসের মধ্যে রাখতে হবে। সেনেটোরিয়াম চিকিৎসা পদ্ধতি হতে হবে। ভালো খাবার খেতে হবে। যেখানে রোগী থাকবে, সে জায়গার ভেন্টিলেশন ভালো হতে হবে। এ লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে যক্ষ্মা বা টিবি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬২ সালে এটা বক্ষব্যাধি হাসপাতাল করা হয়। ১৯৯৭ সালে এই হাসপাতালেরই নাম দেওয়া হয় জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।
অধ্যাপক রাশিদুল হাসান জানান, ১৯৯৫ সালে জাতীয় অ্যাজমা সেন্টার করার জন্য প্রজেক্ট জমা দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে পাঁচতলা ভবনবিশিষ্ট জাতীয় অ্যাজমা সেন্টার তৈরি করা হয়।
অধ্যাপক রাশিদুল হাসান আরো বলেন, ১৯৫৫ সালে এটা ছিল ২০০ শয্যার হাসপাতাল। ১৯৬২ সালে একে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এর পর ১৯৯৩ সালে উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৬০০ শয্যার হাসপাতালে পরিণত হয়। ২০০৪ সালে আরো ৭০ শয্যা যোগ করা হয়। এখন মোট ৬৭০ শয্যার হাসপাতাল এটি।
চিকিৎসাসেবা
এখানে রেসপিরেটোরি মেডিসিন, থোরাসিক সার্জারি বিভাগ রয়েছে। রেসপিরেটোরি বিভাগে ১০টি ইউনিট ও থোরাসিক চারটি ইউনিট কাজ করছে। এ ছাড়া রেডিওলজি, প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ন্যাশনাল টিউবার কোলসিস ইত্যাদির বিভাগ রয়েছে। এখানে এমডিআর টিবি শনাক্ত করার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে।
ইনডোরে ২৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। বক্ষব্যাধি হাসপাতালের কেবিন ভাড়া ২৮০ টাকা। অ্যাজমা সেন্টারের পেইং কেবিন ভাড়া এক হাজার টাকা। প্রতিদিন অ্যাজমা, ইমার্জেন্সি ও আউটডোর মিলিয়ে প্রায় ৫০০ রোগী দেখা হয়। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত আউটডোরে রোগী দেখা হয়। আউটডোরে ১০ টাকা টিকেট কেটে রোগী দেখাতে হয়।
অ্যাজমা সেন্টারে রেসপিরেটোরি ল্যাব আছে। ফুসফুসের সব ধরনের এক্স-রে করা হয়। স্লিপল্যাপ, সিপিইটি, বডি ব্ক্স এ পদ্ধতির পরীক্ষা করা হয়, যে পরীক্ষাগুলো বাইরের অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে নেই। বেসরকারি এক থেকে দুটি হাসপাতালে এই পরীক্ষা করা হয়। তবে এখানে নামমাত্র মূল্যে এই পরীক্ষা করা হয়।
এ ছাড়া বাচ্চারা অনেক সময় ফরেন বডি (যেমন : সেপটিপিন বা পয়সা) খেয়ে ফেলে, সেগুলো চিকিৎসা করা হয়। চিকিৎসার বেশির ভাগ খরচ হাসপাতাল বহনের চেষ্টা করে। যক্ষ্মা সাধারণত দরিদ্র জনগোষ্ঠীরই হয়। যক্ষ্মার সব ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা এখানে রয়েছে।
কুর্মিটোলা থেকে বহির্বিভাগে এসেছেন মনোয়ার হোসেন। তিনি শ্বাসকষ্টের রোগে ভুগছেন। জানালেন, এখানে বুকের সমস্যার অধিকাংশ এক্স-রে বেশ ভালোভাবে করা যায়। খরচ কম পড়ে।
কথা হয় বহির্বিভাগে আসা আরেক রোগী ফাতেমা বেগমের সঙ্গে। যক্ষ্মা হয়েছে তাঁর। তিনি বললেন, ‘অনেক দিন ধরে এখানে চিকিৎসা নিয়েছি। আমি এখন সুস্থ হওয়ার পথে।’
গরিবদের জন্যই চিকিৎসা
পরিচালক অধ্যাপক রাশিদুল হাসান বলেন, হাসপাতাল সরকারি অর্থায়নে চলে। এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ রোগীই গরিব। চিকিৎসার বেশির ভাগ খরচ হাসপাতাল বহন করে। দামি ওষুধ রোগীদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এসব রোগের চিকিৎসায় রোগীদের প্রায় দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেওয়া লাগে। কোনো কোনো রোগীকে ছয় থেকে দুই বছর পর্যন্ত ভর্তি থাকতে হয়।
হাসপাতালে সাড়ে আটশ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। চিকিৎসার জন্য বাইরের দেশের কোনো চিকিৎসক নেই। তবে কনফারেন্স, সেমিনার, ওয়ার্কশপে বাইরের চিকিৎসক আসেন।
চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি ইনস্টিটিউট রয়েছে প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য। বক্ষব্যাধির ওপর এসব প্রশিক্ষণ করা হয়। ইনস্টিটিউটের কোর্সগুলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলের আওতাধীন।
আশা আছে অনেক
পরিচালক অধ্যাপক রাশিদুল হাসান বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে এই হাসপাতালে ১৬ তলা বিল্ডিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। হাসপাতালকে ১,৬০০ থেকে ২,০০০ শয্যায় উন্নীত করা হলে ভালো হয়। তাহলে জনগণের চাহিদা মিটবে। এখানে একটা ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন রয়েছে। আরো দুটো চালু হওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া সরকার যদি ছয় মাসের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়, গ্রামগঞ্জ থেকে চিকিৎসকরা এসে প্রশিক্ষণ নেবে, তাহলে শহরে হাসপাতালে রোগীদের চাপ অনেক কমে যেত। গ্রামেই এগুলোর চিকিৎসা করা যেত। এই বিষয়গুলো দৃষ্টি দিলে হয়তো ব্ক্ষব্যাধির চিকিৎসায় আমাদের দেশ আরো ভালো করত।
ঠিকানা
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী ঢাকা-১২১২