কান পাকা রোগের চিকিৎসা কী?
কান পাকা একটি অস্বস্তিকর সমস্যা। কান পাকা রোগের চিকিৎসার বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩১২৭তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. ফুয়াদ মোহাম্মদ শহীদ হোসেন। বর্তমানে তিনি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইএনটি ও হেড- নেক সার্জারি বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : কান পাকা রোগটা কখন বলব?
উত্তর : আসলে কান পাকা রোগটা কোন বয়সে হতে পারে? এবং কোথায় গিয়ে শেষ হতে পারে? সেই সম্পর্কে আমাদের একটি সম্মক ধারণা থাকা উচিত।
মজার বিষয় হলো কান পাকা রোগ, শিশুদের থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু এটি হওয়ার পেছনে যে কারণ, সেটি শৈশবকাল থেকে খোঁজা উচিত।
ছোট বাচ্চার কথা চিন্তা করি। একদমই নতুন কান নিয়ে সে এসেছে। তো তার কান দিয়ে কেন পানি আসবে? দেখা যায় ভুল পদ্ধতিতে কারণে বাচ্চাদের কান দিয়ে পানি আসে। বাচ্চাদের যে শুয়ে শুয়ে খাওয়ানো হয়, আমাদের যে ইসটিটিউশন টিউব রয়েছে,এটি কিন্তু ফ্যারিংসে যায়। দেখা যায় খাওয়ার পর এই দিক দিয়ে দুধ বা অন্য খাবার যদি ঢুকে যায়, তার কিন্তু আর এই দিকে ফেরত আসার রাস্তা নেই। তখন তার রাস্তা কানের দিকে। তখন সে কী করে? এই শিশু বাচ্চার কানের পর্দাকে সংক্রমিত করে, ওখান দিয়ে ফুঁটো করে দেখা যায় যে এই ফ্লুইডটা বের হয়ে আসার চেষ্টা করে। এটা হলো একদমই প্রাথমিক, কান পাকা রোগের সঙ্গে তার শুরুটা। এটা কিন্তু ভালো হয়ে যায়। যদি শুধু মা কে আমরা একটু কানের ড্রপ দিয়ে দেই, আর কিছু মুখে খাওয়ার ওষুধ দিয়ে দেই, বলি যে আপনি বাচ্চাকে একদম শুইয়ে খাওয়াবেন না। এমনকি মধ্য রাতেও যদি বাচ্চা উঠে খাওয়ার জন্য কান্না করে, অন্তত যেন মাথার নিচে একটু বালিশ দিয়ে এঙ্গেল করা হয়। কারণ, আমরা জানি, তরলের প্রবণতা হলো নিচের দিকে যাওয়া। যখনই উঁচু করা হয়, সেটি টিউবের ভেতর আর ঢুকে না।
এরপর যখন বাচ্চাটা একটু বড় হয়,ধরুন, তিন বছর অতিক্রম করল,তখন আবার এডিনয়েড বলে একটা জিনিস, নাকের পেছনে নেজোফেরিংসে সে বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। এই এডিনয়েড যদি দৃষ্টি গোচর না হয়, বাবা-মা যদি খেয়াল না করে, তাহলে দেখা যায় এই এডিনয়েড ফ্যারিংজাল ওপেনিংকে বন্ধ করে দেয়। তখন ইউসটেশিয়ান টিউবটা পরিপূর্ণভাবে কাজ করতে পারে না। তখন প্রথম দেখা যায় সেখানে কানের পর্দার পেছনে পানি জমে। সেই পানি জমার কারণে দেখা যায় বাচ্চারা একটু কম শুনতে শুরু করে। কানটা বন্ধ বন্ধ লাগে। যদি ভালোভাবে চিকিৎসা না হয়, যদি নাক- কান- গলা বিশেষজ্ঞের কাছে না যায়, অথবা গেলেও উনি যে পরামর্শটা দিল, সেটা তারা নিল না। একটা সময় দেখা যাবে তীব্র প্রদাহ, সেটা হলো। তারপরও চিকিৎসা হয়তো পুরোপুরি করা হলো না, সেটা কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি হবে। এরপর কানটা আর ভালো হলো না। তখন কী হয়? গ্রামে দেখবেন যতবার বন্যা হবে, ততবার পুকুর কানায় কানায় ভরে যায়। তো ক্রনিক সাপোরেটিভ ওটাইটিস মিডিয়ার সমস্যা হলে কী হয়, যতবারই ঠান্ডা লাগে, আপার রেসপিরেটোরি ট্র্যাক্টে যখন ইনফেকশন হয়, সেখানে যখন নিঃসরণ বাড়ে,ত খন কান দিয়ে পানি আসা শুরু করে। এটা একটি বিব্রতকর অবস্থা। একটি মানুষ কোথাও গেল, তার কান দিয়ে পানি পড়ছে, বার বার তার হাত দিতে হচ্ছে, অনেকে তুলো দিয়ে রাখে। কিন্তু তুলো দিয়ে রেখে তো এর নিরাময় হয় না। কারণ, মূল সমস্যাটা যে জায়গায় সেটা যদি বের না করি, তাহলে এটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না। এরপরে দেখেন যদি মধ্য পর্যায়ে কারো নাকের হাড় বাঁকা থাকে, কারো যদি সাইনোসাইটিস থাকে, সেটার চিকিৎসা ঠিক মতো না করে, তা থেকেও কিন্তু কান পাকা রোগ হতে পারে। তার নাকের হাড় ঠিক না করা হয়, তার সাইনোসাইটিসের চিকিৎসা যদি সঠিকভাবে না করা হয়, এটা কিন্তু বার বার করেই হবে। এই যে কান পাকা রোগ নিয়ে সে চলছে, তখন যদি কানের পর্দা ঠিক করা না হয়, এবং তার যে কারণে কান পাকা রোগটা হচ্ছে, সেই কারণকে যদি আপনি সরিয়ে না দেন, তাহলে এটি তাকে বার বারই কষ্ট দেবে। সে কিন্তু কিছুটা শ্রুতি বধিরতাতেও ভুগবে। এই ধরনের রোগীরা কিন্তু ছোট ছোট কথাগুলো শুনতে পায় না। কারণ, তারা একটি পর্যায় পর্যন্ত শ্রুতি বধির হয়ে থাকে। এটা গেল কান পাকা রোগের একটি সরল স্বাভাবিক গল্প। এটিই বেশি প্রচলিত। কিন্তু কান পাকা রোগের আরেকটি ধরন রয়েছে। যেটা খুব ভয়ঙ্কর। তবে এখন ওই ধরনটা আমাদের দেশে কম। আন সেফ ভেরাটিতে ক্রনিক সাপোরটিভ ওটাইটিস মিডিয়ার যে কান পাকা রোগ, সেটি কিন্তু অন্যরকম। সেখানে কিন্তু রোগীর নিঃসরণটা কম থাকে। সেখানে খুব দুর্গন্ধময় নিঃসরণ থাকে। আমরা সেখানে একটি জিনিসের অস্তিত্ব পাই, পলিস্টিয়েটোমা। পলিস্টিয়েটোমা এত গুরুত্বপূর্ণ, নাক- কান- গলা বিশেষজ্ঞের কাছে, এটা যদি কেউ পরীক্ষায় না পারে, তাকে কিন্তু পাশ করানো হয় না। তার কারণ হলো এই পলিস্টিয়েটোমা হাড়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্ষতিগ্রস্ত করে মধ্যকর্ণের যে প্রদাহ, একে বাড়িয়ে মস্তিষ্কে এটি ছড়িয়ে দেয়। এ থেকে জটিলতা হয়ে রোগী মারা পর্যন্ত যেতে পারে। এমনকি আগে অনেক রোগী মারা যেত এই জটিলতাতে। এই ক্ষেত্রেও রোগী কান পাকা রোগ নিয়ে যাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে। আমরা নাক কান গলা বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখি, সেইফ ভ্যারেইটি যেই জায়গায় হয়, আনসেইফ ভ্যারাইটি সেই জায়গায় হয় না। তো এই জায়গাটা বের করে আমরা কিন্তু তাকে পরামর্শ দিই। এখানে একটি কথা ভালোভাবে বলা দরকার, চিকিৎসকের কাছে আসলেই, চিকিৎসক যে পরামর্শ দেয়, রোগীরা কিন্তু সব ক্ষেত্রে সেটি শোনে না। যদি সেখানে কোনো অস্ত্রোপচারের বিষয় থাকে, সেটাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যা যা দরকার, তার সব কিছুই করা হয়। কিন্তু একটি কথা স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, যাদের এই আনসেইফ ভ্যারাইটির কান পাকা রোগ থাকবে বা পলিস্টিয়েটোমার উপস্থিতি থাকবে বলে, চিকিৎসক সন্দেহ করছেন, তাদের কিন্তু অস্ত্রোপচার করাটা বাধ্যতামূলক। তাকে আমি যদি ছেড়ে দেই, তাকে আমি যদি বোঝাতে না পারি, সেটি কিন্তু ব্যর্থতা ও অভিশাপের মতো হবে মানুষটার জন্য। কারণ, এই কানপাকা রোগ, তাকে দীর্ঘমেয়াদে এমন জটিলতার দিকে নিয়ে যাবে, যেটি খুব কঠিন। সেটি কেবল শ্রুতি বধিরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্ষেত্রে রোগীকে যেকোনোভাবেই হোক, আমাদের বোঝাতে হবে যে আপনি এই রোগটি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন না।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন, অনেক কারণে কান পাকা রোগ হতে পারে। এর চিকিৎসা আপনারা কীভাবে করে থাকেন?
উত্তর : যে বাচ্চার এডিনয়েড খুব বড়, দেখা যায়, এডিনয়েডের কারণে তার কান বারবার করে সংক্রমণ হচ্ছে,স্কুলের পারফমেন্স তার খারাপ হয়ে যাচ্ছে, অনেক সময় দেখা যায় তারা শব্দ বাড়িয়ে টিভি দেখে। তাকে যখন ভলিউম কমাতে বলা হয়, সে কিন্তু এটাতে পাত্তা দেয় না। সেই ক্ষেত্রে এডিনয়েড বের না করলে তার কিন্তু কানটা ভালো হবে না। মধ্য পর্যায়ে যদি আসি, খুব প্রচলিত যেটি, নাকের হাড় বাঁকা। আমরা যারা নাক- কান গলার চিকিৎসা করি তাদেরও নাকের হাড় বাঁকা। কারো যদি উপসর্গ থাকে, নাক বাঁকার কারণে দেখা যায় প্রায়ই তার সাইনোসাইটিস হচ্ছে, তার কানে প্রদাহ হচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে তার কান পাকার চিকিৎসার অংশ হিসেবে নাকের হাড় সোজা করে নিতে হবে। যদি কারো কানের অস্ত্রোপচার করেও দেওয়া হয়,তার নাককে ঠিক না করে, তাহলে সমস্যা রয়ে যাবে।