ব্লাড ক্যানসার কেন হয়?

Looks like you've blocked notifications!
ডা. এ বি এম ইউনুস।

‘ব্লাড ক্যানসার’ শব্দটি শুনলে অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে এর উন্নত চিকিৎসা রয়েছে। এর ফলে রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। আজ ১ সেপ্টেম্বর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৩৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দেশের খ্যাতনামা ব্লাড ক্যানসার বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলোজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম ইউনুস।

প্রশ্ন : ব্লাড ক্যানসার মূলত একটা আতঙ্কের নাম। আমাদের যে কারো পরিবারে যখনই কারো ব্লাড ক্যানসার হয়, আমরা খুব আতঙ্কবোধ করি। এ আতঙ্কবোধ করার কারণ কী?urgentPhoto

উত্তর : আসলে ক্যানসার শব্দটি শুনলে সেটা ব্লাডের হোক, ফুসফুসের হোক বা পাকস্থলীর হোক, সবাই আতঙ্কিত হয়। একসময় বিষয়টি এমন ছিল যে ক্যানসারের কোনো অ্যানসার (উত্তর) নাই। ক্যানসার হলে তার আর রক্ষা নাই। নিশ্চিত মৃত্যু। আবার অনেক দিক থেকে ব্লাড ক্যানসার অন্যান্য ক্যানসার থেকে ভয়াবহ। মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা, ব্লাড ক্যানসার হলে আর রক্ষা নাই। এ কারণেই মানুষ আতঙ্কিত হয়। আসলে বিষয়টি এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। ব্লাড ক্যানসার হলেই যে তাকে মরে যেতে হবে, বিষয়টি সেটা নয়। এখন অনেক ভালো ভালো চিকিৎসা বেরিয়েছে। অনেক রোগীকে ভালো করা সম্ভব।

প্রশ্ন : ব্লাড ক্যানসারে একজন মানুষ আক্রান্ত হয় কেন? আমরা জানি, ক্যানসারের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। তবে কিছু ঝুঁকির বিষয় থাকে। ব্লাড ক্যানসারের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়ায় এ রকম কোনো বিষয় আছে কি?

উত্তর : অবশ্যই আছে। ব্লাড ক্যানসার এমনি এমনি হয়ে যাওয়া খুব অস্বাভাবিক। কিছু কিছু বিষয় আছে, যেটা জেনেটিক কারণে হয়, তবে এটা কম। এ ছাড়া পরিবেশগত কারণগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন : সেগুলো কী?

উত্তর : এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কেমিক্যাল। এর পর ভাইরাস, পরিবেশগত রেডিয়েশন। আর আগেই বলেছি জেনেটিক কারণ।

আমরা প্রতিনিয়ত যেসব কেমিক্যালের সম্মুখীন হই, এই কেমিক্যালের মধ্যে কারসিনোজেনিক উপাদান রয়েছে, যেটা দিয়ে ব্লাড ক্যানসার হতে পারে। যেমন : আমাদের ঘরের দ্রব্যাদির কথাই ধরি, এই যে জুতায় পালিশ করছি আমরা সুপলিশ দিয়ে, এর মধ্যে একটা বিদঘুটে গন্ধ আছে খেয়াল করবেন। একটা উৎকট গন্ধ। এর পর যে নেইলপলিশ, রিমুভার, কসমেটিকস, পারফিউমের ভেতরে, অর্থাৎ যেসব কেমিক্যালের মধ্যে অ্যারোমেটিক গন্ধ রয়েছে, সেগুলো কারসিনোজেন। তার পর যারা রঙের প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, আলকাতরার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, পেট্রোলিয়ামজাতীয় প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, এমনকি পেট্রলপাম্পে যারা কাজ করে, তাদের এই সমস্যা হতে পারে। এবং আপনি শুনলে অবাক হবেন, এর ভেতরে কিছু কর্মী যারা নেশাগ্রস্ত হয়ে যায়। যে পেট্রলের গন্ধ না নিলে তাদের ভালো লাগে না। প্রতিদিন গিয়ে এরা ওই গন্ধ না নিয়ে তাদের ভালো লাগে না। সুপার গ্লু বা গামজাতীয় যে জিনিস রয়েছে, যারা এই গাম নিয়ে কাজ করে, তাদের এই সমস্যা হতে পারে। আমি কয়েক দিন আগে দেখলাম, একটা শিশু ওখানে কাজ করে, সে পলিথিনের ব্যাগের ভেতর গাম রেখে ওইটা মুখের ভেতরে নিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে। নেশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। না নিলে তার ভালো লাগছে না। এ ধরনের যত কেমিক্যাল আছে, সেগুলো কারসিনোজেন। এগুলো থেকে ক্যানসার হতে পারে।

আমরা যদি খাবারের দিকে আসি, খাবারে অনেক কিছুই মেলানো হয়, যেগুলো কারসিনোজেন। খাবার সংরক্ষণ করার জন্য যে ফরমালিন দেওয়া হয়, মাছে দেওয়া হয়, ফলে দেওয়া হয়, সবজিতে দেওয়া হয়—এগুলো থেকে ক্যানসার হতে পারে। এই ফরমালিন কীভাবে প্রিজারভ করে? ফরমালিনে ডোবানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রোটিনগুলো ভেতরে ফিক্সড হয়ে গেল। তখন ওই জিনিসটির সহজে আর পচন ধরবে না। আর ওই জিনিস খাওয়ার পর ফরমালিন যখন আমাদের শরীরে যায়, সে ভেতরে গিয়ে একেকটা জিনকে প্যারালাইজড করে দিতে পারে। তার পর আমরা আম পাকার জন্য, কলা পাকার জন্য কার্বাইড ব্যবহার করি। এগুলো থেকে হয়। এর পর আমাদের কৃষিক্ষেত্রে যে ফার্টিলাইজার ব্যবহার করা হচ্ছে, কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে, এগুলো দেহে ক্ষতি করে।

এখন কীভাবে এগুলো ক্ষতি করে? ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। আপনি যদি ফুলকপি খেতে চান, সেটা তো শীতের মৌসুমের একটা সবজি। শীত শুরু হওয়ার আগেই দেখলেন, বাজারে ফুলকপি চলে এসেছে। পরিমাণটা বড় নয়, ছোট ছোট। তবে অনেক দাম। কিন্তু আপনার লোভ হলো এটি নেওয়ার। বা একটা টমেটোর কথাই ধরেন, যেগুলো সময়ের আগে বাজারে এসেছে, সেটার ভেতরে অত্যধিক কেমিক্যাল দেওয়া হয়, ফার্টিলাইজার দেওয়া হয়, ইনসেকটিসাইড দেয়। এর পর পাকানোর ওষুধ কার্বাইড দেওয়া হয়। এভাবে একে জোর করে সময়ের আগে বাজারে নিয়ে আসা হলো বেশি দামের আশায়। এই জিনিসগুলো যদি আমরা খাই, যা একেবারে কেমিক্যালে ভরা, আর কেউ যদি এগুলো বেশি বেশি খেতে থাকে, তাহলে ক্যানসার হতে পারে।

তার পর রেডিয়েশনের কথা ধরেন। যেসব প্রতিষ্ঠানে এক্স-রে, রেডিওথেরাপি ইত্যাদি হয়, সেখানে যদি সুরক্ষার জন্য ডিভাইস ব্যবহার না করা হয়, তাহলে ওখান থেকে ক্যানসার হতে পারে। উন্মুক্ত পরিবেশে যারা কাজ করে, যেমন—সমুদ্রে যারা কাজ করে, সে প্রতিনিয়ত সূর্যের আলোয় কাজ করে। ওখানে লবণাক্ত পানি, সূর্যের আলো সমুদ্রে পড়ে রিফ্লেকশন হয়ে শরীরে চলে আসছে। সমুদ্রসৈকতে বালু, বালুর ভেতরে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে শরীরে আসছে। এসব থেকেও ক্যানসার হতে পারে।

প্রশ্ন : যদি একজন মানুষ ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে যায়, চিকিৎসা করে তার নিরাময়ের সম্ভাবনা কতটুকু?

উত্তর : ব্লাড ক্যানসারে নিরাময় নির্ভর করে এটা কোন ধরনের ব্লাড ক্যানসার, তার ওপর। লিউকেমিয়া আছে, লিম্ফোমা আছে, মাইলোমা আছে। লিউকেমিয়ার আবার ধরন আছে। একিউট লিউকেমিয়া, ক্রনিক লিউকেমিয়া। বিশেষ করে যদি একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া হয়, তাহলে ৮০ শতাংশ রোগীকে কেমোথেরাপি দিয়ে ওষুধের চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো করা যায়। যদি মাইলোয়েড লিউকেমিয়া হয়, তবুও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভালো করা যায়। আর যাদের আমরা ভালো করতে পারলাম না, তাদের জন্য বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা অস্থিমজ্জার সংযোজন করা হয়। মাল্টিপল মায়োলোমার ক্ষেত্রে আসলে এটা বেশি বয়স্ক লোকদের হয়। তাদের ক্ষেত্রে অত বেশি কেমোথেরাপি দেওয়াও যায় না। তবে তাদের চিকিৎসাটা পেলিয়াটিভ। আগে যেখানে এক-দুই বছর বাঁচত, এখন ১০ থেকে ১৫ বছর রোগী ভালোভাবে বেঁচে থাকে। তার পরে তাদের যদি শারীরিক অবস্থা ফিট থাকে, তাহলে তাদের অস্থিমজ্জা সংযোজন সম্ভব। সেটা করলে আবার দীর্ঘদিন থাকে। অর্থাৎ ক্যানসার হলেই যে সে মরে যাবে, বিষয়টি এমন নয়। এ ছাড়া অনেক ধরনের লিম্ফোমা আছে, যেটাকে গ্লান্ড ক্যানসার ধরা হয়। সেটাকে রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি অথবা দুটো একসঙ্গে দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে অনেক ক্যানসারকে ভালো করা সম্ভব। তাই চিকিৎসা দিয়ে এই ক্যানসার ভালো করা সম্ভব। আর যাদের ভালো করা যায় না, তাদের বেঁচে থাকার সময় বাড়ানো যায়। এখন বাংলাদেশে আমরা এই চিকিৎসাগুলো করছি।