শিশুদের জ্বর হলে প্রচুর পানি খাওয়ান

বিভিন্ন কারণে শিশুদের জ্বর হয়। জ্বর হলে উদ্বিগ্ন না হয়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সঠিক চিকিৎসা নিন। আজ ২৩ সেপ্টেম্বর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৬০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. তামান্না বেগম।
প্রশ্ন : শিশুদের জ্বর বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : আসলে জ্বর একটি উপসর্গ। যেকোনো অসুখের একটা উপসর্গ হলো জ্বর। প্রথমে মায়েদের বুঝতে হবে, জ্বর কখন আমরা বলব। আমাদের শরীরের তাপমাত্রা যখন ৯৮.৫-এর ওপরে যাবে, তখন সেটাকে আমরা জ্বর বলে বিবেচনা করব। অনেক মা আছেন কপালে হাত দিয়ে বলছেন, গা পুড়ে যাচ্ছে, অনেক জ্বর। জ্বর কেবল কপালে থাকবে না। সারা শরীরে থাকবে। আমাদের হাত দিয়ে জ্বর মাপার প্রবণতা দেখা যায়। আসলে জ্বর হলে মায়েদের উচিত থার্মোমিটার দিয়ে মেপে সেটাকে রেকর্ড করা। সেটা যদি ৯৯ বা ১০০ থাকে, তাহলে বুঝতে হবে জ্বরটা খুব বেশি নয়। একশর ওপরে থাকলে জ্বর অন্তত তিনবার মাপতে হবে। কারণ, এই জ্বরটা স্বাভাবিক জ্বর নয়। মেপে দেখতে হবে, জ্বরটা কোন দিকে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : এই তিনবার বলতে আপনি আসলে কতক্ষণ পরপর বোঝাচ্ছেন?
উত্তর : আমরা বলি, তাপমাত্রার চার্ট মেনে চলতে হবে। ছয় ঘণ্টা অথবা আট ঘণ্টা পরপর মাপতে হবে। এটি করলে ভালো হয়। এর ফলে তাপমাত্রা কখন ওঠে, কখন নামে এটি আমরা বুঝতে পারি। এটি দেখে আমরা অনেক রোগও নির্ণয় করতে পারি। কারণ, একেকটি জ্বরের একেক ধরনের অবস্থা এবং তাপমাত্রা থাকে। সে জন্য মায়েরা যেন খেয়াল রাখেন, হাত দিয়ে জ্বর না মেপে যেন থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখেন। যেন চিকিৎসকের কাছে গেলে জ্বর সম্বন্ধে সঠিকভাবে বলতে পারেন।urgentPhoto
প্রশ্ন : সাধারণত কোন কোন কারণে শিশুরা জ্বরে আক্রান্ত হয়?
উত্তর : সাধারণত এটিকে বয়স অনুযায়ী ভাগ করে থাকি। যে বাচ্চাটা নতুন হলো, এক মাস বয়স তার অন্য রকম জ্বর, আবার যে বাচ্চাটা স্কুলে যাওয়ার আগের বয়সে তার এক রকম, একটু বড় বাচ্চাদের এক রকম। অল্প দিনের জ্বর হলে একে আমরা ভাইরাল জ্বর বলি। একটু ঠান্ডা, কাশি লেগে হয়তো জ্বর হলো। মাকে আশ্বস্ত করতে হবে, এটা ভাইরাল জ্বর। জ্বরটা মেপে রাখেন। যদি দীর্ঘমেয়াদি না হয়, তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই। জ্বর এমনিতেই কমে যাবে। জ্বর একশর ওপর হলে জ্বর কমানোর ওষুধ খাইয়ে দেবেন।
আর কিছু ঘরোয়া যত্নের কথা বলি। যেমন : বাচ্চাকে পানি বেশি করে খাওয়াবেন। বাচ্চার প্রস্রাব হচ্ছে কি না, খেয়াল করবেন। বাচ্চা খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছে কি না, খেয়াল করবেন। কারণ, শিশুরা জ্বরের এই সময়টায় অনেক সময় খেতে চায় না, অনীহা করে। তাই মাকে পরামর্শ দিয়ে বলতে হবে, এই বিষয়গুলো খেয়াল করবেন। জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে আর কোনো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে কি না। যেমন : র্যাশ হচ্ছে কি না, খিঁচুনি হচ্ছে কি না, এর সঙ্গে গেরোয় ব্যথা আছে কি না, প্রস্রাবে জ্বালা-যন্ত্রণা আছে কি না—এই জিসিসগুলো মায়েরা একটু লিখে রাখবেন। তাহলে পরবর্তীকালে জ্বরের ধরন বুঝতে সুবিধা হবে।
প্রশ্ন : একটা বিষয় আমরা দেখি, জ্বর হলে মায়েরা খুব দ্রুত শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান এবং একটা অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শুরু করে দেন...
উত্তর : হ্যাঁ, এটা আপনি খুব ভালো কথা বলেছেন। আমাদের মায়েদের ধারণা, অ্যান্টিবায়োটিক দিলেই হয়তো জ্বর কমে যাবে। তবে মায়েদের আশ্বস্ত করতে হবে, জ্বর একটি উপসর্গ। এটা যেকোনো সমস্যার জন্যই হতে পারে। তাহলে কী কারণে অ্যান্টিবায়োটিক দেব, সেটা নির্ণয় না করে দেওয়া ঠিক নয়। অনেক সময় মায়েরা চিকিৎসকদের বলেন, ডাক্তার সাহেব একটা অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেন, না হলে তো জ্বর কমছে না। আবার দেখবেন, ওই চিকিৎসক যদি অ্যান্টিবায়োটিক না দেন, আরেক চিকিৎসকের কাছে চলে যান।
মায়েদের উদ্দেশে আমি বলব, মায়েরা ধৈর্য হারাবেন না। শিশুর যত্ন নেবেন, জ্বর মেপে রাখবেন। জ্বর কমার ওষুধ খাওয়াবেন। অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হলে অবশ্যই দিতে হবে। তবে তার কারণ নির্ণয় করে দিতে হবে। মাকে বোঝাতে হবে, অ্যান্টিবায়োটিক তার আসল চিকিৎসা নয়। আসল চিকিৎসা হলো কারণ বের করা।
প্রশ্ন : শিশুর জ্বরের সময় খিঁচুনি হলে কী সমস্যা হতে পারে? এবং মায়েদের প্রতি আপনার উপদেশ কী?
উত্তর : যেসব বাচ্চার জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হয়, মায়েরা তাদের নিয়ে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েন। যেসব বাচ্চার বয়স ছয় মাস থেকে ছয় বছর, তাদের জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ বাচ্চার জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হয়। এটা কারো কারো অল্প জ্বরেও হতে পারে। আবার জ্বরের যখন তীব্রতা বাড়ে, তখনো হতে পারে। মস্তিষ্কের প্রদাহ হলে এটা হতে পারে। সে জন্য মাকে বোঝাতে হবে, যেই বাচ্চাটির ছয় মাস থেকে ছয় বছর বয়স, এদের জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হতে পারে। জটিল কোনো চিহ্ন না থাকলে এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না। জ্বরকে কমিয়ে রাখতে গা মুছে দেবেন। জ্বরের ওষুধ খাওয়াবেন এবং খিঁচুনির জন্য আমাদের ডায়জিপাম ওষুধ দিই, এটা দিয়ে খিঁচুনি কমাতে হয়। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তত্ত্বাবধায়নে যদি ২৪ ঘণ্টা রাখেন, তাহলে ভালো হয়। কারণ, এটা কি স্বাভাবিক খিঁচুনি নাকি মেনিংজাইটিস, সেটা বুঝতে হবে।
প্রশ্ন : আপনাদের পরামর্শ কী থাকে ভবিষ্যতে যেন খিচুঁনি না হয় সে জন্য?
উত্তর : মাকে আমরা বলি, এই সমস্যা বাচ্চার আবার হতে পারে। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হতে পারে। জ্বরকে কমিয়ে রাখতে হবে, ডায়জিপাম ওষুধ ঘরে রাখতে হবে। যেখানে বেড়াতে যাবেন, সঙ্গে করে এই ওষুধ নিয়ে যাবেন। সব সময় মনে রাখবেন, একবার যেহেতু হয়েছে আরেকবার হওয়ার আশঙ্কা আছে। হাতের কাছেই সবকিছু রাখবেন। আর যে কদিন জ্বর থাকবে, ওষুধ খাওয়াতে হবে। পরবর্তীকালে দরকার হয় না। ছয় বছর পর সাধারণত থাকে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটা থেকে যায়। তখন বিশেষ চিকিৎসা লাগে।
প্রশ্ন : সেটি বোঝার কোনো উপায় রয়েছে কি?
উত্তর : মায়েদের ক্ষেত্রে আমরা বলি, যদি বারবার হয় তাহলে স্বাভাবিক জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি বলব না। এর থেকে কিছু ক্ষেত্রে এপিলেপসির দিকে যেতে পারে। তখন তাকে এপিলেপসির চিকিৎসা দিতে হবে। সে কীভাবে চলবে, তার জীবনযাপন কেমন হবে, এগুলো মাকে বলে দিতে হবে। স্কুলের শিক্ষকদের বলতে হবে কোনোরকম উদ্বেগ, দুশ্চিন্তায় যেন না থাকে।
প্রশ্ন : এক ধরনের জ্বর আছে, যা কিছুদিন পরপর আসে। এটা নিয়ে মায়েরা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে আপনার কী পরামর্শ?
উত্তর : আসলে কিছু কিছু জ্বর ঘুরে ঘুরে আসে। এ ধরনের জ্বর যদি বারবার আসে, তাহলে আপনাকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যেমন হয়তো প্রস্রাবের সংক্রমণে বারবার ঘুরে ঘুরে জ্বর আসে। দেখা গেল, টনসিলের সমস্যা বা এডিনয়েডের সমস্যা, কাশি হচ্ছে, দেখতে হবে তার অ্যাজমার কোনো সমস্যা আছে কি না। এসব কারণেও জ্বর আসে।
আবার কিছু কিছু জ্বর দেখবেন দীর্ঘমেয়াদি জ্বর, এগুলো উচ্চ মাত্রার হয়। যেমন : ম্যালেরিয়া, কালা জ্বর, টিবি—এগুলো দীর্ঘমেয়াদি জ্বর। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পরীক্ষা করে জ্বরের কারণ বের করতে হবে এবং সেভাবে চিকিৎসা নিতে হবে।