সঞ্জীবনী

কম খরচে ক্যানসারের চিকিৎসা বাংলাদেশেই

Looks like you've blocked notifications!

মিরপুর টেকনিক্যাল মোড় পার হয়ে একটু সামনে এগোতেই দেখা যাবে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি হসপিটাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার হোম। কম খরচে ক্যানসারের সার্বিক চিকিৎসা সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এই হাসপাতাল।

ভেতরে ঢুকতে দেখা যায় ৫০০ শয্যার হাসপাতাল তৈরির জন্য নির্মাণাধীন ভবন। তবে বর্তমানে প্রাথমিকভাবে টিনশেড বাড়িতে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। কম খরচে ক্যানসার রোগীদের সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়াই এ হাসপাতালের লক্ষ্য।

শুরুর কথা

এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা হয় জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটের অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. শেখ গোলাম মোস্তফার সঙ্গে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭৮ সালের ৭ এপ্রিল। ক্যানসার সোসাইটির অস্থায়ী অফিস ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজে। পরবর্তীকালে ক্যানসার ইনস্টিটিউটে অফিস করা হয়। তখনো এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ক্যানসার সোসাইটি থেকে কেবল সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। যেমন বিশ্ব ক্যানসার দিবস, তামাক দিবস, ক্যানসার-সংশ্লিষ্ট দিবসগুলো পালন করতাম আমরা। এ ছাড়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক্যানসার জিজ্ঞাসা’ নামে একটি সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো।”

অধ্যাপক মোস্তফা আরো বলেন, ‘ক্যানসার সোসাইটির কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদের চিন্তা হলো কেবল ক্যানসার সচেতনতা নয়, গরিব রোগীদের রোগ নির্ণয় করে সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া যায়, এ রকম কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে।’

ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, ক্যানসার ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক এবং বর্তমানে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি হসপিটাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার হোমের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ হাই বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে ক্যানসারের চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখেছি, ক্যানসারের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘদিন ধরে এই চিকিৎসা নিতে হয়। গ্রাম থেকে আসা রোগী এবং রোগীর আত্মীয়স্বজন থাকার জায়গা পায় না। আর বাংলাদেশে যে সংখ্যক ক্যানসার রোগী রয়েছে, সে তুলনায় হাসপাতালের সংখ্যা কম। এসব ভাবনা থেকেই এই হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠা।’

অধ্যাপক ডা. এম এ হাই বলেন, ‘ক্যানসার সোসাইটি কেবল সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করত। তবে সচেতনতা বৃদ্ধি করলেই হয় না, মানুষকে সেবাও দিতে হয়। সে জন্য একটি হাসপাতাল করার চিন্তা হলো। সেই ভাবনা থেকেই এই হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ।’

ক্যানসার সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. শেখ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘বর্তমান জায়গাটি ২০০৩ সালে ৩০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে অস্থায়ীভাবে পাই। ২০০৫ সালে ৩০ বেডের একটি হাসপাতাল করা হয়। যেহেতু এই লিজের ওপর স্থায়ী স্থাপনা সম্ভব হয় না, তাই পরবর্তীকালে ২০১৪ সালে ৯৯ বছরের জন্য বর্তমান জমিতে লিজ নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় এই জায়গা পাই। বর্তমানে ক্যানসারের সব চিকিৎসাসহ ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণাধীন।’

ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোল্লাহ ওবায়দুল্লাহ বাকী বলেন, ‘এখানে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই সেবামূলক মানসিকতা নিয়ে কাজ করেন। দেশের অনেক ক্যানসার বিশেষজ্ঞ এখানে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এখানে মাত্র ডিউটি ডাক্তার ও নার্সরা বেতন পান। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এখানে বিনা পয়সায় চিকিৎসা প্রদান করেন।’

 

চিকিৎসাসেবা

ডা. শেখ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ক্যানসারের চিকিৎসা মূলত তিনভাবে করা হয়—সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি। সার্জারি ও কেমোথেরাপি এখানে করা হয়। এখনো রেডিওথেরাপির কাজটি করতে পারছি না। রেডিওথেরাপির জন্য রোগীকে ক্যানসার ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়।’

কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে আউটডোরে ৫০ টাকার টিকেট কেটে রোগীদের সেবা নিতে হয়। আউটডোর সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। ইনডোরে বর্তমানে ৩০টি বেড রয়েছে। জেনারেল বেড ভাড়া ২৫০ টাকা। নন-এসি কেবিন ৭০০ টাকা এবং এসি কেবিন এক হাজার ২০০ টাকা। গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়। তবে এ জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হয়।

মো. তাহের উদ্দিন ভূঁইয়া (৬৭) ২০১২ সাল থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন এই হাসপাতালে। বৃহদন্ত্রে ক্যানসার হয়েছে তাঁর। জানালেন, বিনামূল্যে এখানে চিকিৎসাসেবা পাই। সব ধরনের ওষুধ ফ্রি দেওয়া হয়। এখানে অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। চিকিৎসাসেবা বেশ উন্নত। সবাই আন্তরিক।

মো. হাফিজুর রহমান (৫০) ফুসফুসের ক্যানসার নিয়ে এক মাস ধরে ভর্তি আছেন। তিনি জানান, এখানে অন্যান্য হাসপাতালের থেকে খরচ অত্যন্ত কম। আমি ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। সেখান থেকে আমাকে ভালো চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।

 

এগিয়ে চলা

অধ্যাপক ডা. এম এ হাই বলেন, ‘এখনো অনেক সমস্যা রয়েছে। ফান্ডের অভাবে অনেক সময় কাজ করা যায় না। সরকারি কিছু সাহায্য আসে। বেসরকারিভাবেও কিছু পাওয়া যায়। এভাবেই কাজ চলছে। আমরা চাই, এটি বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ মানসম্মত ক্যানসার হাসপাতাল হোক, যেখানে সব ধরনের সার্জারি ও রেডিওথেরাপির সুবিধা থাকবে। পাশাপাশি যেসব মানুষ রোগীর সঙ্গে আসেন, তাঁদেরও থাকার ব্যবস্থা করার একটি পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়।’

ডা. শেখ গোলাম মোস্তফা হাসপাতালের অবস্থা নিয়ে বলেন, ‘বর্তমানে একটি ট্রানজিশন পিরিয়ডে আছি আমরা। ৫০০ বেডের উদ্বোধন করতে যাচ্ছি। অবকাঠামোর কাজ চলছে। আমাদের ইচ্ছা রয়েছে, ক্যানসারের সব ধরনের চিকিৎসার পাশাপাশি ডরমিটরি চালু করার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বছরে প্রায় ৪০ লাখ টাকা দেয়। আউটডোর ও ইনডোর থেকে কিছু টাকা আসে। আউটডোরে প্রতি মাসে প্রায় ৫০০ রোগী দেখা হয়। আমাদের ওয়েলফেয়ার ফান্ড রয়েছে। সেখান থেকে গরিব রোগীদের চিকিৎসা করা হয়। এ ছাড়া বিল্ডিং ডেভেলপমেন্ট ফান্ড রয়েছে। এসব থেকে হাসপাতালটির বর্তমান কার্যক্রম চলেছে।’

ডা. শেখ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি, রোগীদের সবচেয়ে কম খরচে সব সুবিধা দিয়ে ক্যানসারের চিকিৎসা করার। মানুষের জন্যই কাজ করতে চাই আমরা। সবার সাহায্য-সহযোগিতায় হাসপাতালের ভবনটি পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারলে আমরা আশা করছি, এটি বাংলাদেশের একটি মানসম্মত ক্যানসার হাসপাতাল হবে।’

 

ঠিকানা

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি হাসপিটাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার হোম

১২০/৩-সি, দারুস সালাম (টেকনিক্যাল মোড়) মিরপুর, ঢাকা-১২১৬, ফোন : ৯০২৫৫০৪

মোবাইল : ০১৭৬৩৬৭৮৮৭০, ফ্যাক্স-৯০২৬০৯৩

ওয়েবসাইট : www.bcs.bd.org