ব্যথামুক্ত প্রসব কি সম্ভব?

Looks like you've blocked notifications!
ডা. মো. ইয়ুনুস আলী।

আমরা জানি, প্রসব ব্যথা হচ্ছে অন্যতম কষ্টদায়ক ব্যথা। তবে ব্যথামুক্তভাবেও স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব কি না এবং কী করণীয় এ বিষয়ে আজ ৩১ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৩৭তম পর্বে কথা বলেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া অ্যান্ড আইসিও বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. ইয়ুনুস আলী।

প্রশ্ন : প্রসব বেদনা নিয়ে প্রত্যেক মায়ের মধ্যে একটি আতঙ্ক কাজ করে আমরা জানি। এ কারণে অনেকে সিজারকে বিকল্প হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহী হন। এত ব্যথা হয় যে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মা ভাবেন তিনি আর জন্মদান করবেন না। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী? ব্যথা কি অবধারিত না কি ব্যথামুক্তভাবেও প্রসব করানো যায়?

উত্তর : ব্যথামুক্তভাবে স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব। প্রেক্ষাপটটা একটু বলি। এখন পৃথিবীর সব উন্নত দেশে, এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশেও ব্যথামুক্তভাবে স্বাভাবিক ভ্যাজাইনাল প্রসব হচ্ছে। এই পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হলো ইপিডোরাল ক্যাথেডারের মাধ্যমে ওষুধ প্রয়োগ করা। এটা আমরা করি। ইপিডোরাল ক্যাথেডারের মাধ্যমে যদি ওষুধ দিই মা সচেতন থাকেন, হাঁটাচলা সবই করতে পারেন এবং যে নির্দিষ্ট সময় এই ব্যথা হয় সে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এটা ব্যথামুক্ত রাখে। সম্পূর্ণ ব্যথামুক্তভাবে, সম্পূর্ণ সচেতন অবস্থায় একজন মা স্বাভাবিক প্রসব করতে পারেন। যখন এভাবে ব্যথামুক্তভাবে প্রসব হয়, তখন এটা খুব গর্বের ব্যাপার। এই পদ্ধতি সব দেশেই কমবেশি চালু হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য আমাদের দেশে এখনো এটা শুরু করতে পারি নাই। তবে শুরু করা খুব জরুরি। কারণ আপনি আপনার বক্তব্যেই বলেছেন সবচেয়ে কষ্টদায়ক ব্যথা হচ্ছে প্রসবের ব্যথা। আমরাও আমাদের পেইন মেডিসিনে এই কথাটিই বলি, গুরুতর যত ব্যথা রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো প্রসববেদনা। কাজেই ব্যথামুক্তভাবে প্রসব করা আজকের সময়ের দাবি এবং যেকোনোভাবেই আমাদের দেশে এটা শুরু করতে হবে। এটা করা সম্ভব।urgentPhoto

প্রশ্ন : আমাদের দেশের রোগীদের মধ্যে একটা বিষয় আছে, প্রসবের কথা এলেই সিজারিয়ান করার কথা বলে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে মায়েরাও বেশি আগ্রহী। আমাদের চিকিৎসকরাও বেশি করেন। এই চিত্র অন্যান্য দেশে কেমন?

উত্তর : দেশভেদে একটু ব্যতিক্রম হবেই। তবে আমরা যদি বিচারের কথা বলি, তাহলে একটা মা তার প্রচণ্ড ব্যথা, ব্যথার জন্য সে প্রসব স্বাভাবিকভাবে করতে চাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে সে অনুরোধ করে সিজারিয়ান করে ফেলার। এটা যদি করেন তবে তো সিজার করতেই পারে। তবে এ কথা সত্য যদি আমরা স্বাভাবিক প্রসব ব্যথামুক্ত করে দিতে পারি তাহলে এ অনুরোধ মায়েদের তরফ থেকে আর হবে না। অনেক দেশে এটা করার পর স্বাভাবিক ভ্যাজাইনাল প্রসবের সংখ্যা খুব বেশি। আমি দু-একটা দেশের নাম বলতে পারি। যেমন : ইটালি, কানাডা। এরা স্বাভাবিক প্রসব ছাড়া সিজারের কথা চিন্তাই করে না। তাই আমরা যদি মাকে ব্যথামুক্ত অবস্থায় প্রসবের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে এমনিতেই সিজারের প্রতি মায়েদের মনোযোগ কমে যেতে বাধ্য। কারণ মায়েরা যদি জানে স্বাভাবিক প্রসব হলেই ব্যথা হয় না তাহলে তো তারা সিজারের জন্য অনুরোধ করবে না।

প্রশ্ন : সিজারিয়ান সেকশন করলে অসুবিধা কী?

উত্তর : স্বাভাবিক প্রসবের ব্যথার সময়টা ১৮ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময়ব্যাপী হওয়ার কারণে অনেকেই সিজালিয়ানের দিকে বেশি ঝুঁকে যায়। আমাদের তরফ থেকেও এই ধরনের একটা গাফিলতি আছে। কিন্তু আপনি যেটা বলছেন সিজার করলে ক্ষতি কী? এটার প্রথম দিক হলো, আর্থসামাজিক বিবেচনায় আমাদের দেশ একটা গরিব দেশ। যদি আর্থিক চাপের কথা চিন্তা করেন এটা একটা বিশাল চাপ। পরিবারে যদি দুটি বাচ্চাও হয়, দুটি বাচ্চার এই সার্জারির খরচ বহন করার মতো অনেক পরিবারেরই সামর্থ্য নেই। সার্জারির খরচ, হাসপাতালের খরচ ইত্যাদি। এই চাপ থেকে উত্তরণের জন্য আমরা এই দিকে যেতে পারি। আর প্রতিটা সার্জারির কমবেশি জটিলতা থাকে। সেই জটিলতা কমাতেও খরচ হয়। একটা সার্জারি করা হলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গেই আর আগের অবস্থায় গিয়ে পৌঁছায় না। সে জন্য আমরা যদি স্বাভাবিক প্রসবের দিকে ঝুঁকতে পারি তবে সিজারিয়ান সার্জারি অনেক কমে যাবে বলে আমার ধারণা।

প্রশ্ন : আমরা জানি, সিজারিয়ান করতে হলে গাইনোকোলজিস্ট, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট থাকেন। স্বাভাবিক ব্যথামুক্ত প্রসব করানোর দলের মধ্যে কারা থাকেন?

উত্তর : আমরা যদি ব্যথামুক্ত একটি ভ্যাজাইনাল প্রসব করতে চাই সেখানে দলে সদস্য হিসেবে গাইনোকোলজিস্ট, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, পেইন স্পেশালিস্ট, মিড ওয়াইব, ট্র্যাডিশনাল বার্থ অ্যাটেনডেন্ট এবং অন্যান্য প্যারামেডিকস নিয়ে একটা দল তৈরি করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে, সেটা প্রাইভেট বা সরকারি হাসপাতালে একটা ভালোমানের ডেলিভারি সেন্টার এবং ডেলিভারি ইউনিট তৈরি করা দরকার। যদি মায়েদের এ রকম একটি ইউনিটের সাপোর্ট দেওয়া যায় তাহলে সাধারণভাবে প্রত্যেকটি মা উৎসাহিত হবে স্বাভাবিক প্রসব করার জন্য। সে ক্ষেত্রে সিজারের যে আধিক্য সেটা কমে যাবে এবং রোগীদের আর্থিক খরচ কমে যাবে। তাদের কষ্ট অনেক কমে যাবে।

প্রশ্ন : যদি একজন মা স্বাভাবিক প্রসব করতে না চান তাহলে তাকে বোঝানোর জন্য কিছু পরামর্শের দরকার হয়। যেটারও কমতি আছে আমাদের মধ্যে এটা অনেকে বলে থাকেন। চিকিৎসক হিসেবে আপনার ওই মায়েদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য কী?

উত্তর : মাকে বুঝতে হবে সে সিজারিয়ান সেকশন ছাড়াই জন্ম নিয়েছিল। তার মা নানির কাছ থেকে হয়েছে সেখানেও ব্যথা ছিল। সে জন্য যদি ব্যথামুক্ত প্রসব করার সুযোগ থাকে, সেটা তো অনেক ভালো। আর সেটা যদি নাও থাকে তাদের যদি আমরা সঠিক পরামর্শ দিতে পারি, তাদের ভেতর যদি আগ্রহ তৈরি করতে পারি, তার মানসিক অবস্থা সেভাবে করতে পারি যে প্রসব স্বাভাবিক হবে এই কষ্টটা একটু যেন মেনে নেয় তাহলে ভালো হয়। আর যদি ব্যথামুক্ত প্রসব করাতে পারি তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তখন প্রত্যেক মা স্বাভাবিক প্রসবে রাজি হবে এবং সেটিই প্রত্যাশিত।

প্রশ্ন : অনেকে বলেন সিজারিয়ান সেকশনের কারণে আমাদের সন্তানদানের বেলায়  স্বাভাবিক প্রসবে যে মাতৃমৃত্যু ছিল, সেটার হার অনেক কমেছে। আসলে এর যৌক্তিকতা কতখানি? এবং একজন মায়ের কোন পর্যায়ে গেলে বা কী কী শর্ত থাকলে তাকে স্বাভাবিক প্রসবের জন্য অপেক্ষা না করে সিজারিয়ানের দিকেই যেতে হয়?

উত্তর : সাধারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ক্যাপালোপেলভিক ডিসপোপোরশন অর্থাৎ মায়ের জন্মদানের জায়গা এবং বাচ্চার মাথা ভুল অবস্থায় থাকার কারণে কোনোভাবে প্রসব হবে না। কিছু কিছু অবস্থা আছে বাচ্চা আড়াআড়ি শুয়ে আছে মায়ের পেটে সেখানে সাধারণত স্বাভাবিক প্রসব হবে না। আবার দেখা গেল স্বাভাবিক প্রসব করতে চাইলাম, তবে সেখানে এত সময় নিচ্ছে সে ক্ষেত্রে মায়ের বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে এবং বাচ্চা স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিচ্ছে না অথবা মারাও যেতে পারে। এ রকম অবস্থায় সাধারণত সিজারিয়ান সেকশন করতে পারি। তবে তার সংখ্যা খুবই কম।

তাই যাঁরা বলেন, সিজারিয়ান সেকশন করার ফলে মায়ের মৃত্যুর হার কমে গেছে সেটা আসলে ঠিক নয়। যদি স্বাভাবিক প্রসব সঠিকভাবে করা হয় সেখানেও মাতৃমৃত্যুর হার কমতে বাধ্য। সেটিও চিকিৎসকের অধীনে একটি মেডিকেল সেন্টারে বিজ্ঞানসম্মতভাবে হতে হবে।