মহৎ পেশার মানুষ

তরুণদের স্বপ্ন দেখতে হবে : ডা. নাঈম

Looks like you've blocked notifications!
অধ্যাপক সরদার এ নাঈম। ছবি : সংগৃহীত

ছোটবেলা থেকে প্রশংসা শুনতে বেশ ভালো লাগত ছেলেটির। ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল সে। আর সে জন্য সবার কাছ থেকে বেশ প্রশংসাও পেত। একদিনের ঘটনা, ছেলেটি তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। বাসায় মামারা এসেছেন। আনন্দের চোটে সারা দিন কিছু পড়েনি সে। কিন্তু যখন দেখল, মামারা তার দিকে তেমন মনোযোগী নয়, অমনি পড়তে বসে গেল সবার সামনে। আর তা দেখে মামাদের কী প্রশংসা! তবে এই অতি নাটুকেপনার জন্য মায়ের কাছ থেকে সেদিন বেদম মারও খেয়েছিল সে।

বলছি বাংলাদেশে ল্যাপারোস্কোপির পথিকৃৎ অধ্যাপক সরদার এ নাঈমের কথা। ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশে প্রথম ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি করেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজারের বেশি ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি হয়েছে তাঁর হাতে। ল্যাপারোস্কোপি সার্জারির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনশরও বেশি চিকিৎসককে। প্রতিষ্ঠা করেছেন জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল।

সুহৃদ এই মানুষটি এনটিভি অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তাঁর জীবনের গল্প।

মা-বাবা চাইতেন ডাক্তার হই

আমার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ, বিক্রমপুরের গজারিয়া উপজেলায়। বাবা সরদার আবদুল কাদের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে চাকরি করতেন। লেখাপড়ার শুরুটা হয়েছিল মুন্সীগঞ্জে দেওভোগ প্রাইমারি স্কুলে। মুন্সীগঞ্জ হাই স্কুলে বছরখানেক পড়ার সুযোগ হয়।

ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান পরে সোনালী ব্যাংকে রূপান্তর হয়। বাবা ঢাকার সোনালী ব্যাংকে যোগ দেন। তখন বাবার সঙ্গে ঢাকায় এসে টিঅ্যান্ডটি স্কুলে ভর্তি হই। ক্লাস সেভেনে মতিঝিল আইডিয়াল হাই স্কুলে চলে গেলাম। ডাক্তার হবো বা ডাক্তার হতে হবে, এ ধরনের একটি চিন্তা মা-বাবা মাথায় দিয়ে দিয়েছিলেন।

১৯৭৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করলাম। এরপর ১৯৭৮ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করলাম ১৯৮৫ সালে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে থাকার সময় সার্জারিতে ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভাবছিলাম।

আমি সাংস্কৃতিক কাজে অনেক যুক্ত থাকতাম। অভিনয় করতাম, বক্তৃতা দিতাম। সে সময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম।

গানও শিখেছি কিছুদিন

আমার বাবা খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। খুব সৎমানুষ ছিলেন। অবশ্য তিনি গান পছন্দ করতেন না। তবে গান শিখতাম আমি। কিছুদিন ছায়ানটেও গান শিখেছি। গান শিখতে গিয়ে পরিচয় হলো আশা ইসলামের সঙ্গে। তিনিই আমার স্ত্রী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের মেয়ে। আমার শ্বশুর বাংলাপিডিয়া তৈরি করেছেন।

আমি উচ্চতর ডিগ্রির জন্য টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পাই। জাপান যাওয়ার আগে বিয়ে করি। আমার স্ত্রী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক।

বারডেমে করা হয় প্রথম ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি

১৯৮৯-এর শেষে জাপানে ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি শুরু হলো। সারা পৃথিবীতে ল্যাপারোস্কোপির জোয়ার এলো। ল্যাপারো মানে পেট। আর স্কোপি মানে ক্যামেরা দিয়ে দেখা। পেটের ভেতর ক্যামেরা দিয়ে দেখা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে, বিশেষ করে সার্জারির ক্ষেত্রে নতুন দ্বার খুলে দেয় ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি।

অধ্যাপক ফিলিপ মুরে প্রথম ফ্রান্সে এই অস্ত্রোপচার করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র এটি করল। আমার প্রশিক্ষক অধ্যাপক ইয়াসুও ইডেজুকি আমেরিকা চলে গেলেন এটি শিখতে। এরপর ফিরে এসে উনি পাঁচজনের দল তৈরি করলেন। এই পাঁচজনের মধ্যে আমাকেও নিলেন। রোগীকে পেট না কেটে ক্যামেরার মাধ্যমে অস্ত্রোপচার করে একদিনে ছেড়ে দেওয়া হতো।

কাজটি শেখার সময় আমি চিন্তা করলাম, দেশে ফিরে এটি করব। বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কোনো চিকিৎসা ব্যক্তিত্বকে বিষয়টি জানানো প্রয়োজন মনে করলাম। এর পর বারডেমের পরিচালক অধ্যাপক এ কে আজাদ খান এবং সোসাইটি অব সার্জনস অব বাংলাদেশের তখনকার প্রেসিডেন্ট ও পিজির (বর্তমানে যেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক গোলাম রসুল স্যারকে জাপানে এসে ল্যাপারোস্কোপির সম্পূর্ণ বিষয়টি এবং আমার কাজ দেখার জন্য অনুরোধ করলাম। তাঁরা জাপানে গেলেন এবং এই সার্জারি দেখলেন। তাঁরা অত্যন্ত অভিভূত হলেন।

এরপর ১৯৯১ সালে আমি সোসাইটি অব সার্জনসের আন্তর্জাতিক একটি কনফারেন্সে দেশে আসি। ’৯১ সালের ২০ ডিসেম্বর বারডেমে প্রথম ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি করি। এরপর আবার চলে গেলাম টোকিওতে। ’৯৩ সালে দেশে ফিরে এপ্রিলের ১ তারিখে বারডেমে যোগ দিই। সবকিছু খুব সুন্দরভাবে হয়। আমি খুব সৌভাগ্যবান। কারণ, এই সার্জারির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এমন কোনো সমস্যা হয়নি, যাতে এই সার্জারির ভবিষ্যৎ নিয়ে এ দেশে জটিলতা হতে পারে।

আমি পঁচিশ হাজারের ওপরে ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি করেছি। বহু চিকিৎসককে ল্যাপারোস্কোপির সার্জারিতে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বর্তমানে আমি জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে কাজ করছি। এর প্রতিষ্ঠাতা আমি। সার্জারি নিয়ে বর্তমানে খুব ব্যস্ত সময় পার করছি। সোসাইটি অব ল্যাপারোস্কোপি অব বাংলাদেশের বর্তমান পরিচালক আমি।

ল্যাপারোস্কোপির বিষয়টি সহজভাবে নেওয়া হতো না

একদিনের ঘটনা, বারডেমে একজন বড় চিকিৎসক এসেছেন তাঁর স্ত্রীর পিত্তথলির পাথরের সার্জারি করাতে। তিনি ল্যাপারোস্কোপির পক্ষে নন। ওপেন করে, অর্থাৎ পেট কেটে সার্জারি করার পক্ষে। তিনি ল্যাপারোস্কোপির পক্ষে তেমন ভালো কথা বললেন না। আমি এক কোনায় বসে রয়েছি। আসলে ল্যাপারোস্কোপির বিষয়টি প্রথমে সহজভাবে নেওয়া হতো না।

যাই হোক, কিছুক্ষণ পর তাঁর স্ত্রীর অস্ত্রোপচার শেষ হলো। এরপর আমি তাঁকে বললাম, স্যার আমি একটি ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি করব এবং দয়া করে আপনি সেটি আমার সঙ্গে গিয়ে একটু দেখবেন। এরপর তিনি এলেন। তিনি যখন দেখলেন, মাত্র কয়েকটি ফুটো করে ক্যামেরার সাহায্যে কী সহজে সার্জারি করে ফেলা যাচ্ছে, তখন বিস্মিত হলেন এবং সবাইকে বকতে শুরু করলেন, তাঁর স্ত্রীকে ওপেন করে সার্জারি করার জন্য, তাঁকে ল্যাপারোস্কোপি নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য।

প্রবীণদের নিয়ে কাজ করতে চাই

প্রবীণ বয়সটি একজন মানুষের জন্য খুবই দুর্দশার। আমি প্রবীণদের সব ধরনের সাহায্য করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান তৈরিতে হাত দিয়েছি। এর নাম ঢাকা এভারগ্রিন রিটায়ারমেন্ট হোম। পূর্বাচলের পাশেই ১০ কাটা জমি কেনা হয়েছে এর জন্য। আমার সার্জারি জীবনের পরে, জীবনের শেষ পর্যন্ত এই কাজটি করতে চাই। যে প্রজেক্টগুলো আমরা করছি সেগুলো হলো, জেরিয়াট্রিক হোম, জেরিয়াট্রিক হসপিটাল, জেরিয়াট্রিক নার্সিং স্কুল, জেরিয়াট্রিক কেয়ার গিভার ট্রেনিং স্কুল। আমি যেটি চাচ্ছি, সেটি হলো একটি সম্পূর্ণ জেরিয়াট্রিক প্রোজেক্ট তৈরি করার। যেখানে যেই জনগোষ্ঠীর সামর্থ্য রয়েছে, তারা জীবনের শেষ সময়টুকু মনের মতো করে পার করতে পারবে। এখানে তার সন্তানদের থেকে তাকে আলাদা হতে হবে না। আমরা জেরিয়াট্রিক ডে-কেয়ার সেন্টার রাখব। এমনকি সামর্থ্যহীনদের জন্যও এ ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছি।

স্বপ্ন দেখতে হবে

মানুষকে স্বপ্ন দেখতে হবে, আমার এমনটাই মনে হয়। স্বপ্ন দেখে এগোলেই মানুষ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। স্বপ্ন যদি কেউ লালন করে, তাহলে সফলতা পায়। তরুণদের তাই স্বপ্ন দেখতে হবে। চিকিৎসাপেশায় যারা রয়েছে, তাদের নিজেদের দেশকে বিশ্বের দরবারে আরো উঁচু করার জন্য সৎভাবে কাজ করতে হবে।