গর্ভাবস্থায় সংক্রমণ ও এর প্রতিকার
ইনফেকশন বা সংক্রমণ সবার বেলাতেই হতে পারে। তবে একজন গর্ভবতী মায়ের বেলায় সংক্রমণ হলে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ একজন গর্ভবতী মায়ের সংক্রমণ হলে তার নিজের যেমন ক্ষতি হতে পারে, তেমনি তার সন্তানেরও ক্ষতি হতে পারে। আজ ২২ সেপ্টেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৫৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল।
প্রশ্ন : গর্ভবতী মায়েরা সাধারণত কী কী ধরনের সংক্রমণে আক্রান্ত হন, যেটা তাঁর এবং সন্তানের ক্ষতি করতে পারে?
উত্তর : একজন নারী যখন গর্ভবতী হন তখন তাঁর দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সবচেয়ে দুর্বল থাকে। এই জন্য এই সময়ে একজন নারী যেকোনো ধরনের সংক্রমণে ভুগতে পারে। আমরা সাধারণত যে সংক্রমণগুলো দেখে থাকি এগুলোর মধ্যে সাধারণ সর্দি-কাশিতো হয়েই থাকে। এ ছাড়া বিশেষ কিছু সংক্রমণ হয়ে থাকে। যেমন প্রস্রাবে সংক্রমণ। এই সমস্যার কথা প্রায়ই একজন গর্ভবতী মা বলে থাকেন। তা ছাড়া বাইরের খাবার খেয়ে আমাদের ফুড পয়জনিং হয়, ডায়ারিয়া হয়, বমি হয়। আরো কিছু সংক্রমণ আছে যেগুলোকে আমরা বলি ভাইরাল ইনফেকশন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রুবেলা ইনফেকশন। যেটি এখন মোটামুটি সবাই জেনে গেছে এবং সরকারও এখন টিকা দিয়ে সবাইকে সচেতন করছে। আরেকটি হলো, এখনকার পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু বা ভাইরাল জ্বর বলে থাকি। সেটা এখন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসব সংক্রমণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে একজন গর্ভবতী মা। কারণ তার গায়ে সংক্রমণ হলে তার যেমন সমস্যা হতে পারে তেমনি অনাগত শিশুরও ক্ষতি হতে পারে। আবার শিশুর ক্ষতি না হলেও দীর্ঘ মেয়াদি এক ধরনের ক্ষতি হতে পারে।urgentPhoto
প্রশ্ন : এসবের বাইরেও যদি আগে থেকে কোনো মা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত থাকেন। যদি মেলেরিয়া বা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন এবং যদি দীর্ঘ মেয়াদি ওষুধ খেতে হয়, সেটিও কী বাচ্চার ক্ষতি করে? তখন কী করবেন তাঁরা?
উত্তর : অবশ্যই সমস্যা হবে। যদি কোনো মা আগে থেকে টিবি রোগে আক্রান্ত হন, তিনি যদি ওষুধ খেতে থাকেন এবং তিনি ওষুধ যদি বন্ধ করে দেন তাহলে তাঁর বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। যদি কোনো মায়ের গর্ভাবস্থায় মেলেরিয়া হয়, টাইফয়েড হয়, তিনি যদি চিকিৎসা না নেন তাহলে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে।
যেমন ধরুন রুবেলা ইনফেকশন যদি কোনো মায়ের গর্ভাবস্থায় হয়ে থাকে তাহলে কী হতে পারে? রুবেলা ইনফেকশন যদি প্রথম তিন মাসের মধ্যে কোনো গর্ভবতী মায়ের হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে তাঁর বাচ্চার। এখন সে বাচ্চার কী হতে পারে? সে বাচ্চার গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে। বাচ্চা গর্ভাবস্থায় মারা যেতে পারে। অথবা বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি হতে পারে। জন্মগত ত্রুটিগুলো খুবই ভয়ঙ্কর। যেগুলো পরবর্তীকালে ঠিক করা মোটেই সম্ভব নয়। যেমন বাচ্চা জন্মগতভাবে চোখে দেখতে না পারে, কানে শুনতে না পারে, তার মস্তিস্কে সমস্যা হতে পারে। এমনকি সে যখন পূর্ণবয়স্ক হবে তার স্বাভাবিক বুদ্ধি কমে যেতে পারে এবং অটিজমের মতো রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এই সমস্যাগুলো হতে পারে যদি রুবেলা ইনফেকশ গর্ভাবস্থায় কারো হয়ে থাকে। সন্তানের শুধু গর্ভজাত অবস্থাতেই ক্ষতি হচ্ছে না। এটা তাকে সারাজীবন বহন করতে হচ্ছে।
আরো একটা সংক্রমণ হয়ে থাকে, যাকে আমরা বলি টক্সোপ্লাজমা। যেটা সাধারণত পোষা প্রাণী যেমন বিড়াল, এদের গায়ের থেকে মায়ের গায়ে আসতে পারে। সেই সংক্রমণ হলে দেখা যায় যে একটা বাচ্চা যখন জন্মগ্রহণ করার জন্য পূর্ণ বয়স্ক হচ্ছে তখন সে স্কিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ রকম দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিও হতে পারে।
প্রশ্ন : টাইফয়েড বা ডেঙ্গু এধরনের জ্বর হলে মায়ের এবং সন্তানের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে?
উত্তর : গর্ভবতী মায়েদের ডেঙ্গু হলে আমরা বেশি আতঙ্ক হই। এ জন্য আমরা সবচেয়ে ভয় পাই ডেঙ্গু যদি একজন গর্ভবতী মাকে আক্রান্ত করে। কারণ ডেঙ্গু হলে জ্বর অত্যন্ত বেড়ে যায়। মায়ের শরীরে যখন জ্বর বেশি হয়, বাচ্চাতো মায়ের পেটের ভেতর আছে তার জ্বর আরো বাড়ে। এর ফলে মায়ের যেমন হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। তেমনি শিশুটিরও হৃদপিণ্ডের গতি অনেক বেড়ে যায়। আর জ্বরের কারণে মায়ের শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এর কারণে কী হয়? মায়ের গায়ের থেকে বাচ্চার গায়ের ভেতর যে রক্ত চলাচলা হয় সেটি ব্যহত হয়।
আরো একটি ঘটনা ঘটে সেটি হলো জ্বর হয়ে আমাদের শরীরে যখন তাপমাত্রা বাড়ে তখন শরীরে শিরা উপশিরাগুলো প্রসারিত হয়। প্রসারিত হওয়ার কারণে শিশুর দেহে মায়ের শরীর থেকে রক্ত চলাচল ব্যহত হয়ে যায়। এতে মায়ের গর্ভে বাচ্চার মৃত্যু হতে পারে। এরপর সঠিক পুষ্টি না পাওয়ার কারণে বাচ্চার কম ওজন হতে পারে। সময়ের আগেই প্রসব বেদনা হতে পারে। জন্মের পরও বাচ্চা মারা যেতে পারে। এসব জটিলতা হতে পারে বাচ্চার ও মায়ের।
আর এর বাইরেও কিছু কথা রয়েছে, যদি ডেঙ্গু জ্বর কোনো মাকে আক্রমণ করে, তাহলে তাঁর যেকোনো জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ার মধ্যে যে অনুচক্রিকা জড়িত সেটি কমে যেতে পারে। তখন সেই মায়ের যদি কোনো কারণে প্রসবকালীন ডেঙ্গু ধরা পড়ে কিংবা অস্ত্রোপচার পরবর্তী সময়ে ধরা পড়ে তাহলে তাঁর প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং সেই মাও মারা যেতে পারেন। তা ছাড়া এ সময় যে মায়ের শরীরে রক্ত সঞ্চালন হবে, সেটিও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন : লক্ষ্মণ প্রকাশ পেলে গর্ভবতী মা চিকিৎসকের কাছে যান এবং আপনারা তাকে ঝুঁকিমুক্ত করেন। তবে সবসময় লক্ষ্মণ প্রকাশ পায় না। যেমন প্রস্রাবের ইনফেকশন। তাই এ মায়েদের জন্য নিয়মিত চেকআপের বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : যেসব সংক্রমণে সাধারণত লক্ষ্মণ প্রকাশ পায় সেগুলো নিয়ে মায়েরা নিজেরাই আমাদের কাছে আসে। আর কিছু সংক্রমণ আছে, যেমন প্রস্রাবের এতে লক্ষ্মণ না প্রকাশ পেতে পারে। মায়ের গায়ে জ্বর না থাকতে পারে। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া না থাকতে পারে। তারপরও আমরা মাঝে মাঝে প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখে থাকি, যে লক্ষণ ছাড়া সংক্রমণ মায়ের শরীরে আছে কি না। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন আমার তো কোনো লক্ষ্মণ নেই, তাহলে আমি কেন চিকিৎসা নেব? আসলে লক্ষ্মণ ছাড়া প্রস্রাবে ইনফেকশন হতে পারে। আর গর্ভাবস্থায় এর চিকিৎসার প্রয়োজন আছে।
এই প্রস্রাবে ইনফেকশন যদি লক্ষ্মণ ছাড়া থেকে যায় এবং তার যদি চিকিৎসা করা না হয় তাহলে মায়ের শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। মায়ের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে এবং বাচ্চার ওজন কম হয়ে যেতে পারে। বাচ্চা সময়ের আগেই প্রসব হতে পারে। মায়ের শরীরে পানি ভেঙে যাওয়ার সমস্যাটিও এর কারণে হতে পারে।
প্রশ্ন : এই ধরনের সংক্রমণে যেন আক্রান্ত না হন এজন্য কোনো সচেতনতামূলক বিষয় আছে কী? আপনার পরামর্শ কী এ বিষয়ে?
উত্তর : মাকে মনে করতে হবে অন্য সময় তার যে চলাফেরা, জীবন যাপন সেখানে তাঁকে একটু বাড়তি সাবধান থাকতে হবে। কারণ আমি আগেই বলেছি এ সময় মায়ের শরীরে সংক্রমণ খুব বেশি হতে পারে। এজন্য যেখানে সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে সেখানে যেতে সতর্ক হবে। যেমন হাসপাতাল, হাসপাতালে সবাই রোগ নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে গর্ভাবস্থায় সে যাবে না। কিংবা কারো জ্বর হয়েছে এমন যদি শোনে তাকে সাধারণত দেখতে যাওয়া ঠিক না। কিংবা অনেক ভিড় যেখানে বা যেখানে অনেক লোকের জনসমাগম হয় সেখানে অনেক লোকের সংক্রমণ রয়েছে, সেটা সেই মায়ের গায়ে চলে আসতে পারে। সেজন্য মাকে সাবধানে থাকতে হবে। আর তাঁর ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখবে। এ ছাড়া সামান্য লক্ষ্মণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবে। এ ছাড়া মাকে বলি আপনি যখন বাইরে যাবেন, বাইরের খাবার খাবেন না। বিশেষ করে যে খাবারগুলোতে পানি ব্যবহার করা হয়। সেখান থেকে পানিবাহিত রোগ চলে আসতে পারে। এ থেকে মায়ের ডায়রিয়া হতে পারে। কিছু কিছু বিষয় যদি মা একটু খেয়াল রাখেন, সচেতন থাকেন, সাবধান থাকেন তাহলে গর্ভাবস্থায় মায়ের যে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো আছে সেগুলো এড়িয়ে চলতে পারেন। শেষ পর্যন্ত সুস্থ বাচ্চা জন্ম হতে পারে এবং মা সুস্থ থাকতে পারেন।