দুই পরীক্ষায় জানুন কিডনি রোগ হয়েছে কি না

Looks like you've blocked notifications!
কিডনি রোগ নিয়ে আলোচনা করছেন অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ।

কিডনি রোগ বেশ জটিল। তবে এই জটিল রোগ প্রতিরোধ করা যায় কেবল দুটো পরীক্ষার মাধ্যমে। আর সেগুলো হলো রক্তের ক্রিয়েটিনিন ও প্রস্রাবে অ্যালবুমিন পরীক্ষা।

কিডনি রোগ প্রতিরোধ, কিডনি রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা, কাদের এই পরীক্ষা করতে হবে—এসব বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩১৯৮তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ। বর্তমানে তিনি বিআরবি হাসপাতালের কিডনি রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।

প্রশ্ন : কিডনি রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আসলে কী করণীয়?

উত্তর : কিডনি রোগ ভয়াবহ। ভয়াবহ বললে তো সবাই ভয় পেয়ে যায়। তবু বলি, এটা ভয়াবহই। কেন ভয়াবহ? এটা খুব প্রচলিত। আমাদের দেশে তাকালে দেখব, দুই কোটির বেশি লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। ঘণ্টায় পাঁচজন মারা যায় কিডনি বিকল হয়ে। আর প্রতিবছর চল্লিশ হাজারের বেশি রোগীর কিডনি বিকল হয়ে মারা যায়।

আবার যদি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের কথা বলি, এটি কিন্তু ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। আমরা বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখেছি, বাংলাদেশে ১৬ থেকে ১৮ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ রয়েছে। এগুলো সুপ্ত, ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে।

রোগটি কতটা তীব্র, সে অনুযায়ী পাঁচটা ভাগে ভাগ করা হয়। এক, দুই, তিন, চার পর্যায়ে লক্ষণগুলো বোঝাই যায় না। কিডনি রোগের কারণে সে কিন্তু মারা যাচ্ছে না। তবে এর কারণে অন্যান্য রোগের আক্রমণ সাধারণের চেয়ে ২৯ গুণ বেশি হতে পারে। কাজেই যত রোগী কিডনি ফেইলিউর হয়ে মারা যাচ্ছে, এর চেয়ে অনেক বেশি মারা যায় হার্ট ফেইলিউর হয়ে। এ জাতীয় সমস্যা থেকে অন্য জটিলতা বেশি হয়। এই জন্য একে বলা হয় ‘ডিজিস মাল্টিপ্লায়ার’।

এবার বলছি কীভাবে চিনব রোগটিকে? যেহেতু লক্ষণ প্রকাশ পায় না, তাই বোঝা খুব কঠিন। কিন্তু আমরা যদি দেখি যারা খুব ঝুঁকিতে রয়েছে, তারা যদি মাত্র দুটো পরীক্ষা করে, তাহলে রোগ ধরতে পারবে। একটি হলো রক্তের ক্রিয়েটিনিন। এতে বের করা যায় ১০০ ভাগের মধ্যে কিডনি কত ভাগ কাজ করছে। আরেকটি হলো প্রস্রাবে কোনো অ্যালবুমিন যাচ্ছে কি না। এই দুটো পরীক্ষা করলেই ৯০ ভাগের বেশি ক্ষেত্রে কিডনি রোগ রয়েছে কি না, সেটা বোঝা যায়। যে কেউ এই পরীক্ষা করতে পারে।

যাদের অবশ্যই করতে হবে, তাদের বছরে অন্তত দুবার করা উচিত। কাদের করতে হবে? তারা হলো, যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, যাদের কখনো শরীর-মুখ ফুলে গিয়েছে, যাদের ওজন বেশি, যারা ধূমপান করে, যারা ব্যথার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছে, তীব্র অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছে, কারো যদি জন্মগত ত্রুটি থাকে অথবা যদি প্রস্রাবে বাধা থাকে। যেমন : যারা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, তারা পঞ্চাশের ওপর গেলে কিন্তু প্রোস্টেট বড় হয়ে যায়, কারো যদি ঘন ঘন প্রস্রাবে সংক্রমণ হয়ে থাকে অথবা পাথর হয়ে থাকে, সবাই কিন্তু এই কিডনি রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া যাদের বয়স চল্লিশের ওপর, সবারই বছরে অন্তত দুটো করে পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। তাহলে প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগ ধরা পড়বে। প্রাথমিক অবস্থায় এটি শনাক্ত করা যেতে পারে। আসলে ভয়াবহ বললে সবাই ভয় পেয়ে যাচ্ছে।

পাশাপাশি আরেকটি সুসংবাদ রয়েছে। আমরা একটু সচেতন হলে পঞ্চাশ থেকে ষাট ভাগ ক্ষেত্রে এই ভয়াবহ কিডনি বিকল প্রতিরোধ করতে পারি। কিন্তু যখন বিকল হয়ে যায়, এর চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল হয় যে শতকরা ১০ ভাগ রোগীও এর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন না। 

তাহলে প্রতিরোধের উপায়গুলো কী? লাইফস্টাইল বা আমাদের যে জীবনধারা রয়েছে, সেই জীবনধারার কিছু যদি পরিবর্তন করলে এটি প্রতিরোধ করা যায়।

দেখা যায়, তিন কিলোমিটার, দুই কিলোমিটার দূরে অফিস হলেও আমরা গাড়িতে করে যাই। আমরা গাড়িতে না উঠে হেঁটে গেলে, অর্থাৎ আমরা কাজ করলে, আমরা হাঁটলে, ব্যায়াম করলে, দেখা যাবে, রোগ প্রতিরোধ করা যায়। অনেকগুলো বিষয় রয়েছে, যে কারণে কিডনি রোগ বেড়ে যায়। যেমন : উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এগুলো কিন্তু কমে যাবে।  কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায়। কিডনি রোগের পাশাপাশি আরো কিছু রোগ থেকে রেহাই পেতে পারে এই জীবনধারা মেনে চললে।

ব্যায়াম করতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো খাবার। খাবারের মধ্যে যেগুলো অবশ্যই থাকতে হবে, সেগুলো হলো, শাকসবজি এবং কিছু ফল। সেইসঙ্গে মাছ-মাংস থাকবে পরিমিতভাবে। শর্করা জাতীয় খাবার ভাত, রুটি যেগুলো খাই, সেগুলো থাকবে। তবে চর্বিজাতীয় খাবারের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যেগুলোতে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল থাকে, ফাস্টফুড এড়িয়ে যেতে হবে। গরু, খাসির মাংস যেগুলো তেলযুক্ত রয়েছে, সেগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। ঘি থেকে রান্না করা খাবার, ডিমের কুসুম, দুধের সর এগুলোতে কোলেস্টেরল বেশি থাকে। এগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। তবে যেগুলো ভেষজ তেল, সেগুলো খেতে পারি। মাছের তেল আমরা খেতে পারি। এরপর যেটি আসে, সেটি হলো ধূমপান। ধূমপান কেবল ক্যানসারই করে না, এটি সরাসরি কিডনিকে নষ্ট করে।

এরপর যেটি আসে, সেটি হলো স্থূলতা। স্থূলতা যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী, তেমনি এ থেকে ক্যানসারও হতে পারে; হাড়গুলো ক্ষয় হয়ে যায় এবং এটি সরাসরি কিডনির ছাঁকনি নষ্ট করে দেয়। কাজেই আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আমরা ব্যথার ওষুধ যত্রতত্র খাব না। এগুলো যদি আমরা এড়িয়ে চলতে পারি, তাহলে ভালো থাকতে পারি।

জন্মগত কিছু কিডনি রোগ হয়। বাচ্চাদের জন্মের পরপর পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত জন্মগত ত্রুটি রয়েছে কি না। একটু আলট্রাসনোগ্রাম করলে এগুলো বোঝা যায়।

আমাদের এই কয়েক দিনের কাজই হলো এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, হাসপাতালে, বাইরে, মিডিয়ায় সব জায়গায় আমরা কাজ করে মানুষকে জানাতে চাইছি। দ্বিতীয়ত, যেই পরীক্ষাগুলো ব্যয়বহুল, সেগুলো দরিদ্রদের জন্য স্বল্পমূল্যে বিআরবি হাসপাতাল করে দিচ্ছে। কিডনি রোগ থাকলে তাদের বিনা পয়সার চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করছে।