নাক কান গলার বিভিন্ন সমস্যা ও প্রতিকার

হঠাৎ করে হয়তো শিশু নাকে বা কানে ছোট কিছু ঢুকিয়ে দিল, আবার গলায় হয়তো পয়সা জাতীয় কিছু আটকে গেল, আবার হয়তো গলাব্যথা শুরু হলো টনসিলের কারণে। এ ধরনের বিভিন্ন সমস্যা হয় নাক, কান ও গলার। এই সব সমস্যায় করণীয় বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. ফুয়াদ মোহাম্মদ শহীদ হোসেন।
ডা. ফুয়াদ মোহাম্মদ শহীদ হোসেন বর্তমানে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত। সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়েছে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩২৬৪তম পর্বে।
প্রশ্ন : নাক কান গলার কী ধরনের সমস্যা হয়? উপসর্গগুলো ঠিক কীভাবে আসে?
উত্তর : একটি শিশু যখন পৃথিবীতে আসে, একদম নবজাতক, কিংবা ছোট বাচ্চা, এই ক্ষেত্রে আপনি দেখতে পারেন, তার শ্বাসের রাস্তাটা ঠিক রয়েছে কি না, তার কোনো শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে কি না। আমরা প্রথমে যেটা করতে পারি, তার নাকের সামনে হাত ধরে বা ম্যাটালিক কিছু ধরে বুঝতে পারি, কোনো বাষ্প পাওয়া যাচ্ছে কি না। কোয়ানাল অ্যাট্রেসিয়া বলে একটি বিষয় রয়েছে। নাসারন্ধ্রের পেছন দিকটা ব্লক থাকে। এ রকম হলে সে জন্মগত একটি ব্লক নিয়ে পৃথিবীতে আসতে পারে। এত ছোট শিশু তো আর তার সমস্যার কথা বলতে পারে না।
এই বাচ্চাটা যখন এক সময় বড় হয়, দেখা যায়, দুষ্টুমি করতে করতে অনেক সময় নাকের মধ্যে পুতি ঢুকায়। হয়তো ছোলার বীজ ঢুকিয়ে ফেলল। এগুলো কিন্তু আমাদের প্র্যাকটিসে আমরা অনেক পাই। এই ধরনের দুষ্টুমি যে তার কত করে। কোনো ছোট বাচ্চা, তার নাক দিয়ে হয়তো দুর্গন্ধ আসছে, কান দিয়ে হয়তো দুর্গন্ধ আসছে, এই ক্ষেত্রে প্রথমেই সন্দেহ করতে হবে কারো অগোচরে সে হয়তো নাক দিয়ে কিছু ঢুকিয়েছে। এগুলো যখন পঁচে, এখান থেকে দেখা যায় দুর্গন্ধ হয়। এ সময় চিকিৎসকের কাছে যাবেন।
অনেকেই ঘরে বসে বের করার চেষ্টা করেন। আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করব, এগুলো করবেন না। নাকের একটি ফরেন বডি হঠাৎ করে কিন্তু শ্বাস তন্ত্রে চলে যেতে পারে। তখন কিন্তু সামান্য একটি জিনিস থেকে অনেক বড় বিপদ ঘটতে পারে। মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে।
অনেক সময় বাচ্চারা পয়সা খেয়ে ফেলে। যদি দেখা যায় কোনো বাচ্চার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, সে নীল হয়ে যাচ্ছে, এই ক্ষেত্রে একদম দ্রুত তাকে কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এই ক্ষেত্রে আমি বলব, ঢাকায় যারা রয়েছেন, ঢাকা মেডিকেলে ইএনটি ইমার্জেন্সি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে, সেখানে নিয়ে যেতে পারেন। আরো অনেক হাসপাতালেও এই সেবাটা পাওয়া যায়।
এরপর ধরুন, আরেকটু বড় হয় যখন বাচ্চাটা, বাচ্চাটা হয়তো মুখ হা করে শ্বাস নেয়। এসব বাচ্চারা ঘুমের মধ্যে খুবই অস্থিরতা করে। নাক ডাকে প্রচুর। এ সমস্ত ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এডিনয়েডের বৃদ্ধির কারণে এটি হয়।
গলা ব্যথা নিয়েতো সবাই জানে। গলাব্যথা মানে টনসিল। নাকের আরেকটি উপসর্গ আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি। এটি হলো নাকে রক্ত যাওয়া। এখন রক্ত কিন্তু এমনিও চলে আসে। এই সমস্যার ৮০ ভাগ কারণই কিন্তু অজানা। এটি কিন্তু ক্ষতিকর নয়। তবে এই রোগের শেষ কোথায়? এর চিকিৎসা, প্রথমে হলো নাকটা চেপে ধরে থাকতে হয় এবং একটি কোল্ড কমপ্রেশন বা ঠান্ডা স্যাঁক দিতে হবে। এরপর আপনি চিকিৎসার জন্য বা অন্য কোথাও নিয়ে গেলেন।
বাচ্চাদের নখগুলো কিন্তু অনেক তীক্ষ্ম থাকে। তারা অনেক সময় নাক খুঁটে। সেখান থেকে সুতার মতো যে রক্তনালি সেগুলো ছিঁড়ে যেতে পারে। এগুলো ছিঁড়ে গেলেও কিন্তু রক্তক্ষরণ হয়। ঠাণ্ডা থেকেও হতে পারে। কারো যদি নাকের হাড় বাঁকা থাকে, এর থেকেও হতে পারে। সাইনোসাইটিসের কারণে হতে পারে।
যদি কোনো বয়োসন্ধি শিশু, বিশেষ করে ছেলে শিশু, এ রকম কোনো বাচ্চার যদি নাক দিয়ে রক্ত আসে হঠাৎ করে, কোনো কারণ ছাড়া, একে আপনাকে অন্যভাবে নিতে হবে। কারণ, নেজোফেরিংজাল এনজিও ফাইব্রোমা বলে এক ধরনের টিউমার রয়েছে, যেটি বয়োসন্ধি ছেলেদের হয়। এই রোগটি কিন্তু নির্ণয় করা খুব জরুরি। একে বিনাইন বলা হয়, তবে এটি ম্যালিগনেন্টের চেয়ে বেশি। কারণ, এখানে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এই অস্ত্রোপচারটাও কিন্তু চ্যালেঞ্জিং।
প্রশ্ন : নাক দিয়ে রক্ত বের হওয়ার আগ পর্যন্ত কি এটি বোঝার উপায় নেই?
উত্তর : না, কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করলে তো আপনি বুঝতে পারবেন না। নাক দিয়ে রক্ত পড়াটা এর একটি অন্যতম প্রধান লক্ষণ। এটি নির্ণয় করাটা খুব কঠিন নয়।
আরো একটি বিষয় কী জানেন, লিউকোমিয়ার কারণেও কিন্তু নাক কান গলার এই রক্তক্ষরণের প্রবণতা দেখা দেয়। এরপর যদি আরেকটু বড় হয়, নেজাল অবসট্রাকশন বলি আমরা। নাকটা বন্ধ হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে একটি কথা খুব প্রচলিত। সেটি হলো, ‘আমার নাকে পলিপ হয়েছে’। এই ক্ষেত্রে কিছু অপচিকিৎসা আমাদের দেশে হয়। তারা পলিপের চিকিৎসা দিতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের এসিড দিয়ে নাকটা আরো বেশি বন্ধ করে দেয়। হঠাৎ করে হয়তো তার মনে হয় খুব ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু পরে হয়তো আমরা দেখি, নাকের পেছন দিকে জোরা লেগে গেছে। আরো কষ্টকর বিষয় হলো, তার হয়তো পলিপ বলে কিছু নেই-ই।
আমাদের নাকে কিছু বিষয় রয়েছে, এগুলোকে মাংসের বৃদ্ধি বলি আমরা। এগুলো হয়তো অ্যালার্জির কারণে বৃদ্ধি পায়। কারো হয়তো এমনিতেই রয়েছে। কেউ বারবার করে হয়তো নাক আয়নায় দেখে দেখে, শুনে শুনে ভাবছে তার পলিপ হয়েছে। এখন আসলে পলিপ খুবই কম হয়। ওষুধের সহজলভ্যতার কারণে, চিকিৎসার বিস্মৃতির কারণে যেই অ্যালার্জির অবস্থা হয়ে পলিপ হওয়াটা, এটা আসলে খুব বেশি হয় না। আবার অনেকেই ছোট বাচ্চাদেরও বলে তারও পলিপ হয়েছে।
এরপর আরেকটি বিষয় হলো মাইগ্রেন। মাইগ্রেনের প্রচুর রোগীতো আমাদের নাক কান গলার চিকিৎসকদের দেখতে হয়। এই ব্যথাটা সাধারণত দেখা যায় মেয়েদের বেশি হয়। প্রজনন বয়সে ব্যথাটা বেশি হয়। এই ব্যথাটা আসার আগে বুঝতে পারে যে ব্যথাটা আমার আসছে। যার হয়েছে,সে নিজে বুঝতে পারে। সাধারণত এই ব্যথাটা এক দিকে হয়। গ্রামে বলে, ‘আধকপালি হইছে।’ অর্ধেক কপালে ব্যথা হয়।
আর নাক কান গলার আরেকটি সমস্যা হলো স্বরভঙ্গ। সাধারণত যারা গলার ব্যবহার বেশি করে কাজ করেন, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক- আবার যেই মায়ের বেশি সন্তান, খুব দুষ্টু, তাদের গলা এত বেশি অপব্যবহার করা হয় যে এদের স্বরভঙ্গ হয়। কোনো স্বরভঙ্গ যদি বেশি দিন থাকে, তিন সপ্তাহের বেশি থাকে, এর সঙ্গে তার কোনো ইতিহাস থাকে,উনি ধূমপায়ী, উনি হয়তো জর্দা দিয়ে পান খান, তার হয়তো কোনো রাসায়নিক পদার্থের কাছে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে স্বরভঙ্গ হলে অবশ্যই খেয়াল করা দরকার। এখানে কিন্তু শ্বাস প্রণালির যে ক্যানসার, দেখা যায়, শ্বাসকষ্টটা প্রকোপ হয়ে গেল।
সাধারণ স্বরভঙ্গের ক্ষেত্রে কিন্তু চিকিৎসাটা খুবই সহজ। একটি হলো স্বরের বিশ্রাম। আর রিএডুকেশন অব স্পিচ। অর্থাৎ কথা বলাটা নতুন করে শিখতে হবে। আমরা অনেক সময় বিরতি ছাড়া কথা বলে যাই। আমরা চিন্তা করি না স্বরযন্ত্রও একটি যন্ত্র। এরও একটা বিশ্রাম দরকার। অনেকে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করে না।
আরেকটি বিষয়, আমাদের দেশের একটি অভ্যাস হলো, আমরা অনেক দেরি করে রাতে খাই এবং খেয়েই শুয়ে পড়ি। এটিও কিন্তু কণ্ঠনালির জন্য ভালো নয়।
আর কয়েকটি বিষয় সংক্ষেপে বলে ফেলি। এই যে নাক দিয়ে রক্ত যাওয়ার কথা বলেছিলাম, মধ্য বয়সে রক্ত যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় রক্ত চাপের ওঠানামার ক্ষেত্রেও রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়েও কিন্তু রক্ত যায়।
প্রথমত, আমরা রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করি, রক্তচাপটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। পরে চিকিৎসাটা কিন্তু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে করতে হবে। এই রক্তচাপে ওঠানামা যদি চলতে থাকে, একসময় তিনি কিন্তু স্ট্রোক করবেন। সেই কারণটা আগে বের করতে হবে। আরেকটি হলো, অনেক সময় দেখা যায় বয়স্ককালে ম্যালিগনেন্সির কারণে হতে পারে। গলার কোনো ম্যালিগনেন্সি বা ক্যানসারের কারণেও কিন্তু রক্ত আসতে পারে।
আর দুটো জিনিস আমি সংক্ষেপে বলি। একটি হলো কানে শোঁ শোঁ শব্দ হওয়া, আরেকটি হলো মাথা ঘোরা। কানের একটি রোগ রয়েছে, এই রোগে কানে শোঁ শোঁ শব্দ হয়। একে অটোস্ক্লেরোসিস বলে। এখানে আমাদের কানের যে ছোট ছোট হাড়, এতে সমস্যা হয়। রাতের বেলা এদের খুবই অস্বস্তি হয়।
আরেকটি হলো ভার্টিগো। একে আমরা মাথা ঘোরা বলি। মাথা ঘোরা অনেক কারণে হয়। কিন্তু মিনিয়ার্স ডিজিজ বলে একটি অসুখ রয়েছে, নাক কান গলার চিকিৎসকরা আমরা বের করি। এর কারণেও কিন্তু মাথা ঘোরার সমস্যা হতে পারে।